ব্ল্যাটার ও শ্রীনিবাসন: মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই
কাওসার মুজিব অপূর্ব : ২৯ মে, ২০১৫। ফিফার দুর্নীতির পাদদেশে দাঁড়ানো সেপ ব্ল্যাটার। এর মধ্যেও ফিফা কংগ্রেসে সেপ ব্ল্যাটার ঘোষণা করে দিলেন – ‘যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আলাদা করে খেয়াল করা সম্ভব নয়। যারা খারাপ কাজ করে তাদের নিজেদেরই উচিৎ এটা লুকিয়ে রাখা।’ অর্থাৎ, অভিযোগের দায়িত্ব নিতে সাফ অস্বীকৃতি জানিয়ে দিলেন ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সভাপতি।
১৫ নভেম্বর, ২০১৪। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুবেষ্টিত হয়ে বিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসনের বিপক্ষে রায় দিলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিতে জড়িত তিনি নিজেও। তবে, রায়ের টিক পরপরই আইসিসির সভাপতি বলে দিলেন, ‘মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট আমার বিরুদ্ধে কিছুই বলেনি। আর আমার মনে হয় আমার বিপক্ষে যায় এমন কোন তথ্য-প্রমানও তাদের বিপক্ষে নেই। যদি থাকতো, তাহলে রায়টা ভিন্ন রকম হতো।’ – অর্থাৎ, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানও অভিযোগের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।
কি বোঝা গেল? খেলাধুলায় বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দুই ব্যক্তিত্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিন্তু আদতে একই রকম। প্রচণ্ড বিদ্বেষের মুখে তারা যেন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চতুরতা দিয়ে নিজেদের কুকর্মকে পর্দা দিয়ে ঢাকার সাথে সাথে বাকি কর্মকর্তাদের নিজেদের পক্ষে আনতে দু’জনই সমান পারদর্শী।
তাদের ব্যাপারে সবচেয়ে মোক্ষম কথা বলেছে ইন্ডিয়া টাইমস। বলেছে, ব্ল্যাটার আর শ্রীনিবাসনের জন্ম ভিন্ন মায়ের পেটে হলেও তাদের বাবা একই মানুষ। তাইতো তাদের এতো মিল। আমি বরং বলি তারা, মেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই।
গত শুক্রবারের নির্বাচনের দু’দিন আগে ফিফায় তোলপাড় হল। সু্ইস পুলিশ ছয় কি সাত জন ফিফা কর্মকর্তাকে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার করলো। ব্ল্যাটার তাতে থোড়াই কেয়ার করলেন; আর যথারীতি ফিফার সর্বোচ্চ পদে আবারও নির্বাচিত হয়ে গেলেন।
আর শ্রীনিবাসনের প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া সিমেন্টের মালিকানায় থাকা চেন্নাই সুপার কিংসের টিম ডক্টর গুরুনাথ মুয়াপ্পানের বিপক্ষে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেল। অথচ, তাতে একটা চুলও ছেড়া গেল না শ্রীনিবাসনের। তার উপর গুরুনাথ তার মেয়ের জামাই। তারপরও তিনি কিছু জানেন না! একই ভাবে, ব্ল্যাটারও জানতেন না তার ঘনিষ্ট সহকর্মীরা তারই চালানো সংস্থাকে নিয়ে কি দুর্নীতি করে বেড়াচ্ছেন।
বিসিসিআই থেকে তাকে এক রকম বহিস্কৃতই করা হল। তারপরও তিনি আইসিসির চেয়ারম্যান। টিকে থাকার জন্য তিনি ‘বিগ-থ্রি’ ধারণার বিকাশ ঘটিয়ে চলেছেন প্রতি নিয়ত। বিসিসিআইয়ে থাকতেও নানা ভাবে রাজ্য ক্রিকেট সংস্থাকে নানারকম বেআইনী সুবিধা দিয়ে এসেছেন শ্রীনিবাসন। একই ভাবে ফিফাতে বেঁচে থাকার চেষ্টাটা ব্ল্যাটারকেও করে যেতে হচ্ছে।
ব্ল্যাটারের অধীনেই, এশিয়া, আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) ও আফ্রিকার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলো উপকৃত হচ্ছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৪ অবধি অনুষ্ঠিত পাঁচটা বিশ্বকাপের মধ্যে তিনটেই হল এশিয়ার বাইরে। এতো উপকার যে, করে সেই ‘প্রভু’ কে ভোট না দেয়ার সাধ্য কারই বা আছে বলুন!
প্রমানটা যদি দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে করতে হয়, তাহলে এটা সত্য যে কারও বিপক্ষেই শক্ত কোন প্রমান দাঁড় করানো যাবে না। কারণ, কেউই সরাসরি কোন ‘বাজে’ কাজে জড়িত ছিলেন না; অন্তত সেটা প্রকাশ্য নয়। সেজন্যই এখনও টিকে আছেন ব্ল্যাটার; আর বিসিসিআই থেকে শ্রীনিবাসনকে সরাতে রীতিমত আদালতকে হাজির হতে হয়েছিল।
তাদের মধ্যে মিলের লিস্ট এখানেই শেষ নয়। শ্রীনিবাসন সমকামী পুত্রকে কোন এক মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টার কমতি করছেন না। আবার, ব্ল্যাটারও নিজের মেয়ের লিমোজিনের বিল দিতে দিতে পাগল হযে যাচ্ছেন।
কাজের ক্ষেত্র তাদের আলাদা করছে ঠিকই; কিন্তু কাজের ধরণে তারা একই রকম। শ্রীনিবাসন হয়তো বেশ কয়েকবার কলঙ্কিত হয়েছেন; কিন্তু ব্ল্যাটার এখনও সেই দুর্দিন দেখেননি। সে যাই হোক না কেন, দিনের পর দিন তারা ধ্বংস করে চলেছেন ক্রীড়াবিশ্বকে।
এবার প্রশ্ন হল, হেরে যাওয়া যুদ্ধে আর কদিন এভাবে লড়াই করে যেতে পারবেন দুই ভাই?
৪জুন, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন