পাঠকই লেখক ডেস্ক :
জাহিদ,
অবাক হচ্ছেন নিশ্চয় আপনাকে নাম ধরে ডাকছি বলে? আপনাকে 'ভাই' সম্বোধনের ইচ্ছে নেই আমার অনেকদিন থেকেই। আপনি করে ডাকারও ইচ্ছে নেই। কি ভাবছেন? মেয়েটা এতো আবোলতাবোল বকছে কেনো হঠাৎ? বকতাম না, সত্যি!
.
আপনার মনে আছে, আট বছর আগে যেদিন আমাদের বাসায় উঠেছিলেন আপনারা? জানি মনে নেই, যা ভুলোমন আপনার! আপনারা যখন আমাদের বাসার তিনতলায় উঠলেন, ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমি। সিড়িতে দাড়িয়ে ছিলাম। আপনি একটা ভারী কার্টন তুলছিলেন হাফাতে হাফাতে। আমাকে দেখে চশমাটা হাতে নিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, "ভীষণ বিপদে আছি, একটু সাহায্য করবেন?" আমি বাচ্চা একটা মেয়ে, কিন্তু আপনি এমনভাবে বললেন, যেন আমি কত্ত বড়! খুব মজা লেগেছিল, অবাকও হয়েছিলাম একটু। আপনার বইয়ের বাক্সগুলো আপনাকেই তুলতে হবে, এমনি কড়া নির্দেশ ছিলো চাচির! দুইজনে মিলে ঐ ভারী বাক্সগুলো তুলতে কি নাজেহাল হয়েছিলাম সেদিন!
.
বইপড়ার অভ্যাস ছিল না আমার, আপনি করে দিলেন। ঝুম বর্ষার এক দুপুরে বাসার ছাদে নাচানাচি করে ভিজছিলাম, আপনি কখন ছাদে এলেন টের পাই নিই। ততদিন আপনি জেনে গেছেন আমি ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক নগন্য বালিকা, আমাকে অতোটা সম্মান দেখিয়ে আপনি না ডাকলেও চলে! বললেন, "তোমাকে দূর্গার মতো লাগছে।" আমি হাসতে হাসতে বললাম, "কেন? আমার কি তিনটা চোখ, নাকি দশটা হাত?" -না না! ওই দূর্গা না! 'পথের পাঁচালী'র দূর্গা!
-সেটা আবার কে?
- বই পড় না বোধহয় তুমি।
-নাহ। ভালো লাগে না আমার।
- এটা পড়ে দেখতে পারো, ভালো লাগার কথা।
আগ্রহ না, কৌতূহল হয়েছিলো। কি কঠিন ভাষা বইটার! তবুও কিছু কিছু জায়গায় নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি, কেঁদে ফেলেছি। বই ফেরত দিতে গিয়ে আটকে গেলাম আপনার কথার জালে। আপনি একা ছিলেন, কথা বলার মত মানুষ কম ছিল আপ্নার জগতে। আমাকে পেয়ে কথার ফুলঝুরি ছোটান আপনি। এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন আপনি !
.
বই আনানেয়া করতে থাকি আমি। সেই সাথে চলত আপনার সাথে গভীর জ্ঞানের আলোচনা। সহজ একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আমাদের, বন্ধুত্ব বলতে পারেন। একদিন না গেলেই বাসার কলিং বেল বাজাতেন, মাকে কাঁচুমাঁচু মুখে বলতেন, ইয়ে, পিউ কি অসুস্থ নাকি? বাসায় আসছে না কয়েকদিন হল! দিনগুলো ভালই কাটছিল আমাদের, সেই দিনটির আগ পর্যন্ত। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় আপনার মুখে শুনি মিলি আপার কথা।
.
মিলি আপা, যার চুলগুলো জলতরঙ্গের মতো, যে কি না কিন্নর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, আর যে কথা বললে আপনার কানে শত শত কাচের চুড়ি ভেঙ্গে পড়ে। যে কিনা লাইব্রেরীতে আপনার চশমা খুলে নিয়ে বলেছিলেন, দেখি তো আমায় চিন্তে পারো কিনা! অবাক হয়ে যখন জানতে চেয়েছিলেন তাকে চেনার কি দরকার? সে জানিয়েছিল, সারাটি জীবন সা আপনার হাত ধরে হাটতে চায়। হ্যাঁ, এটা আহ্বান ছিল, ভালবাসার আহ্বান। চিন্তিত মুখে আমাকে বললেন, কি করা যায় বলতো? হ্যাঁ বলে দেব?
বুকের ভিতর্টাতে কোথায় যেন জ্বালা হচ্ছিল। গলার কাছে জমাট বেঁধে আসছিল কান্নার মতো কষ্ট। আমি কিন্তু কাঁদি নি সেদিন, হি হি করে হেসে বলেছিলাম, বলে দেন হ্যাঁ। এতো সুন্দর মেয়েকে না বলাটা অপমানজনক। আর ভিতরে আমার আমিটা চীৎকার করে বলছিল, না না না! অভিমানও হচ্ছিল নিজের উপর, জলতরঙ্গের মতো চুল নেই বলে, কিন্নরী কণ্ঠ নেই বলে। আরও বেশি রাগ হচ্ছিল আপনার উপর।
.
জাহিদ ভাই, সেই রাতে খুব কেঁদেছিলাম আমি, আপনি তখন সদ্য প্রেমে পড়ার আনন্দে বিভোর। একরাশ অভিমান নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, "বিধি ডাগর আঁখি যবে দিয়েছিলে, মোর পানে কেনো পড়িল না?" আপনি কমেন্টও করেছিলেন, "তোমার পানে যদি না পড়ে, তবে সে আঁখিতে দৃষ্টি নেই।" কষ্টের মাঝেও হাসি পেয়েছিল খুব, এতো বোকা কেন আপনি? আমাকে খুব জেরা করেছিলেন অবশ্য, ছেলেটা কে? কিছু বলি নি আমি। কিভাবে বলি যে ঐ অন্ধ আপনি নিজেই।
.
আপনার আর মিলি আপার সব গল্প আমার জানা। কীভাবে রিক্সায় চড়ে দুপুর রোদে ঘুরে বেড়ান, কীভাবে আড্ডার ফাঁকে আলতো করে টেনে দেন ঐ চুল, কীভাবে মিলি আপা আইস ক্রীম নিয়ে আসে আপনার জন্য, অর্ধগলিত আইসক্রিম খেতে খেতে কিভাবে ভবিষ্যতের কল্পনায় হারিয়ে যান, সব।কথাগুলো বলার সময় আপনার চোখে খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠতো। আর গল্পগুলো মনে করে রোজ রাতে কেঁদে বালিশ ভেজাতাম আমি। একা হয়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ করে, একেবারেই একা।
.
খুব কাছের বন্ধু ছিলো না আমার, যাকে বলে 'প্রাণের বন্ধু'. কারো সাথে মিশতে পারতাম না তো! আপনার সাথে মিশেছিলাম, সেও আপনারই কারণে। আপনি ব্যাস্ত ছিলেন মিলি আপাকে নিয়ে, আর আমার সাথী ছিলো আমার একাকীত্ব। আপনার জীবনে তখন পূর্ণচন্দ্রের মতো ঝলমলে রূপোলি আলো ঝরাচ্ছে মিলি আপা। আর আমার ছিলেন একরাশ আধারে মিটি মিটি জোনাকির মতো আপনি। কিন্তু কই? আমার তো নন, মিলি আপার।
.
নয় মাস আগের এক সন্ধ্যার কথা মনে পরে আপনার? মিলি আপার বিয়ে ছিল সেদিন। ছাদে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন আপনি, আমি পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম পাশে। মিলি আপার বাবা অনার্স পাশ বেকার ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হন নি, আর মিলি আপার কিছু করার ছিল না। আপনি তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতেন না, আর তিনি পারতেন না বিয়েটা থামাতে। মিলি আপা স্বামীর সাথে কানাডাতে সুখেই আছে। মিলি আপার বিয়ের দুই মাস পরেই চাকরি হয় আপনার। সেই সন্ধ্যাটাও কেঁদেছিলেন আপনি, কিছু করতে পারেন নি বলে, ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করতে পারেন নি বলে। ভেবেছিলাম, মিলি আপা আপনাকে ছেড়ে চলে গেলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না। বাস্তবে দেখা গেল আমার ধারনা ভুল। হবেই না বা কেন? আপনার কষ্টগুলো যে আমারও কষ্ট হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আপনাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিন, কিন্তু কাঁদি নি আমি। মূর্তির মত বসেছিলাম আপনার পাশে।
.
নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর সব বাবাই মেয়ের বিয়ের জন্যে উঠেপড়ে লাগে, যেমন লেগেছেন আমার বাবা। আগামীকাল বিকেলে আমাকে দেখতে আসবে ওরা, ছেলে ডাক্তার।
.
আপনি রোজ ঠিক সাড়ে ছটায় বাসায় ফিরেন। এই চিঠিটা পেয়ে পড়তে আপনার সময় নেবে পনের মিনিট। ভাবতে আরও পনের মিনিট দিচ্ছি। সাতটা থেকে ছাদে থাকব আমি, দশটা পর্যন্ত। এর মধ্যে আপনার যদি ছাদে আসতে ইচ্ছে হয়, আসবেন। কিছু বলার প্রয়োজন মনে হলে বলতে পারেন। আর যদি দরকারি মনে না হয়, নাও আসতে পারেন। কোনদিন জোর খাটাই নি, আজ কি অধিকারে খাটাবো? দশটার মধ্যে যদি আপনি ছাদে আসেন, আসবেন। আর দশটা বেজে গেলে... না, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বো না। সুইসাইড করার ইচ্ছা থাকলে যেদিন মিলি আপার কথা বলেছিলেন, সেদিনই করতাম। সেদিন যখন করি নি, আজও করবো না। লক্ষ্মী মেয়ের মত বাবা যে ছেলেটাকে ধরে এনেছে তার গলায় ঝুলে পড়বো।
.
আপনাকে একটা কথা বলার আছে, যেটা বুঝতে পেরেছিলাম সেইদিন, যেদিন আপনার মুখে মিলি আপার কথা প্রথম শুনি। যদি ছাদে আসেন, কথাটা বলবো।
পিউ
দীর্ঘ চিঠিটা এইমাত্র পড়ে শেষ করেছে জাহিদ। এতদিন পাশে আছে, তবুও মেয়েটার আবেগ বুঝতে পারে নি, ভেবে বিস্মিত হয়। সত্যিই মেয়েটা খুব চাপা। কিভাবে নিজের কষ্ট লুকিয়ে গেছে এতগুলো বছর। হাতঘড়িতে সময় দেখে, নয়টা পঁয়ত্রিশ। অফিসের একটা কাজ সেরে আসতে আজ দেরি হয়ে গেছে, অন্যান্য দিন সাড়ে ছটার মাঝেই ফেরে সে। পিউয়ের চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ায় জাহিদ, অভিমানী মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে ছাদে অপেক্ষা করছে। অনেকদিন ধরেই কিছু কথা চেপে রেখেছে নিজের ভেতর, আজ কথাগুলো শুনতেই হবে তার।
লেখক : অনিকা রহমান মিম
৩০ অক্টোবর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/সিধু/এসবি