রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৪৫:৩৩

শেষের পরে যে শুরু..

শেষের পরে যে শুরু..

পাঠকই লেখক : বাসার পাশের কফিশপটাতে প্রায় বিশমিনিট হলো বসে আছি আমি।অপেক্ষা কোন এক আগন্তুকের, অবশ্য ঠিক অপেক্ষা বলা চলেনা কারন আমি নিজেই মনে প্রানে চাইছি যাতে কেউ না আসে। নিতান্তই মায়ের জোরাজুরি আর খানিকটা কৌতুহলবশত ছেলেটার সাথে দেখা করতে এসেছি আমি।

আর ১৫-২০মিনিট কোনমতে পার করে মার মাথা থেকে বিয়ে নামক ভূতটা চিরতরে বিদায় করা যাবে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম যদিও ভালো করেই
করেই জানি এই খানিকটা সময় পার করাও আমার জন্য কতটা কঠিন হবে।ওই দিনগুলোর পর থেকে আমি সবসময়ই চেষ্টা করি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে কারন মুহুর্তের অবসরে সেই ভয়ংকর স্মৃতিগুলো আমাকে এমনভাবে জাপটে ধরে যে নিমিষেই আমার জগৎটা আলোহীন হয়ে পড়ে।
অথচ মাত্র বছর দুয়েক আগেও আর আট দশটা সাধারন মেয়ের মতোই ছিলাম আমি,নির্মম নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন সংগ্রামেও মা বাবা আর ছোট্ট ভাইটিকে নিয়ে সুখী থাকার প্রানপন চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।

বাবা সরকারী অফিসের কেরানী,ছোট ভাইটা সবে ক্লাস সেভেনে তাইতো আমাদের দুভাইবোনকে নিয়ে বাবা মার যে যুদ্ধ তা আমার চেয়ে ভালো কে বা জানে।
ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্মী মেয়ের মত বাবার সীমাবদ্ধতাগুলো ভালোমতেই বুঝে এসেছি আর তাই চাপা কষ্ট মনে রেখে নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতাম সবসময়।

এসএসসিতে ভালো রেজাল্টের পর কলেজে বেতন ছাড়া পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই।খবরটা পরম স্বস্তি এনে দেয় মনে কারন তার আগেরদিনই কলেজে ভর্তির টাকার কথা শুনে বাবার চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই এই ভেবে যে আদৌ কলেজে পড়া হবে কিনা আমার।পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করবো হয়তো শিক্ষকতা এটা ভাবতেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করত।এরকমই ছোট্ট এক টুকরো স্বপ্ন বুকে ধরে এগিয়ে যায় আমার কলেজজীবন।

এইচএসসির রেজাল্টের দিন কলেজে গিয়ে দেখি আমি সেকেন্ড।প্রচন্ড খুশির খবরটা মা বাবাকে জানাতে আমি উড়তে উড়তে বাসার দিকে ছুটলাম।
আমার প্রতিটা রেজাল্ট শুনে মা বাবার চোখ যেভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তা অবর্ননীয় যদিও ঠিক এর পরপরই তাদের চেহারায় যে বিষাদের ছায়া পড়ে তাও চোখ এড়ায়না আমার।

এ বিষাদ অপারগতার এ বিষাদ অনিশ্চয়তার যদিও আমি বিশ্বাস করতাম আমাদের এইদিন একসময় থাকবেনা,সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমি মা বাবার হাসির কারন হবো যে হাসি মলিন হবেনা কোন অজানা আশঙ্কায়।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাসিমুখে বাসায় ঢুকলাম আর দেখলাম বাসায় বড়চাচা।

মুহুর্তের মধ্যে হাসি মুছে গেল আমার।বড়চাচা বাবার আপন বড়ভাই।ভীষন চালাক আর ধুরন্দর। কিসের জানি ব্যবসা করে কিছুদিনের মধ্যেই বিশাল টাকাপয়সার মালিক হয়ে গেছেন তিনি।খুব কৌশলে কখন যে তিনি দাদার সম্পত্তির প্রায় পুরোটাই নিজের করে নিয়েছেন আমার সহজসরল বাবা সেটা টের পর্যন্ত পাননি। সেই থেকে আমাদের একরকম এড়িয়েই চলেন তিনি হয়তো কাউকে আমাদের পরিচয় দিতে লজ্জা পান।তারপরও যদি কখনো দেখা হয়ে যায় এক সেকেন্ডও নষ্ট করেননা আমাদের তিরস্কার করতে কিংবা নিচু দেখাতে।সেই চাচা আজ আমাদের বাসায় তাও আবার বাবা মার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন ব্যাপারটা মোটেও সুবিধার মনে হলোনা আমার।

সামনের রুম এড়িয়ে তাই আমি সরাসরি ভেতরের রুমে চলে এলাম আর দুরুদুরু বুকে পর্দার ফাঁক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে। আর যখন আমি ব্যাপারটা ধরতে পারলাম আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।বড়চাচা আমার বিয়ের কথা বলছেন। সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে আর সব ঠিকঠাক থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে,আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখলাম।একবুক আশা নিয়ে আমি তখন মা বাবার দিকে তাকালাম আর কেউ না হোক অন্তত এই দুটো মানুষ তো জানে আমার স্বপ্নের কথা।আমার আশার প্রদীপ দপ করে নিভে গেল যখন দেখলাম বাবা চাচার কথায় হ্যাঁ মিলাচ্ছেন,মার চোখেও সম্মতির লক্ষন।

বাবা তার বড়ভাইয়ের অনেক অনুগত এটা আমার জানা কিন্তু তার কাছে যে তার মেয়ের স্বপ্ন এতটা মূল্যহীন তা আমার জানা ছিলনা।প্রচন্ড অভিমানে চোখ ঝাপসা হয়ে গেল আমার। হঠাৎ কি মনে করে পর্দা সরিয়ে আমি ভেতরে ঢুকলাম,এত সহজে সবকিছু শেষ হতে দেবনা আমি। মা বাবাকে পাশ কাটিয়ে চাচার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।
-তিথি,আয় মা।চাচার কন্ঠে মমতা ঝরে পড়ছে।
এতসুন্দর করে এর আগে চাচা আমাকে ডেকেছেন বলে মনে পড়েনা আমার।
-একটা কথা ছিল চাচা,সাহসী গলায় বললাম।

সাথে সাথে চাচার হাসি বন্ধ হয়ে গেল।সরু চোখে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও আমার কোন কথা থাকতে পারে তা তিনি ভাবেননি।
-চাচা,আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না।
চাচা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন।
-তো কি করবি!বাপের ঘাড়ে বসে বসে খাবি?

আমি ঘাবড়ালামনা।দৃঢ় কন্ঠে বললাম।
-আমি আগে পড়াশোনাটা শেষ করতে চাই।
-হেহ..ঠোট উল্টে আমার দিকে তিরস্কারের দৃষ্টি ছুড়লেন তিনি।তারপর কি হবি ডাক্তার নাকি..
-কি হবো জানিনা তবে সুযোগ পেলে কিছু একটা তো অবশ্যই হবো।
চাচা বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।এ রুপের সাথে তিনি পরিচিত নন। রাগে তার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেছে।বাবার দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললেন..

-দ্যাখ তোর বেয়াদপ মেয়ে কি বলে!মাস শেষে বাপ ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে আর মেয়ে কলেজে রংঢং করে বেড়ায়।
আমি আর স্থির থাকতে পারলামনা।চাচা আমাকে যা খুশি বলুক কিন্তু বাবা!
-চাচা আপনি মিথ্যা কেন বলছেন,আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।বাবা কখনো আপনার সামনে হাত পাতেনি বরং আপনিই...

আমি কথা শেষ করতে পারলামনা তার আগেই মা আমাকে টেনে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন।ঘরে ঢুকেই আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম কিন্তু মা আমাকে আস্তে করে ছাড়িয়ে দিয়ে খাটে বসালেন।মার চোখেমুখে অচেনা শীতলতা,আমি কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম।বাবাও পেছনে এসে দাড়িয়েছে।এরপর মা আমাকে যা বললো তা মুহুর্তে আমার পৃথিবী এলোমেলো করে দিল।

-জেদ করিসনা মা।তোর চাচা যা বলছেন তা তোর ভালোর জন্যই বলছেন।
-জেদ!এটা জেদ না মা,আমার সারাজীবনের স্বপ্ন।হাহাকার করে উঠলাম আমি।
-কিন্তু তোর বাবার অবস্থাতো তুই জানিসই তাছাড়া তোর ছোট ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো তোকেই ভাবতে হবে।
কিছু না বলে মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আমি।

-চিন্তা করিসনা।তোর চাচা নিজে ছেলের সাথে কথা বলেছেন।ছেলে খুব ভালো।বিয়ের পর পড়ার ব্যাপারে তার কোন আপত্তি নেই।আর অমত করিসনা মা।
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা।আমার সব আর্তনাদ চিৎকারগুলো গলার কাছে এসে আটকে গেল।অসহায় চোখে শুধু একবার বাবাকে দেখলাম,বাবা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলেন আর আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম।
সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে আসল,আমি বাধ্য মেয়ের মত শাড়ী গয়নাপাতি পরে ওদের সামনে উপস্থিত হলাম।

এতগুলো মানুষের সামনে নিজেকে আমার বাজারের পন্যের চেয়ে ভালো কিছু মনে হলোনা।প্রেম ভালোবাসা বিবর্জিত জীবন আমার,বন্ধুরা যখন তাদের ছেলেবন্ধুদের নিয়ে গল্পের আসর বসাত আমি তখন আঁতেল উপাধি নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছি। যদি ভুলে কখনো বিশেষ কারো কথা মনে হতো ভাবতাম এমন কেউ আসবে যে আমাকে বুঝবে ঠিক আমার মতো করে।

ছেলেপক্ষ আমাকে দেখে চলে গেল আর কেউ আমাকে একটিবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলনা আমার পছন্দ হয়েছে কিনা।সেদিন আমার সাথে কি হচ্ছিল তা বোঝার মত বোধও আমার মধ্যে অবশিষ্ট ছিলনা। অনুভূতিহীন নির্বাক কাঠের মূর্তির মত বসে ছিলাম শুধু।ছোট ভাইটা দুঃখী দুঃখী গলায় এসে বলল..
-মন খারাপ করোনা আপু,আমি যখন বড় হবো তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদলাম।

একসপ্তাহ পর ঠিক আমার ভার্সিটিতে ভর্তির দিন আমার বিয়ে হয়ে গেল।স্বামী নামক প্রানীটিকে সেদিনই প্রথম দেখলাম।তুচ্ছ একটা ঘটনা নিয়ে সে যখন তার ছোট ভাইকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল আমি তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।ওই বাড়িতে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার তখনি ধারনা করা উচিত ছিল কিন্তু বোকার মতো আমি মায়ের শেষ লাইনগুলো আঁকড়ে ধরে বসে ছিলাম।
একদিন নির্লজ্জের মতো বলেই বসলাম..

-আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাই।
কথাটা শুনে সে চোখমুখ বিকৃত করে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে বুঝতে পারছেনা আমি কি বলছি। সে দৃষ্টির সামনে নিজেকে আমার নর্দমার কীটের চেয়ে নিকৃষ্ট কিছু মনে হলো।
-এসব অর্থহীন প্রলাপ আমি যেন আর না শুনি।কটাক্ষের হাসি দিয়ে বলল সে।

শেষ আশাটুকু মুছে যাবার পরও আমি নিজেকে পুরোপুরি ভাঙ্গতে দিইনি।মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে মানুষটার সাথে একেকটা দিন পার করেছি যে কখনোই আমাকে চেনেনি,আমার মনউঠানে যে ভুল করেও একবার পা রাখেনি,যার কলোরবে আমার বসন্তরা কখনো প্রান খুজে পায়নি,যে আমার সত্তায় বারবার আঘাত করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। হয়তো এভাবেই চলে যেত,এভাবেই সব সয়ে যেতাম যদি সেদিনের সে ঘটনাটা না ঘটত।কি জানি কাজ করছিলাম। হঠাৎ সে আমার সামনে কি একটা কাগজ ধরে আমাকে সম্ভব অসম্ভব সব কুৎসিত আর নোংরা অপবাদ দিতে লাগল।ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যাই আমি। কি করব কিছু বুঝতে না পেরে কোনমতে কাগজটা হাতে নিলাম।খুলেই চমতে গেলাম আমি,সেই স্যরি নোট।

কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় একদিন রাস্তায় দেখি দুটো ছেলে একটা মেয়ে কে টিজ করছে। আমার ভীষন রাগ উঠে গেল কোন কিছু চিন্তা না করে আমি দুজনের মধ্যে লম্বা ছেলেটার গালে চড় মেরে বসলাম।।ছেলেটা গাল ধরে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষন।পরে জানতে পারলাম ওই ছেলেটা না বরং তার পাশের ছেলেটা মেয়েটাকে বিরক্ত করছিল আর এই ছেলেটা গিয়েছিল মেয়েটাকে সাহায্য করতে।

আমার মধ্যে প্রচন্ড অপরাধবোধ জন্ম নিল।তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন আমি ছেলেটাকে রাস্তায় খুজতাম আর না পেয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতাম।
এরকম কোন এক মন খারাপের দিনে নোট টা লেখা।চিঠিটা যে এখনো আমার ব্যাগে আমি এটা পর্যন্ত জানতামনা আর এই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আমার স্বামীরুপী মানুষটা আমার মাথায় যে অপবাদের যে বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল তা আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিল।তার চূড়ান্ত ভয়ংকর রুপ আমার কাছে স্পষ্ট হলো। আর আমি সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম,সবকিছু ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত।আমি একবারও ভাবলামনা আমার পরিনতি কি হবে,সমাজ আমাকে কিভাবে নেবে,বাবা মা আমাকে গ্রহন করবে কিনা শুধু তিনমাস বারদিনের সব গ্লানি আর অসম্মানকে পেছনে ফেলে আমি পা বাড়ালাম অনিশ্চিত অজানা পথে...
আমার মাথার ওপর আল্লাহর রহমতের শেষ ছায়াটুকু ছিল বলেই হয়তো সেদিন বাবা মা আমাকে ফেলে দেননি।

মেয়ের চোখের ক্লান্তি তারা ঠিকই ধরতে পেরছিলাম।তবে কেমন জানি হয়ে যাই আমি,কারো সাথে কথা বলতামনা চুপচাপ ঘরের দরজা আটকে বসে থাকতাম। মা নিরব কান্নায় মুখ লুকাতেন,বাবা সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করতেন,ছোট ভাইটা হাসতে ভুলে গিয়েছিল। আশেপাশের মানুষ কানাঘুষা করত,আমি খালি শুনতাম হয়তো আমাকেই দোষারোপ করত।এই সমাজ ছেলেদের দোষ দিতে জানেনা। দুদিন পরে বড়চাচা বাসায় আসলেন,আমার নাম ধরে চিল্লাচিল্লি শুরু করলেন।নিজের রুমে মূর্তির মত বসে থেকে আমি সবই শুনতে পেলাম। হঠাৎ কানে বাবার গলা ভেসে এল..
-আমার মেয়েকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবেননা।

আমি চমকে উঠে দৌড়ে সামনের রুমের দিকে গেলাম,বাবার গলার এই সুর আমি আগে কখনো শুনিনি।আমাকে দেখিয়ে বাবা দৃঢ়কন্ঠে বললেন..
-আমার মেয়ে যা করেছে ঠিকই করেছে।ওর জীবন নিয়ে ভাবার জন্য ওর বাবা আছে,আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে।
চাচা থমথমে মুখে আমাকে একবার দেখে রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।আমি ধীর পায়ে ছলছল চোখে বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।বাবা আমার হাত চেপে ধরে বললেন..
-আমাকে মাফ করে দিস,মা।

আমি বাবাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। বাবার শেষের ওই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল আমার জীবনের মোড় আবার ঘুরিয়ে দেবার জন্য।আমি ঠিক সে জায়গা থেকে আবার সব শুরু করলাম একদিন যেখানে সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ সম্বলটুকু দিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম সাথে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কে টিউশন দেওয়া।এভাবেই চলছে,জানিনা কতদূর যাবো শুধু জানি আর ভাঙ্গবনা।স্বপ্নগুলোকে কি এতটা দুর্বল ভাবা উচিত যে বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে?না,যতক্ষন প্রিয়মুখগুলো সাথে আছে ততক্ষন তো না ই...


আমি এখনো কফিশপটাতেই বসে আছি।সে ভয়াবহ স্মৃতিগুলো ভাববোনা ভাববোনা করেও ঠিকই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছি।ছেলেটা এখনো আসেনি।
ওর সাথে মায়ের পরিচয় ছোট ভাইয়ের স্কুলে,ওদের ক্লাসটিচার।তারপর থেকে মায়ের মুখে অনেকবারই শুনেছি ছেলেটা অনেক ভালো।

শুনে শুধু হেসেছি আমি,মানুষের ভালোমানুষী ইদানিং আমার কাছে হাস্যকর লাগে,বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেনা।মা হাল ছাড়েন না,মা তো!আমি সবই বুঝি শুধু না বোঝার ভান করি,সেই চেনা দ্বিধার পথে হাটতে ইচ্ছা করেনা আমার।হঠাৎই মায়ের কাছে শুনি ছেলেটা আমার সাথে দেখা করতে চায়।একরকম অপ্রত্যাশিতভাবেই মাকে সেদিন হ্যাঁ বলে দেই আমি শুধু এটা দেখার জন্য যে শ্বশুরবাড়ি পরিত্যক্তা একটা মেয়ের প্রতি এত আগ্রহ কেন তার?আমাকে করুনা দেখানোর কি এমন প্রয়োজন পড়ল ছেলেটার?

-স্যরি,আমি বোধহয় একটু দেরি করে ফেলেছি।
কারো আকস্মিক কথায় আমি বাস্তবে ফিরে এসে চমকে তাকালাম।আরে!এতো সেই ছেলে রাস্তায় যাকে আমি থাপ্পড় মেরেছিলাম।
-আপনি?
-আমি শুভ,চিনেছেন?সেদিন রাস্তায়..
আমি ছেলেটাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কঠিন স্বরে বললাম..
-তো সেদিনের প্রতিশোধ নিতেই কি এতদূর আসা?

-না না।তাড়াতাড়ি বলল ছেলেটা।আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।ওই দিন যে কাজটি আপনি না বুঝে করেছেন আমি তা জানি।
-তাহলে?আমি সন্দেহের চোখে তাকালাম।
-আমি আসলে বলছিলাম দুবছর আগে রাস্তায় এক ভদ্রমহিলা এ্যাকসিডেন্ট করেন যাকে আপনি ব্লাড দিয়েছিলেন,মনে আছে?
আমি স্মৃতি হাতড়াতে থাকলাম।আসলেই এমন ঘটনা ঘটেছিল।ভদ্রমহিলা রাস্তায় একা পড়েছিলেন,আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই ব্লাড দেই দুদিন পর বাসায় পৌছে দেই।

-আপনি ওনার..
-জ্বি,আমি ওনার ছেলে।
আমার মনে পড়ে যায় ছেলের কথা ওই দুদিনে তিনি অনেকবার বলেছিলাম।ছেলে চিন্তিত হয়ে যাবে বলে অসুস্থতার কথা ছেলেকে বলতে মানা করেন তিনি।
-আমি তখন অফিসের কাজে শহরের বাইরে।মায়ের কথা শুনে উড়ে চলে আসি।মা আমার সব,মাকে একা ছাড়লামনা।চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানকার স্কুলে চাকরি নিলাম।
-এখন কেমন আছেন উনি?

শুভ কেমন জানি উদাস হয়ে গেল।বছরখানেক আগে আমাকে একা করে উনি চলে গেছেন।গলার স্বর ভারী হয়ে গেল তার। আমার চোখও ঝাপসা হয়ে গেল।
-আপনার কথা মায়ের মুখেই শোনা।এত শুনেছি যে একসময় আমি আপনাকে আমার জীবনের আশীর্বাদ ভাবতে শুরু করি যে ম্যাজিকের মত মাকে ভালো করে দিয়েছিল।
আমি অবাক হয়ে ছেলেটার কথা শুনছি।এভাবে আমাকে কেউ কখনো বলেনি।
-মা মারা যাবার পর ভীষন একা হয়ে যাই আমি।সেদিন কেন জানি সবার আগে আপনার কথাই মনে হয়েছিল,বুঝতে পারলাম আপনাকে ছাড়া আমার চলবেনা।

আমার মনে হচ্ছিল আমি ঘোরের মধ্যে আছি।এ ধরনের কথা শোনার প্রস্তুতি নিয়ে আমি আসিনি।
-পাগলের মত তারপর আপনাকে খোজা শুরু করলাম যখন পেলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল ও।ছেলেটাকে যেন বলার নেশায় পেয়েছে।
আমাকে যেন সবকিছু আজই বলে দিতে চায়।
-আপনার দুর্ঘটনাটার কথা আপনার মায়ের মুখে শুনেছি।চাইলে সেদিনই সামনে দাড়াতে পারতাম কিন্তু যদি আপনি মনে করেন আপনাকে করুনা করছি কিংবা দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি এজন্যে বলিনি।

আমি টের পেলাম আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে।আমার জন্যও যে কেউ এক পৃথিবী সাজিয়ে বসে থাকতে পারে তা আমার কল্পনাকেও হার মানায়।
আমি ঠোট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম।ছেলেটার সামনে কিছুতেই কাঁদা যাবেনা।
-তিথি।নরম কন্ঠে শুভ বলল।নিজেকে কখনো একা ভাববেননা।মনে রাখবেন এখনো এমন একজন আছে যার পৃথিবী আপনাকে ঘিরে আবর্তিত হয়,যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে আপনারই ডাকের প্রতিক্ষায়..

আমি আর পারলামনা।টপটপ করে আমার দুচোখে বৃষ্টি নামল..
শুভ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সে দৃষ্টিতে অদ্ভুত মায়া আর দ্বিধা মেশানো।আমার কান্নার কারন মনে হয় ও ধরতে পারছেনা।
অজান্তে আমার হাত চলে গেল ব্যাগে আর হাতে লাগল কিছু একটা।সেই স্যরি নোট!হয়তো ভয়ংকর আনন্দের এই দিনটির জন্যই আমি এতদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি ছোট্ট এই কাগজের টুকরোটাকে..


[গল্পটা সেসব অতিথিদের জন্য যারা পথ হারায় না,সাময়িক বাধা বিপত্তিতে তারা বিভ্রান্ত হলেও তারা ঠিকই পথ খুঁজে নেয়।
গল্পটা সেসব শুভদের জন্য যারা তিথিদের পথ হারাতে দেয়না,আগলে রাখে সবসময় নিবিড় ভালোবাসায়]

লেখক : সায়মা মাহমুদা রিমি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে