মহামায়া
পাঠকই লেখক : দরজার ওপাশ থেকে আড়াল হয়ে রবিনের ঘরের দিকে চুপি দিচ্ছে মায়া। মুখে হাসির রেখা । রবিনকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে । কখনও একটু বেশি ঝুকে পরছে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে চুপি দিচ্ছে । ভেতর থেকে রবিন মুচকি হাসছে মায়াকে দেখে। রবিনও মায়ার মত করে লুকোচুরি খেলছে । ছোট্ট একটা মেয়ে । বয়স আড়াই বছর হবে ! অনেক দুরন্ত ।
একঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে বেড়ায় কচি দু পায়ে । বাসার এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মায়ার ছোট্ট দুটি পায়ের স্পর্শ পরেনি । সারাটা ঘর মাতিয়ে রাখে । দেখতে এতই মিষ্টি , যে কেউ দেখলেই তাকে কোলে নিয়ে গাল টেনে আদর করতে চায় । কিন্তু মেয়েটা মা ঘেঁষা । যেতে চায় না সবার কাছে , কান্নাকাটি করে । তবে মিলির সাথে তার ভাল বন্ধুত্ব ।
মিলির ঘরের সব জিনিসপত্র উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লণ্ডভণ্ড করে । কাপড়ের স্থুপে গড়াগড়ি খায় খেলতে গিয়ে । মেকআপ বক্স দেখলেই মিলিকে কখনও চিল্লিয়ে কখনও ইশারায় বুঝাবে তাকে সাজিয়ে দিতে । না করে দিলে কান্না জুরে দেয় । ঘুরতে ঘুরতে কখনো হাতের কাছে মেকআপ বক্স পেয়ে গেলে আর কথাই নেই। নিজেই সেজে চেহারা পাল্টিয়ে ফেলে ।
তখন আয়নায় নিজেকে দেখলে নিজেই ভয় পেয়ে কাঁদে , মিলি হাসে । মেয়েটা বড়ই দুষ্টু । নিতু , একমাত্র মেয়ে মায়াকে নিয়ে থাকছে বান্ধুবি মিলিদের বাসায়। নিতু যখন মায়াকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল তখন মেয়েটার বয়স ছিল মাত্র আট মাস । চোখের পলকে কতটা সময় কেটে গেছে কেউ বুঝতেই পারেনি ।
.
ছোট্ট মায়াকে অনেক পছন্দ করে রবিন । বাহিরে গেলে মেয়েটার জন্য এটা ওটা কিনে আনে। বাসায় থাকলে সারাটাক্ষন মায়ার সাথে দুষ্টুমি করার ফন্দি আঁটে । কিন্তু মায়া রবিনের কাছে আসেনা । দূর থেকে দেখে মিটি মিটি হাসে । পা টিপে আলতো করে হেটে রবিনের রুমের বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে । আরাল থেকে চুপি দিয়ে তাকিয়ে থাকে ।
রবিন কখনো ধরে ফেললে প্রথমে হি হি করে হাসে তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুট করেই চিৎকার করে কেঁদে দেয় । কোলে নিতে চাইলে আসতে চায় না , কান্নার ভান করে। মায়ের কোলে গিয়ে আবার ফিক করে বুড়ো মানুষের মত করে হাসে । হাসলে তার সামনের উপরনিচ পাটির মাড়িতে ওঠা গুটিকয়েক দাঁত ভেসে থাকে। এতটুকু বয়সে কিনা ভাল অভিনয় করতে জানে মেয়েটা।
রবিনের খুব ভাল লাগে মায়ার সব কাণ্ড কারখানা । অন্যরকম অনুভুতি অনুভব করে সে , স্বর্গীয় অনুভুতি। ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে কাঁধে তুলে ঘুরে বেড়াতে , ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো ধরে হাটতে , কোন কিছুর বায়না ধরলে তা পূরন করতে, মেয়েটার খেলার সঙ্গী হতে, ব্যথা পেয়ে কান্না করলে মেয়েটাকে শান্ত করতে যেন রবিনই মায়ার বাবা । মায়া হাসলে মনের মধ্যে যেমন শান্তি কাজ করে , তেমনি কান্না করলে অস্থির লাগে । মেয়েটাকে দেখলে কেন যেন নিজের মধ্যে পিতৃত্ববোধ কাজ করে রবিনের।
দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকেন রবিনের বাবা । আলাদা পরিবার নিয়ে থাকলেও রবিনদের জন্য সকল ব্যবস্থাই করেন তিনি , অপূর্ণতা রাখেন না । তবে সেসব নিতে নারাজ রবিনের মা । স্বাভাবিকভাবেই ঘৃণা কাজ করে উনার মধ্যে । আশেপাশের প্রতিবেশীসহ অনেক আত্মীয় সেসময় নাক ছিটকিয়েছিল বিয়ের খবর শুনে ।
“স্ত্রীর দোষ না থাকলে কি লোকে দ্বিতীয় বিয়ে করেএএ ! হ্যাঁ ? নিশ্চয়ই ভেতরে কোন রহস্য রয়েছে বলে দিচ্ছি , এক হাতে কখনও তালি বাজে না ! ” একক ভাবে জোহরা বেগমের ওপর দোষ পড়তে থাকে যা তাকে বিষিয়ে তোলে । কখনো কখনো এক হাতেও তালি বাজে , তবে সেটা শ্রুতিমধুর না । মানুষ যে প্রতিনিয়ত নিজের থেকে অন্যকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তায় ব্যস্ত এবং তা যে সম্পূর্ণভাবে অন্যের সত্ত্বাকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে চলেছে সে বিষয়টা তাদের বোধগম্য না ।
কখনও বোধগম্য হলেও তাকে পাশ কাটিয়ে পৈশাচিক আনন্দটাকে জিইয়ে রাখে কারন মনুষ্যজাতির বোধশক্তি নষ্টের পথে । সমাজের কিছু অংশ ভেঙ্গে পরা মানুষকে কখনো জোড়া লাগতে দেয়না । তারা তাকে ভাঙ্গতেই থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত সে মহাকালে মিশে যায়। জোহরা বেগম ভেঙ্গে না পড়ে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নেন , মনকে শক্ত করেন । প্রতিকুলতা ছাপিয়ে পরিবারের হাল ধরেন ।
একটি এনজিও চালাচ্ছেন তিনি , যারা নারীর উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। যে সম্পর্কের আন্তরিকতা নেই , সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অর্থ নেই । জোহরা বেগম তার স্বামীর সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন । তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতে চান না । ছেলেমেয়েকেও নিষেধ করে দিয়েছেন যাতে তারা তাদের বাবার বিষয়ে তার সাথে কিংবা তার সামনে কোন প্রসঙ্গ না তুলে এবং কোন প্রকার আলোচনা না করে । তবে তিনি যেহেতু রবিন মিলির পিতা এবং পিতাসন্তানের একে ওপরের উপর তাদের অধিকার রয়েছে সেহেতু রবিন মিলি চাইলে তারা তাদের বাবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে।
নিতু, বাবা মায়ের অতি আদরের একমাত্র মেয়ে । অতি আদরের বলেই তার সব স্বাদআহ্লাদ পুরনে কুণ্ঠিত বোধ করত না তার বাবা-মা। নিতু ধরেই নিয়েছিল রাতুলের সাথে সম্পর্কের বিষয়টাও তারা মেনে নেবেন। নিতুর বাবা প্রথমে অমত করলেও মেয়ের কথা চিন্তা করে পরে যখন খোঁজ নিয়ে দেখেন যে ছেলেটা পুরোই অকালকুষ্মাণ্ড যার ভবিষ্যৎ বলে কিছুই নেই এর উপর সে মাদকাসক্ত , তখনই রেগে ওঠেন মেয়ের উপর ।
এরকম একটা মানুষের সাথে জীবন কাটানোর চিন্তা পরের ব্যাপার , তার সাথে পরিচিতি কিভাবে হল এবং সম্পর্ক কিভাবে রেখে আসছে জানতে চেয়ে বাসায় চিল্লেচিল্লি করেছেন তিনি। নিতু যাতে সেই ছেলের সাথে আর কোন প্রকার সম্পর্ক কেন যোগাযোগ পর্যন্ত না রাখে সাফ বলে দিয়েছেন । নিতু অনেক কান্নাকাটি করে। সারারাত মায়ের কাছে বসে থাকে । বার বার বুঝিয়ে তার কাছে আর্জি জানায় । কিন্তু মা’ও মেয়েকে বুঝিয়ে একি কথাই বলেন । লাগামহীন ঘোড়া দড়ি দেখলেই দৌড়ে পালায় ।
আবেগ মানুষের বোধশক্তি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করে। নিতুর আবেগী মন তাকে ভালমন্দ বোঝা থেকে বিরত রাখে। বাসা থেকে পালিয়ে সে চলে যায় রাতুলের কাছে। বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে বহুবার । মাদকাসক্ত রাতুল বারবার নিতুকে ফিরিয়ে দিলেও পরে বাধ্য হয়ে রাজি হয় । নিতুর পালিয়ে যাওয়ার এহেন কাণ্ডে বাবা ক্ষুদ্ধ হয়ে যান । পালিয়ে গিয়ে তার ও পরিবারের সম্মানহানি করায় মেয়ের কোন খোঁজ নেননি ।
তবে নিতুর মা বহু চেষ্টা করেছেন মেয়েকে খুঁজে বের করতে । মেয়ের চিন্তায় ভেঙ্গে পরেন তিনি । বিবাহিত জীবন সুখকর ছিলনা নিতুর । রাতুলের ছন্নছাড়া জীবন , পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীনতা আর অভাবের দৈন্যতা তাকে ভাবিয়ে তোলে। বিয়ের আগে তাদের জীবন এবং সম্পর্ক কেমন ছিল এসবের দোহাই দিয়ে রাতুলকে বর্তমান অবস্থা পাল্টানোর কথা বোঝানোর চেষ্টা করলে নিতুর ওপর শারীরিক আর মানসিক অত্যাচার নেমে আসত ।
নিতু কখনও ভাবেনি জীবনের গতি এতটা পাল্টে যাবে , তবুও যতটুকু পেরেছে ভালবাসায় রাতুলকে আবদ্ধে রেখে জীবনটা গুছানোর চেষ্টা করেছে । দুঃখকষ্টে জর্জরিত নিতু এর মধ্যে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় । মায়ার জন্মের পর ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ায় ঘাবড়ে যায় রাতুল । বেকার মাদকাসক্ত রাতুল ধারদেনা করে কিছুদিন কোনরকমে পরিবার চালালেও শেষ পর্যন্ত সামলাতে না পেরে নিতু আর মায়াকে রেখে পালিয়ে যায় ।
দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে ঘোর অন্ধকার দেখতে থাকা দিশাহীন নিতু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাবা-মা’র অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিল । দুঃখী মেয়েটা বাবা মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারবেনা বলে না পেরেছে তাদের কাছে ফিরে যাবার সাহস করতে , না পেরেছে রাতুলের অপেক্ষায় থেকে জীবন সংগ্রাম করতে ।
এদিক অদিক কিছুদিন থেকে সে যোগাযোগ করে মিলির সাথে , তার ছোট বেলার বান্ধুবি । নিতুর জীবনের কথা শুনতে গিয়ে মিলি আঁতকে ওঠে । নিজের ছোট বেলার এত কাছের বান্ধুবির এমন অবস্থা দেখে মিলির নিজেরই কান্না চলে আসে । মিলি তখনই মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিতুকে বাসায় নিয়ে আসে । জোহরা বেগম সব শোনার পর নিতুকে কিছু বলেননি।
শুধু বলেন, মিলি যেমন আমার মেয়ে , তার বান্ধুবি হওয়া মানে তুমি আমারো মেয়ে । আর নিজের মেয়ের কষ্ট আমি মেনে নিতে পারিনা ।এটাকে তোমার নিজের বাড়ি মনে করো । মায়াকে নিয়ে তোমার যেভাবে ইচ্ছে , যেভাবে তোমার ভাল লাগে , তোমার মত করে তুমি থাকো ।
বন্ধুবান্ধব নিয়ে এডভেঞ্চারাস ট্যুরে যাওয়া রবিনের অতি পছন্দের কাজ । সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ে দেশের এই কোনা থেকে ওই কোনায় । ট্যুরের জন্য কখনও মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়নি রবিন । হাতখরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে , কখনও কন্ট্রাক্টে কারো কাজ করে দিয়ে , কখনও ধারদেনা করে ট্যুরের জন্য টাকা জমা করে । তার মতে, সব ব্যাংকের আলাদা একটা ট্যুর স্কিম খোলা উচিৎ যাতে তার মত ভ্রমনপিপাসী মানুষ লোন নিতে পারে ঘোরাঘুরির জন্য।
একবার এক প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল এই বিষয়ে । ম্যানেজার হাসিমুখে তাকে নিজের রুমে নিয়ে খাতির যত্ন করে । ভদ্র লোক যখন জানতে চান যে তিনি কিভাবে তাকে সেবা দিতে পারেন , রবিন জানায় তার ইচ্ছের কথা। “ আসলে আমি ভ্রমনপাগল মানুষ । আমাদের ছোট্ট একটা দল আছে । প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর আমরা কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই ।
এখন প্রত্যেকের কোন না কোনবার ট্যুরের টাকা জমানোটা কষ্টকর হয়ে পড়ে , বিশেষ করে আমার কারন আমি বাসা থেকে এর জন্য টাকা নেই না । অনেকেরই এরকম হয় । তখন দেখা যায় হয় একজনের জন্য দলের ট্যুর মিস হয় নয়ত সে দলের সাথে ট্যুরে থাকাটা মিস করে। এখন আর কি আমার মুল কথা হচ্ছে আপনারা যদি আমাদের ব্যক্তিগতভাবে ট্যুর স্কিমের আওতায় ট্রাভেলের জন্য লোনের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে অনেক ভাল হয় । ”
ম্যানেজার পাক্কা ২৬ সেকেন্ড রবিনের দিকে তাকিয়ে ছিল একনাগাড়ে । রবিন ঘড়ি ধরে দেখেছে। কখনও কেউ রবিনের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকেনি , রবিনের অস্বস্তি লাগছিল । ভার্সিটিতে জীবনের শেষ বারের মত পরীক্ষা দেবার পর এখন হাতে অফুরন্ত সময় রেসাল্টের আগ পর্যন্ত। আপাতত কোথাও ট্যুর দিয়ে আসা যায় চিন্তা করে রেখেছে রবিন । বন্ধুদের সাথে কথাও পাকাপাকি হয়ে গেছে ।
এবার তাদের গন্তব্য তিন্দু , বিরিশিরি , বগা লেক আর নাফাখুম । বিরতি দিয়ে একেক গন্তব্যে পৌছানোর ইচ্ছা । কিন্তু এর মাঝেও একটা বিষয় বার বার রবিনের মন খারাপ করে দিচ্ছে । ভাবিয়ে তুলছে। অস্থির করে তুলছে তাকে।
মিলিদের বাসায় চলে আসার পর নিজের আর মেয়ের থাকার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তামুক্ত হলেও নিতুর মনে কখনও শান্তি আর স্বস্তি ছিলনা । বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ের জীবনে কোন কিছুরই অভাব ছিলনা । তবে অভাববোধ ছিল তো একজন ভালবাসার মানুষের , যার সাথে বিশেষ মুহূর্তের অনুভুতিগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া যায়।
যেকোনো কারনে যেকোনো মানুষকে ভাল লাগতেই পারে । তাই বলে কিছু না ভেবে ভালবেসে জীবনসঙ্গী কিংবা সঙ্গিনী করার সিদ্ধান্ত সমীচীন নয় । ভালবাসার মত পবিত্র অনুভুতি অমূল্য । ভুল মানুষের জন্য সে অনুভুতি প্রকাশ পেতে নেই কেননা একবার সেই অনুভুতিতে নিংড়ানো আঘাত লাগলে তা বিদ্বেষে রুপ নেয়। কখনো এককভাবে আবেগের উপর নির্ভর করতে নেই । কখনও না কখনও সেই আবেগ জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায় ।
ভুল মানুষকে জীবনসঙ্গী করার সস্তা আবেগী সিদ্ধান্তই নিতুর জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছিল। সারাটা সময় চিন্তায় বিভোর থাকে নিতু । বিকেলের দিকে ছাঁদে উদাসী হয়ে হাঁটে । কখনও সন্ধ্যা নেমে এলেও বিকার থাকেনা । বৃষ্টি নামলে একাই ভিজে । চোখের জল আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যায়। নিতুর এমন উদাসীভাব যে রবিন লক্ষ্য করে নিতু দেখেছে। মানুষটা অনেক ভাল। মায়ার জন্য অনেক দরদ তার ।
বাবা না হয়েও বাবার মত মায়াকে ছোট থেকে আদরে আগলিয়ে রাখছে । রাতুল বাবা হয়েও কখনো এমন করতনা । করত কি করতনা এমন চিন্তা করাও বৃথা । যে মানুষ তার অসহায় স্ত্রী আর ছোট বাচ্চাকে এভাবে একা রেখে পালিয়ে যেতে পারে তাকে শুধু ঘৃণাই করা যায় তাকে নিয়ে কোন কিছু চিন্তা করাও সময় নষ্টের নামান্তর । মায়াটা বড় হচ্ছে। কথা বলা শিখেছে ।
প্রথমবার যখন মা বলে ডেকেছে নিতুর সে যে কি আনন্দ ! ইচ্ছে করেছে বাবা-মা কে জানাতে , মায়ার কণ্ঠে শোনাতে যে সে এখন মা । রাতুল আর মায়াকে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করেছে। কিন্ত ! মিলি বসে বসে মায়াকে কথা বলতে শেখায় । মা , মামা , দাদা , নানা । বাবা শব্দ যখনই বলে মিলি একবার নিতুর দিকে তাকায় । নিতু শাড়ির আচঁলে মুখ লুকায় ।
কান্না কাউকে দেখাতে নেই। নিতু অনেক চেষ্টা করেছিল রাতুলকে সে পথ থেকে ফেরাতে। চেষ্টা করেছিল রাতুলের পরিবার সম্পর্কে জানতে, তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। রাতুল কখনই তার পরিবার সম্পর্কে বলতে চাইতনা । বাবা-মা’র কথা না শুনে , রাতুল সম্পর্কে না জেনে , না বুঝে নিতু যে কত বড় ভুল করে ফেলেছে যার প্রায়শ্চিত্ত তার জানা নেই।
মনটা একেবারেই মরে গেছে । প্রতি রাতেই নিতু অনুশোচনায় কাঁদে । নিঃশ্বাস তো কোমাতে থাকা মানুষরাও নেয় । তাই বলে কি বলা যায় তারা পূর্ণভাবে বেঁচে আছে ? মানুষ পূর্ণভাবে বেঁচে আছে এর প্রমান তার মনের শিহরন । মনের শিহরণ না থাকলে হয় সে বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেছে নয় সে জীবনমৃত, যা তাকে প্রতি পদে অন্তর্ঘাতে ভোগাবে।
রবিন কখনও নিতুর সামনে আসেনা । যদি কোন কিছুর দরকার পরে তাহলে মিলিকে বলে। মিলি বাসায় না থাকলে মা’কে বলে। মা নিতুকে বলে দেন । নিতুও মাঝে মাঝে নিজ থেকেই করে দেয় । কোন কিছু না পেলে খুঁজে দেয় । রবিনের প্রতি ভাল লাগা থেকেই নিতু কাজ গুলো করে , করে দিতে তার ভাল লাগে । রবিনের ভাল লাগে বিষয়গুলো । নিতুর প্রতিও তার ভাল লাগা কাজ করে , তবে কিছু বলেনা । কারন ভাল লাগার সাথে অস্বস্তি লাগারও কারন আছে । সমাজভীতিটা প্রকটভাবে কাজ করে রবিনের মাঝে।
বহুবার চিন্তা করার পর নিতু সিদ্ধান্ত নেয় তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করার। বাবার সাথে কথা বলার সাহস তার নেই । অনেকদিন হয়ে গেছে , এভাবে অন্যের পরিবারে বোঝা হয়ে থাকাটা আর ভাল লাগছেনা । মিলির পরিবারের সদস্যরা অনেক ভাল । মা , মিলি আর রবিন ।
জীবনের দুঃসময়ে তারা যেভাবে পাশে থেকেছে, যেভাবে সাহায্য করেছে , মায়াকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরনা জুগিয়েছে তার জন্য নিতু আজীবন কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। নিতু তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করে ফোনে । বহুদিন পর মেয়ের কণ্ঠ শোনার পর মা কেঁদে ফেলেন । জানতে পারেন তার আদরের মেয়ে কোথায় আছে , কেমন আছে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে নিতুর কাছ থেকে ঠিকানা জেনে সোজা চলে আসেন মেয়ে আর নাতনীকে দেখতে ।
ঠুকরে কেঁদে ওঠেন মেয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে। জোহরা বেগম সামলান নিতুর মা’কে । নাতনীকে কোলে নিয়ে আদর করেন মহিলা । নিতুকে কথা দিয়ে যান তিনি অবশ্যই আজ ফিরে গিয়ে নিতুর বাবার সাথে কথা বলবেন । মেয়ের হয়ে তার কাছে মাফ চাইবেন । তাকে মানিয়ে মেয়ে আর নাতনীকে শিগ্রই বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
মায়ার প্রতি রবিনের টান আগের থেকে আরও বেশি বেড়ে গেছে। রহস্যজনকভাবেই ৩ দিন আগে মেয়েটা রবিনের রুমে এসে খেলা করেছে । রবিন তাকে কোলে নিয়েছে , কাঁধে উঠিয়ে ঘুরিয়েছে কিন্তু মেয়েটা মোটেও কাঁদেনি । খিলখিল করে হেসেছে । রবিনের আনন্দের সীমা ছিল না । আবেগাক্রান্ত রবিন মায়াকে দিয়ে বহুবার চেষ্টা করেছে তাকে বাবা ডাক বলাতে । কিন্তু মায়া বলেনি , চুপ করে ছিল ।
মিলির কাছ থেকে যখন জানতে পারে নিতু আর মায়া চলে যাচ্ছে তখন থেকেই তার মনটা খারাপ। এতদিনের বন্ধন ছিন্ন করে নিতু আর মায়া চলে যাচ্ছে মানতেই কষ্ট হচ্ছে তার । ট্যুরেও যাবেনা বলে বন্ধুদের মানা করে দিয়েছে । সারাদিন ঘরেই বসে থাকে। মায়ার সাথে খেলা করে । যতটুকু সম্ভব মায়ার সাথে শময় কাটানোর চেষ্টা করে । কে জানে কখনো আবার মায়াকে দেখতে পাবে কিনা , কাছে টেনে বাচ্চাটাকে আদর করতে পারবে কিনা । মনে হলেই কান্না চলে আসে ।
আজ চলে যাচ্ছে নিতু আর মায়া । নিতুর বাবা মেয়েকে মাফ করে দিয়েছেন । তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মিলিদের বাড়ি এসেছেব নিতু আর মায়াকে নিয়ে যেতে । নিতুর আজ মনটা খুব ভাল লাগছে তবে খারাপও লাগছে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে । নিতু ব্যাগ গোছাচ্ছে আর মিলি মায়াকে তৈরি করে দিচ্ছে । রবিন ঘরে বসে আছে । মন এতটাই খারাপ যে নিতুর বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে পর্যন্ত যায় নি।
হাহাকার লাগছে মনের ভেতর । জোহরা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে আছেন নিতুর বাবা মায়ের সাথে , কথা বলছেন পুরনো দিন নিয়ে । মায়ার বড় হওয়া , প্রথম হাঁটতে শেখা , কথা বলা , মায়ার দুরন্তপনা আর দুষ্টুমি , সবাইকে এক করে মহামায়ায় আবদ্ধ রাখা ! নিতু মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসে । জোহরা বেগম ছোট্ট মায়াকে জড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ । তারও মনটা খারাপ ।
এতদিন ঘরটাকে আলোকিত করে রাখা বাচ্চাটা চলে যাচ্ছে আজ । আজ থেকে ঘরটা শুন্যতা বোধ করবে । চলে যাবার আগে নিতু সবার থেকে বিদায় নিল। চোখের জলে কৃতজ্ঞতা জানালো দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য। নিতু দেখল রবিন ড্রয়িং রুমে নেই । নিতু ঘরটার দিকে চোখ বুলালো একবার । বুলানোর সেই দৃষ্টিতে ছিল ঘরের কোন এক কোনায় দাড়িয়ে থাকা রবিনকে এক পলক দেখার ইচ্ছা ।
মায়া হন্য হয়ে কি যেন খুঁজছে , ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । মিলি দৌড়ে গেল রবিনের রুমে । মায়াকে একবার দেখার জন্য আর তাদের বিদায় দেবার জন্য রবিনকে অনেক করে বলল ড্রয়িং রুমে আসতে , রবিন আসতে চাইলনা । মিলি জানে রবিন নিতুকে পছন্দ করে। মায়াকে নিজের মেয়ে ভাবে , অনেক ভালবাসে । মিলি রবিনের চোখটা ছলছল করতে দেখল যেখানে রয়েছে লাল আভার উপস্থিতি।
মিলি চলে গেলে রবিন আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় । দরজা পাশে এসে দাঁড়ায় , মায়ার মত করে একটু বেশি ঝুঁকে আরাল হয়ে দাঁড়ায় । দেখে , মায়া চলে যাচ্ছে মায়ের হাত ধরে । বের হবার সময় নিতু মায়াকে বলে , “হাত নাড়িয়ে বিদায় নাও ! বাই বলো সবাইকে ! বলো আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবেন !” মায়া রবিনকে দেখতে পায় , খুশি হয়ে ওঠে মেয়েটা । তার গুটিকয়েক দাঁতগুলো মেলে হাসি দেয়। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে ওঠে , বাবা !!! চমকে ওঠে সবাই ।
সবাই তাকিয়ে থাকে রবিনের দিকে । নিতু তাকিয়ে দেখে রবিন এগিয়ে আসছে , চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে ।নিতুর বাবা-মা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন রবিনের দিকে । রবিন নিতুর সামনে এসে দাঁড়ায় । মিলি দেখল নিতুর চোখের কোনায় জল । মিলি মায়াকে কোলে তুলে নেয় । ব্যাগ নিয়ে সোফার পাশে রাখে । রবিন একবার তার মায়ের দিকে তাকায় । মা তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে , মুচকি হাসি দেন তিনি । রবিন নিতুর দিকে তাকায় ।
নিতুর হাত ধরে বলে , “নিতু ! আমি এতদিনের বাধন ছিন্ন করে তোমাকে আর মায়াকে ছাড়া থাকতে পারব না । আমি মায়া আর তোমাকে নিয়ে আজীবন মহামায়িক বাঁধনে বেঁচে থাকতে চাই । মায়া আর তোমার জীবনে পূর্ণতা আনতে চাই । আমার আমার পরিবারকে ছেড়ে প্লিজ তোমরা চলে যেওনা । মায়াকে আমার আর আমার পরিবার থেকে প্লিজ তুমি আলাদা করোনা । পরিপূর্ণভাবে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যাও ! আমাকে আর আমার পরিবারকে আপন করে নাও ! ” রবিন দেখল নিতুর চোখ বেয়ে পানি ঝরছে । “ নিতু ! আমি মায়ার বাবা হতে চাই ! ”
ঘরের উপস্থিত মানুষজনের চোখের কোনায় জল চলে এসেছে , এমনকি নিতুর বাবা মায়েরও। মায়াসহ ঘরের সবাই তাকিয়ে আছে এই দুই মানব মানবীর দিকে । রবিন আর নিতু একে অপরের হাত ধরে কাঁদছে ।
লেখক : মঈন উদ্দিন সাব্বির (Moin Uddin Sabbir)
১০ অক্টোবর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/সিধু/এসবি