পাঠকই লেখক ডেস্ক: (১) - তোকে না কতবার বলেছি এভাবে যখন-তখন ফোন করবি না। কি বলবি তাড়াতাড়ি বল, আমার কাজ আছে।
অহনার কথাগুলো শুনে চুপসে গেল ইফতি, যদিও ও জানত অহনা এমনি বলবে। এমনি বলছে অহনা
প্রায় তিন মাস যাবত, ওকে একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টাও করছে ইদানিং। কি করবে বুঝতে পারছেনা
ইফতি, একটু ঢোঁক গিলে বলল,
- কি করছিলি?
- এইটা জানার জন্য এই ভর সন্ধ্যায় আপনি ফোন করেননি জনাব। কাজের কথা বলেন।
- কাল ভার্সিটি তে আসবি তো?
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
- কাল কি কোন সরকারী ছুটি?
- না তো
- ঐ গাধা, তাহলে ভার্সিটিতে যাবনা কেন?
- না, এমনেই বললাম, জাস্ট জানার জন্য
- আমার ব্যাপারে আপনার এত না জানলে ও চলবে
- আচ্ছা ঠিক আছে
- ফোন রাখ, কালকে ভার্সিটি তে দেখা হবে
বলেই ফোনটা কেটে দেয় অহনা। ইফতি শুনতেই থাকে টুট টুট টুট…।
ওদের পরিচয় নয় বছরের, বন্ধুত্ব ও প্রায় নয় বছরেরই। এর মধ্যে হাই স্কুল এর চার বছর ওরা
এক সাথে পড়েছে, কলেজের সময়টা আলাদা থাকলে ও এখন আবার একই ভার্সিটিতে পড়ছে, তাও তিন
বছর হয়ে গেল। এত দিনের চেনা অহনা কে গত কয়দিন ধরে একটু অচেনাই মনে হচ্ছে ইফতির।
- কি রে, ক্লাস করলি না কেন?
অহনার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে ইফতি।
- এমনি, ভাল লাগছিল না
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
- বাসা থেকে আসলো ক্লাস করতে, এখন উনার ভাল লাগছে না, কইদিন পরে বলবেন, বাসাতেই
থাকি, ভার্সিটি যেতে ভাল লাগছে না।
- আচ্ছা, তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?
- কিভাবে কথা বলবো আপনার সাথে?
- আচ্ছা বাদ দে, চল তোকে বাসায় পোঁছে দিয়ে আসি।
- আমি একাই যেতে পারব, কারো হেল্প লাগবে না আমার।
বলেই ইফতির অপেক্ষা না করে ভার্সিটি গেটের দিকে হাঁটতে থাকে অহনা। পিছু ডাকতে গিয়েও কি
ভেবে থেমে যায় ইফতি।
কয়েক দিন আগের কথা, এত প্রানোচ্ছল অহনাকে চিনতে পারছিলনা ইফতি, মনে হচ্ছিল ঘুমায়নি
কয়েকদিন। ক্লাসের পরে একটা ফাকা জায়গায় ইফতিকে পেয়েই বলল -
- তোর সাথে কথা আছে
- বল
- আমাকে দেখতে কালকে রাতে লোক এসেছিলো, ছোটখালা এনেছেন প্রস্তাব টা, ছেলে ব্যাংকে
চাকরি করে, ভাল বেতন পায়, গাড়ীও আছে। বাসায় কারো অপছন্দ হয়নি ঐ ছেলে। সবাই আমার
মতের জন্য ওয়েইট করছে।
এক নিঃশ্বাশে কথাগুল বলে থেমে যায় অহনা।
- তোর মত কি? ইফতি জানতে চায়।
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
- জানি না
- আমিতো খারাপ কিছু দেখি না
- চোখ থাকলেতো দেখবি, গাধা কোথাকার
অহনার এই কপট অপমান গায়ে মাখেনা ইফতি, ভালভাবে শুনেও না কি বলল অহনা। শুনবে কি, ওর
বুকের ভেতর যে হাতুড়ী পেটার শব্দ হচ্ছে তার কাছে অহনার গলার আওয়াজ কিছুই না। মাথার
ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগে, একটু তৃষ্ণাও লাগে ওর। এবার সাবধান হয় ইফতি। না এসবের
কিছুই বুঝতে দেওয়া যাবেনা অহনা-কে। কোনরকমে ঢোঁক গিলে বলে,
- চল, উঠি
- উঠি মানে?
- মানে বাসায় যাই, চল, ওঠ।
- না, আমি যাব না, আগে বল ঐ ব্যাংকার বেটার কি করবো?
- ঝুলে পড়, মানে রাজি হয়ে যা।
মনের অবস্থা লুকিয়ে মজা করে ইফতি।
- চড় খাবি। বললেই হল, রাজি হয়ে যা। আমি তাকেই বিয়ে করবো যাকে আমি পছন্দ করি, যাকে
আমি ভালবাসি।
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
ইফতি জানে এমন কেউ নেই অহনার, থাকলে আর কেউ না জানুক, ও জানতো। তবুও অজানা
আশঙ্কায় আরও একবার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। চোখ দুটোও কেমন ঘোলা ঘোলা লাগে।
আচ্ছা ভোকাল কর্ডের কি হল আবার, ওটা নড়ছেনা কেন? অন্য দিকে তাকিয়ে কোনরকমে ইফতি
বলে,
- চল, এখন উঠি। বেশি দেরি করলে খালাম্মা টেনশন করবেন।
- ওরেব্বাবা, এত দরদ খালাম্মার জন্য। আমি কেউ না, না? যখন চিরদিনের জন্য চলে যাব, তখন
দেখব দরদ কোথায় থাকে।
- কোথায় যাবি তুই? - হাসার চেষ্টা করে ইফতি
- জাহান্নামে। যাবি আমার সাথে?
- আচ্ছা, যখন যাবি তখন বলিস, নিয়ে যাব, এখন ওঠ।
এর পর থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে থাকে অহনা। কি করবে বুঝতে পারে না ইফতি ও। এত
দিনের বন্ধুত্ব কখনযে অন্যকিছুতে রুপ নিয়েছে ইফতি বুঝতে পারেনি। একবার ভাবে, বলে ফেলি
ওকে, যা হয় হবে। বলে দেই, তুই পাশে না থাকলে চরপাশ কেমন সাদা-কাল হয়ে যায়। বলে দেই,
তোর বিয়ের কথা শুনে কেমন আটকে গিয়েছিল আমার ভোকাল কর্ড । আবার ভাবে, কি হবে
বলে? অহনা কখনও রাজি হবে না। তাছাড়া, যদি ওকে ভুল বুঝে? যদি বলে এত দিনের বন্ধুতের
আড়ালে এই ছিল তোর মনে? নাহ, জেনে শুনে ওকে কোন কষ্ট দিতে পারবেনা ইফতি। তারচেয়ে
এই ভাল, মনের কথা মনেই থাকুক, কষ্ট যা হবার আমারই হোক, ওকে যদি ভালইবাসি, তাহলে ও
যেভাবে ভাল থাকবে সেটাই আমার চাওয়া উচিত। আবার এই ভেবে একটু ভালোও লাগে যে আজকাল
অহনা নিজে-ই ওকে একটু এভয়েড করছে। মেয়ে মানুষের মন, হয়তো সবকিছু ভেবে ঐ ব্যাংকার
বেটাকেই বিয়ে করবে ঠিক করেছে।
সময় গড়িয়ে যায়, ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যায় ওদের। এর মাঝে কেম্পাসে কয়েকবার দেখা হলে ও
তেমন কোন কথা বলেনা কেউ। মাঝে মধ্যে অহনার মোবাইলে কল করে বন্ধ পায় ইফতি, শেষে
লজ্জার মাথা খেয়ে ওদের বাসায় ফোন করে ও, যখন ওর গলাটা খুব শুনতে ইচ্ছা করে তখন, যখন
মনে হয় এই মুহূর্তে ওর কথা না শুনলে ভোকাল কর্ডটা ছিরদিনের মত আটকে যাবে তখন। কিন্তু
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
কোন না কোন দোহাই দিয়ে তাও এড়িয়ে যায় অহনা। কথা হয় খালাম্মার সাথে, কিছু কুশল
বিনিময়ের পরে উনি বলেন, দোয়া করো বাবা, ভালভালয় ওর বিয়েটা যেন হয়ে যায়। অহনার
বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা বলতে পারেনা ইফতি, গলাটা ধরে আসে।
আচ্ছা ইফতিকে এত বেশি এড়িয়ে চলছে কেন অহনা? তাহলে কি ওইদিন ঐ কথাটা মজা ছিলনা? ঐযে
অহনা বলেছিল, ও বিয়ে করবে তাকেই যাকে ও ভালবাসে। ঐ ব্যাংকার কে তো অহনা চিনেও না।
এর মানে কি ওর কোন ভালবাসার মানুষ আগে থেকেই ছিল? এত ভাল বন্ধু হবার পরও এই কথাটা
ওর কাছে গোপন করতে পারল অহনা? নাকি কোন ভয় ছিল অহনার? নিজের মনের এই অবস্থা
তো ইফতি কোনদিন বুঝতে দেয়নি অহনাকে। তাহলে কাকে নিয়ে অহনার এই অহংকার? ওর
ভালবাসার মানুষটা কি অনেক উঁচুতলার কেউ? নিজেকে খুব ছোট মনে হয় ইফতির। দুচোখের পাতা
এক করতে পারে না ইফতি, কিভাবে পারবে, ভিজা চোখের আঠালো পাতা বন্ধ করাযে খুব সহজ
নয়।
জীবনের গতিতে এগিয়ে যায় জীবন। অহনার কথা না ভাবতে চাইলেও অবচেতন মনের হিসাবেই ইফতি
যানে, কাল ওর বিয়ে। অহনা একবার বলেছিল চিরদিনের জন্য চলে যাবার কথা, কালকেই কি সেই
দিন? বিয়ের সাজে অহনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা হয় একটিবারের জন্য। ইচ্ছা করলেই যাওয়া যায়,
কিন্তু যাবে না ইফতি। কিভাবে যাবে ও!! ও জানে অহনা ওকে সবসময় বন্ধু হিসাবে দেখেছে, এর
বাইরে কিছুই না, তাই বলে এতদিনের বন্ধুত্ব কে মনে করে একটা ফোন করলে কি এমন ক্ষতি হত
অহনার। অভিমানে ভারী হয় মন, নিজেকে আবারও তুচ্ছ মনে হয় ইফতির, ফোনটা হাতে নিয়ে
চোখ বন্ধ করে ইফতি, ভিজা চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়।
হঠাৎ মোবাইল এর ভাইব্রেশনে তন্দ্রা ছুটে যায় ইফতির। মনের ভুল ভেবে তাকায় দেয়াল ঘড়িটার
দিকে। রাত ১১টা ১৫ মি, এরপর অনিচ্ছা সত্যেও মোবাইলটা হাতে নেয় বন্ধ করের জন্য। এত
রাতে অপরিচিত নম্বর থেকে একটা কল। একবার ভাবে ধরে বকা দেই, আবার ভাবে আগে দেখি কে,
ফালতু কল হলে দেব বকা। অহনা সংক্রান্ত সব রাগ ঐ কলারের উপর ঝাড়ার একটা সুযোগ
আসছে দেখে নিজের মনেই একটু হাসে ইফতি।
- হ্যালো
- কই তুই?
- আপনি কে? আর আমাকে তুই করে বলছেন কেন?
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
- তোরে আমি কোনদিন আপনে কি, তুমি কইরাও তো বলি নাই।
এই কথায় একটু থমকে যায় ইফতি, একটা নারী কণ্ঠ। না, বকা টা যুতশুই ভাবে দেওয়া যাবে না,
আফটার অল মহিলা তো। আগের মতই শান্ত গলায় ইফতি বলে
- কি আপনি? কাকে চান?
- তোরেই তো চাইরে গাধা। তুই কই বললি না এখনো?
গলাটা ও বেশ পরিচিত, তবে “গাধা” ডাক টা শুনে তন্দ্রা পুরোই কেটে যায় ইফতির। এটা তো
অহনার জন্য প্যাটেন্ট করা, একবার ভার্সিটির আরেক বন্ধু ইফতিকে গাধা বলেছিল বলে তাকে চড়
মেরেছিল অহনা। এই নিয়ে কত ঝামেলা, বিচার-আচার। শেষে অহনার হয়ে মাফ চাইতে হয়েছিল
ইফতিকে। এখন সবই ধূসর স্মৃতি। অভিমান করে অহনার নাম্বার মুছে দিয়েছিল কয়দিন আগে, তাই
এ বিপত্তি।
একটু সামলে নিয়ে ইফতি বলে,
- ও তুই। কি বলবি বল। - অভিমান ঝড়ে পড়ে ইফতির কণ্ঠে
- ওরে আমার সোনা বন্ধুরে। এতদিন পরে ফোন করলাম, কই একটু বিয়ের খোঁজ-খবর নিবি,
তা না, উনি রাগ করে আছেন।
- তোর বিয়ে, তাতে আমার কি?
- বা রে, আমি তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড না? কোথায় বিয়ে হচ্ছে, কার সাথে হচ্ছে, লোকটার মাথায়
টাক আছে কি না-গোঁফ আছে কি না, আগের কোন বউ আছে কিনা, এইগুলা একটু জানবি না।
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
- বিয়ে তোর, এইগুলা জানার আমার কোন দরকার নাই।
- আচ্ছা যা, এইগুলা তোকে দেখা হলে বলবো।
মনে মনে হাসে ইফতি, কালকে ওর বিয়ে, আর কখনো ওর সাথে দেখা হবে না, এই কথাটা ঐ পাগলী
এখনো বুঝে নাই। অহনা আবার বলে,
- দোস্ত, আমাদের বাসায় আয় একটু।
- মানে কি? কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আর তাছাড়া তুই ডাকলেই আমি আসব কেন?
- এখন রাত ১১ টার বেশি বাজে, আমি জানি। আর আমি যখনি ডাকি, যতবার ডাকি, যেখানে
ডাকি, তুই আসবি, তোকে আসতেই হবে, কারন তুই আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। তাছাড়া তুই আমাকে
কথা দিয়েছিলি না, আমাকে জাহান্নমে দিয়ে আসবি। কি মনে পড়েছে? বলে হাসতে থাকে অহনা।
কি হচ্ছে এইসব? এইগুলো আমার কল্পনা, এইগুলো এখন ঘটছে না। আমি অহনার সাথে কথা বলছি
না। কিন্তু পরক্ষনেই ভুল বুঝতে পারে ইফতি। ফোনের ওপার থেকে অহনা বলে,
- কি দোস্ত, কি হইল তোমার? জাহান্নামের কথা শুনে ভয় পাইস? ভয়ের কিছু নাই, তোমাকে
জাহান্নমে নিবনা, আমি একাই যাব। বাসা থেকে বের হতে তোর একটু হেল্প লাগবে, একটু আয় না
দোস্ত।
ইফতি বুঝতে পারে, জাহান্নমে তার যাওয়া লাগবে না, স্বয়ং জাহান্নাম-ই তার সামনে উপস্থিত।
ঘটনা মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। এবার চুপসে যায় সে, মিন মিন করে বলে,
- কালকে না তোর বিয়ে। এখন বাসা থেকে বের হলে ফিরবি কখন? লোকজনই কি বলবে?
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
- এসব তোকে ভাবতে হবে না। আরেকটা কথা শোন, তোকে আমি কোন দিনই ফোন করতাম
না, আমার যায়গায় আমি একাই যেতে পারি, কিন্তু এত রাতে, একা একটা মেয়ে, বড় একটা সুটকেস
নিয়ে রাস্তায় দাড়ায়ে থাকবে, ট্যাক্সি-রিকশা খুজবে এইটা হয় বল?
- সুটকেস নিয়া যাবি মানে? কই যাবি? - এবার আতঙ্কিত শোনায় ইফতির গলা।
- আমি যাব আমার ভালবাসার কাছে। চিরদিনের মত যাব। মনে আছে তোকে বলছিলাম, আমি
যাকে-তাকে বিয়ে করবো না, আমি তাকেই বিয়ে করবো যাকে আমি ভালবাসি। আচ্ছা দোস্তো
শোন, তুই যদি না আসতে চাশ, আমিতো তোকে জোর করে আনতে পারব না, তুই না আসলে
আমাকে একাই বের হতে হবে, এক কাপড়ে। তুই যদি আসিস তাহলে গেট বা বারান্দা দিয়ে বের হব,
আর যদি না আসিস তাহলে বের হব ছাদ দিয়ে, সোজা জাহান্নামে। বোঝা যাচ্ছে আমার কথা?
এখন ডিসিশন তোর। তোর হাতে আর ৩৫ মিনিট সময় আছে। দেখ কি করবি।
ইফতি একবার ভাবল, বলে দেই তোর ভালবাসার মানুষকে বল, এসে নিয়ে যাক, কিন্তু সাহসে কুলাল
না। অবস্থা মনে হচ্ছে এমনেই যথেষ্ট খারাপ, এটাকে আর খারাপ করার কোন ইচ্ছা নাই তার।
- আচ্ছা তোর বাসার লোকজন কি ভাববে? বিশেষ করে তোর আম্মা?
কথা শেষ হবার আগেই দেখল লাইনটা কেটে গেছে। কখন, কতক্ষন আগে কে জানে। বিছানা থেকে
নামতে গিয়ে ইফতি টের পায় পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে অহনার উপর এত দিনের
সব রাগ-ক্ষোভ-আভিমান সব মায়ায় পরিনিত হল। অহনার শ্যামলা, একটু রোগা মিষ্টি চেহেরা,
দুষ্টুমি ভরা দ্যুতিময় চোখ দুটি ভাসতে লাগলো ওর সামনে। না, কোন ভাবেই দেরি করা যাবে
না, কোন দুর্ঘটনা ঘটে যাবার আগেই ওদের বাসায় পৌছতে হবে। চলে যাক সে অন্যকারো কাছে,
তবু জানবে তো, ও ভাল আছে, সুখে আছে। এটাই বা কম কিসে।
মধ্যরাতের ঢাকা, তাই মহাখালি থেকে উত্তরা পৌছতে খুব বেশি সময় লাগল না ইফতির।
(২) রাত পৌনে একটা। ওরা এয়ারপোর্ট শংলগ্ন বাসস্টপ-এ, অহনা দাড়িয়ে আছে ইফতির
পিছনে, ইফতির হাতে ধরা অহনার বিশাল সুটকেস। এতবড় সুটকেস ইফতি জীবনেও দেখেনি, কোথায়
পেয়েছে কে জানে, মনেহয় ওর বিয়ে উপলক্ষে কেনা। আর এত ভারী, কি কি নিসে কি জানে, অহনা
নিজেও তো মনে হয় এত ভারী হবে না। এই মেয়ে যার কাছেই যাচ্ছে, কোথাও বেড়াতে গেলে ঐ
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
বেটার খবর আছে। পরিবার যখন আরও বড় হবে, তখন তো কথাই নাই। যাই হোক, তাতে আমার
কি, পুরনো বন্ধু হেল্প চাইল - হেল্প করলাম, এখন সে তার নিজের রাস্তা দেখবে। আমি গোলাম
হুসেন, আবার ব্যাক-টু-দা-প্যাভিলিয়ান। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মোবাইলে সময় দেখে
ইফতি।
অহনা বাসা থেকে বের হবার পর থেকে তেমন কোন কথা হয়নি ওদের ভিতর। মোটামুটি ইশারা-
ইংগিতেই চলেছে এতক্ষণ, যেমন রিকশায় উঠা, রিকশা থেকে নামা এইসব। অহনা একটা হলুদ শাড়ি
পরে আছে। হাতে মেহেদীও আছে মনে হচ্ছে। মনে হয় ওর গায়েহলুদ হয়ে গেছে। আচ্ছা, ও এত শুকিয়ে
গেছে কেন? চেহারার মায়া মায়া ভাবটা কি আরও বেড়ে গেছে, নাকি সব ইফতির মনের ভুল?
- একটা ট্যাক্সি ডেকে দিবি?
একটু চমকে উঠে ইফতি, এই প্রথম কথা বলে অহনা। গলাটা ভেজা, মনে হয় বাড়ীর জন্য মন খারাপ
লাগছে। মনে মনে বিদ্রুপ করে ইফতি, পালানোর আগে মনে ছিলনা? এখন ঢং হচ্ছে। কিন্তু ওকে
কিছু বুঝতে দেয়না, বলে
- দাড়া দেখছি, বলে সামনে একটু এগিয়ে আবার ফিরে আসে। বলে-
- ট্যাক্সিকে কোন জায়গার কথা বলবো?
- কিছু বলতে হবে না তোর, ভাড়া যা চায় দিয়ে দেব, আমি টাকা নিয়া এসেছি। তুই শুধু একটা
ট্যাক্সি এইখানে নিয়ে আয়।
- ও,কে, - বলে একটু এগিয়ে যায় ইফতি
দেরি হয়না ট্যাক্সি পেতে, কয়েকটার সাথে কথা বলে একটা নিয়ে আসে ও। ট্যাক্সি ড্রাইভার আর
ইফতি মিলে সুটকেসটা আগে উঠায়। এবার বিদায়ের পালা, ইফতি আশা করে, ঠিক আশা না, একটু
টেনশণ কাজ করে ওর ভিতর, এত রাতে এই পাগলী কই যাচ্ছে কে জানে, যেতে বললে নিশ্চয়ই
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
পৌঁছে দিয়ে আসবে ইফতি, মনস্থির করে ও। এমন কিছু ঘটে না। অহনা আস্তে করে উঠে পরে
ট্যাক্সিতে। মৃদুস্বরে বলে-
- বেশিক্ষন বাইরে থাকিস না, বাসায় চলে যা।
ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলে
- ভাই চলেন।
ট্যাক্সি ড্রাইভার ক্ষাণিক দ্বিধা করে, ইফতির দিকে একবার তাকিয়ে আস্তে আস্তে চলতে শুরু
করে।
পিছন থেকে অপলক থাকিয়ে থাকে ইফতি। এয়ারপোর্ট রোডের বিস্তীর্ণ রাস্তায় ট্যাক্সির
সামান্য আলো হারিয়া যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। আরও একটু সময় থাকে অহনার চুলের মিষ্টি
গন্ধ, হাসে ইফতি, আবারও মনের ভুল।
খানিক পরেই বাস্তবে ফিরে আসে অল্প বয়সী বাস কনডাকটারের চিৎকারে।
- শাবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, সদরঘাট। মামা যাইবেন? লাস্ট টিপ কইলাম, ওই মহাখালি, শাবাগ,
পল্টন, গুলিস্তান, সদরঘাট
কাল শুক্রবার, শাহাবাগ শুনে হঠাৎই মনে হয় ইফতির। ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে। গত কয়টা
দিন, বিশেষ করে এই শেষ কয়টা ঘণ্টা “অহনা” টেনশনে আর কিছুই মনে নেই। “এখন আমি পুরাই
পাংখা”, কোন এক পুরান বন্ধুর ডায়লগটা বলে আস্তে করে, “নো অহনা, নো বাসনা, দিস কেস
ইস ক্লোসড”। আবার হাসে মনে মনে - আচ্ছা রাতের আর আছেই বা কতক্ষন, ভার্সিটি
এরিয়াতেই যাওয়া যাক, কালকে বন্ধ - টি,এস,সি-র কামাল মামার ২৪/৭ মালাই চায়ের দোকানে
কোন না কোন বন্ধুকে ঠিকই পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, আমি যাচ্ছি আমার
মত।
ইফতি উঠতেই বাসটা চলতে শুরু করে - মধ্যরাতের নীরবতার সাথে সাথে ইফতির হৃদয়ের নীরবতাকেও
যেন ব্যাঙ্গ করে চলে অবিরাম।
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
(৩) পাঁচ বছর পরের কথা। আস্তে আস্তে বাসার সদর দরজায় টোকা পড়ছে। দরজাটা খুলতেই
খুব সতর্কতার সাথে বাসায় ঢুকল ইফতি।
- এত দেরি করলি কেন বাবা?
- কি করবো মা, কাজের চাপে ভুলে গিয়াছিলাম। যখন মনে পরল তখন আর কিছুই করার ছিলনা।
ওরা কি ঘুমায় পরসে মা?
- বউমা কি করবে, দুধের বাচ্চা নিয়ে কতোক্ষণ জেগে থাকা যায়? তাছাড়া অর্ক-র স্কুল আছেনা
সকালে।
- ঠিক আছে মা, তুমি যাও, শুয়ে পর। আমি খেয়ে শুয়ে পড়ব, যাও, তুমি ঘূমাও গিয়ে।
- তুই একা খাবি?
- কিছু হবেনা মা, আমি পারবো, তুমি যাও।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যান মা, আস্তে আস্তে পা টিপে বেডরুমে ঢুকে ইফতি। ছয় মাসের ঐশী তার
মায়ের হাতে মাথা রেখেই ঘূমায়ে পড়েছে, আর মায়ের গায়ের উপর এক পা উঠিয়ে অঘোরে ঘূমাচ্ছে
ইফতির চার বছরের ছেলে অর্ক-পৃথিবীর পবিত্রতম দৃশ্যগুলোর একটি, চোখে ভিজে আসে ইফতির,
আস্তে আস্তে বিছানার দিকে এগোয় ও। আলতো করে চুমু খায় ঐশীর তুলতুলে গালে, গভীর
মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় অর্কের চুলে। উঠে যাবার আগ মুহূর্তে কি ভেবে একটূ হাত বুলায় ওদের
মায়ের কপালেও।
তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে, ব্রিফকেস থেকে কাগজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কয়েকটা লাল
গোলাপ বের করে ওয়াডরোবের উপর রাখে, আজ ছিল ওদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী। কথা ছিল
সবাইকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবে, কিন্তু হলনা। অবশ্য বউ কিছুই বলেনি ওকে। নাহ, বউটা আসলেই
নির্জনে নিরন্তর (২ এপ্রিল ২০১৫) - কথার দোকানদার
লক্ষ্মী, কালকে সব ম্যানেজ করতে হবে। ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দিকে এগোয় ইফতি, একেবারেই
শুনতে পায়না, “আমার গাধা”-বলে বালিশে চোখ মোছে অহনা, এতো সুখ কোথায় রাখবে ও।
(৪) গল্পটি একটু আগেই শেষ হয়েছে। নিচের অংশটি শুধুমাত্র কৌতুহলী পাঠকের জন্য দেওয়া হল।
সেদিন রাতে অহনা ইফতিদের বাড়ীতেই গিয়েছিল। পাড়ার কয়েকজন মুরুব্বী আর ইফতির মায়ের সামনে
দাড়িয়ে বলেছিল, ওর এখানে আসার ব্যাপারে ইফতি কিছুই জানে না, কিন্তু ইফতিকে জীবনের ছেয়েও
বেশী ভালবাসে ও। মা যদি ওকে মেনে না নেন, তাহলে এখনই কোথাও চলে যাবে, ইফতি জানতেও
পারবেনা। মানা করতে পারেন নি মা। টি,এস,সি যাওয়া হয়নি ইফতিরও, মায়ের ফোনে তখনই বাসায়
ফিরতে হয়। মায়ের অনেক অনুরোধের পরেও অহনাদের বাসা থেকে কেউ আসেনি, বিয়ের রাতে কনে
পালিয়ে যাওয়ায় ওদের অনেক কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল বরপক্ষকে। পরদিন শুক্রবার রাত সাড়ে
আটটায় ওদের বিয়ে হয়ে যায়। কাজী সাহেব যখন মুনাজাত করছিলেন, ইফতির মনে হচ্ছিল ভোকাল
কর্ডটা বোধহয় একেবারেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
লিখেছেন: কথার দোকানদার
২ এপ্রিল ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিপিএস/