কাজী জহিরুল ইসলাম, নিউ ইয়র্ক থেকে : কাজ শেষে ঘরে ফিরে মোবাইলটা মিউট করে রাখি। খুব প্রিয় কেউ না হলে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না । প্রায়শই দেখি পরদিন দুপুর অব্দি ফোনটি নীরবই আছে। সরব করতে ভুলে গেছি। আজও একই অবস্থা। শনিবার সকাল। নাস্তা খাবো, চা খাবো, ফেইস বুকিং করবো কিছুক্ষণ। একটা রিল্যাক্স মুডে আছি। ঘুম থেকে উঠেছি, মেয়ের সঙ্গে খুনসুটি করছি। এখনো মুখ ধুইনি, নাস্তা খাইনি । হঠাৎ এস ফাইভের স্ক্রিনে চোখ পড়ে। দেখি নিঃশব্দে পড়ে থাকা ফোনটির স্ক্রিনে আলো-ছায়ার খেলা চলছে। ওখানে লেখা, লুলা । লুলা আমার সহকর্মী । বাড়ি ইকুয়েডর। ছুটির দিনে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে অফিসের কারো নাম? বিরক্তি ব্রহ্মতালুতে। মানুষকে অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক কিছু করতে হয়। আমি ফোন তুললাম। ‘কাজী, এক্ষুণি আমার বাসায় চলে এসো, খুব জরুরী। বলেই সে ফোন কেটে দিল। বিষয় কি?
ছুটির দিন সকালে লুলার এইরকম একটি কলে আমি বিরক্ত হয়েছি বটে কিন্তু কী এক অচেনা রহস্য আমাকে দ্রুত অস্থির করে তুলছে। বলা চলে একরকম স্যান্ডির গতিতেই আমি এক লাফে মেয়ের ঘর থেকে বের হয়ে বাঁ হাতে গাড়ির চাবি আর ডান হাতে জ্যাকেটটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে গাড়িতে গিয়ে উঠি। বেশ কিছু রাস্তার বাঁক ঘুরে, দুটি হাইওয়ে পার হয়ে, আবারো কিছুটা লোকাল রাস্তা এবং বার তিনেক লাল বাতির অনুশাসন মেনে লুলার লং আইল্যান্ডের বাসায় এসে পৌছাতে প্রায় ৩০ মিনিট লেগে গেলো।
ডোর বেল টিপতে হয় নি। লুলা দরোজা খুলে আমাকে একটা হ্যাঁচকা টানে ভেতরে ঢোকালো। তারপর লিভিং রুম, ডায়নিং স্পেস পেরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেলো সোজা বেড রুমে। আমি বেশ ঘাবড়ে যাই ওর কান্ড দেখে। হয়েছে কি বলবেতো?’ ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ঠোঁটে আঙুল চাপা দেয়। ইশারায় আমাকে জানালায় চোখ রাখতে বলে নিজে একটি চামড়ার মোড়ার ওপর বসে পড়ে।
আমি বন্ধ জানালার কাচের ওপর চোখ রেখে দেখি পাশের বাড়ির এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, মুখ শীতে শুকিয়ে যাওয়া আমের মতো, লোকটিকে ঘিরে আছে তিনজন পুলিশ। হয়ত লোকটির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, এতো দূর থেকে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না । একজন মহিলা পুলিশ লোকটির সাথে কথা বলতে বলতে কিছু একটা নোট করছে, অন্য দুজন পুলিশ দুটি ফুটফুটে শিশুর হাত ধরে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের দলটি বাচ্চা দুটিকে নিয়ে চলে গেলো। লোকটি আগের চেয়েও অধিক শুকনো মুখ করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো।
এবার আমি ঘুরে বসি। তাকিয়ে আছি লুলার মুখের দিকে। আমার চোখে হাজারো প্রশ্ন। সেই সব প্রশ্ন খুব ভালোভাবেই পড়তে পারছে লুলা। ওর নীল চোখ দুটিতে দুষ্টুমির হাসির সাথে মিশে আছে খানিকটা আত্মবিশ্বাস। যেন ও বলতে চাইছে, আমি জানতাম। তোমাকে একদিন বলেছিলাম না, মেয়েটা পালাবে? আবছা আবছা কিছুটা মনে করতে পারি। লুলা অন্তত বার দুয়েক আমাকে ওর এক প্রতিবেশীর গল্প বলেছিল। দুটি অটিস্টিক শিশুর মা । বাচ্চাদের নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত মেয়েটি। শেষ-মেষ পালালো?’ আমার এ প্রশ্নের উত্তরে লুলা দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেয়, ‘তা ছাড়া আর কি?
লুলার প্রতিবেশী এই শ্বেতাঙ্গ দম্পতির দুটি সন্তান, এক ছেলে এক মেয়ে, দুজনই অটিস্টিক বাচ্চা। মেয়েটি ওর নিজের জীবন নিয়ে খুব হতাশ ছিল। বাস্তববাদী এবং ভোগবাদী পশ্চিমা নারী। জীবনতো একটাই। এই জীবন এভাবে নষ্ট করা যাবে না । তাই রাতের অন্ধকারে জীবনের এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে পালিয়ে গেছে।
লেখক : কাজী জহিরুল ইসলাম, নিউইর্য়াক
২১ মার্চ, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে