পাঠকই লেখক ডেস্ক : অনেকদিন হল তোমার কোন খোঁজ নেওয়া হয়না। দেখতেও আসতে পারি না। আসলে কাজের চাপটা এতটা বেড়েছে যে সব সামলাতে রীতিমত বেশ হিমশিম খাচ্ছি। এখন বুঝি কেন তুমি খুব করে চাইতে আমি সরকারী চাকরী করি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আসলেই এত অত্যাচার করে। আর আমার মত নতুন জয়েন করা ছেলেগুলোকে রীতিমত কিমা বানিয়ে ছাড়ে। তুমি কিন্তু এ নিয়ে একদম চিন্তা করবেনা। আমি মানিয়ে নিয়েছি, এখন বেশ ভালোই আছি। কথা দিচ্ছি এবার সুযোগ পেলেই তোমায় দেখতে ছুটে আসব। তোমার থাকার জায়গাটার পাশে যেই গোলাপ ডালিয়ার গাছ আছে সেখানে বসে খুব গল্প করব।
যখন অনেক কাছে ছিলে তখন কথাই হতো না তোমার সাথে। আর এখন যাই ঘটেনা কেন মনে হয় আগে তোমায় গিয়ে বলি। কিন্তু সে সুযোগ এখন আর নেই। আমার কি দোষ বল? আমি খুব করে বলতাম এখানেই কোন এক জায়গায় তোমার থাকার জায়গাটা হবে।
কিন্তু তুমি তোমার মায়ের সাথেই থাকবে। আচ্ছা দাদুমনির সাথে কি খুব কথা হয় এখন? কেমন আছে উনি এখন? উনার উপর ভীষণ রাগ আমার।আমাদের একা করে নিজের ছেলেকে এভাবে নিয়ে গেলো। মায়ের সাথে থাকতে গিয়ে আমাদের কথা মনে পড়ে তোমার?
তুমি মানুষটা এত আগে চলে যাবে ভাবিনি কখনো। কি এত অভিমান ছিল তোমার জানিনা।তোমার চলে যাবার কিছুদিন আগের কথা। আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ি। হঠাৎ কেন জানি খুব দামি একটা ব্র্যান্ডের শার্ট পড়তে ইচ্ছে হল আমার। আমাদের বেশ টানাটানি চলছিল তখন।তাই তোমাকে আর বলিনি তখন।কিন্তু ঠিকই ঈদে তুমি আমাকে সেরকম একটা শার্ট কিনে দিলে।
মাকে বলেছিলে,"এখন তো বাবা কিনে দিচ্ছে। ছেলেকে ভালমত পড়ালেখা করতে বল যাতে নিজেও এমন জামা কিনতে পারে। "আচ্ছা বাবা তুমি কি বুক ভরা অভিমান নিয়ে একথা বলেছিলে? আমি তো তখনও চাকরী করার মত যোগ্য হয়ে উঠিনি। তবে তোমার কথা রেখেছি আমি। অনায়াসে কয়েকটা দামি শার্ট মাস শেষেই কিনতে পারি। তোমার জন্যও কেনা হয়। কিন্তু একসাথে পরার সুযোগ হয় না।অবশ্য তোমার দেয়া সেই জামাটাও আমি পরিনি। রেখে দিয়েছি। যেদিন আমাদের দেখা হবে আবার সেদিন পরবো।আমার দেয়া জামা পরে তুমি খুশি হবেনা বাবা?
আলতাফ সাহেবের কথা মনে আছে তোমার? ঐ যে তোমার অপারেশনের সময় যে টাকা চেয়েছিলাম। লোকটা নাকি সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হয়।যদিও তার আচরণে সেকথা মনে হয়নি কখনো আমার। তার টাকাগুলো শোধ করে দিয়েছি। বিদেশি ব্যাংকের চেকটা দেখে ভদ্রলোক ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি এটা আমি দিচ্ছি।
আসলে সেতো তোমাকে মধ্যবিত্ত,ছাপোষা মানুষ হিসেবে দেখেছে কিন্তু বাবা হিসেবে তুমি কেমন হতে পারো ভাবেনি। তুমি শুধু বাবাই ছিলে না,ছায়াও ছিলে আমাদের। ঈশ্বর যখন বুঝল তোমার দায়িত্ব অনেকটাই পালন শেষ তখনই তোমায় নিয়ে গেলো। কিন্তু বাবার দায়িত্ব কি কখনো শেষ হয় বল? বিশ্বাস করো বাবা,তোমার চলে যাওয়ার পরের দিনগুলো কি যে কষ্টে কেটেছে আমাদের। অভাব অনটনে মা ছেলে কিভাবে বেঁচে ছিলাম বুঝাতে পারব না।
ভালো খাবার,দামি কাপড়ের কথা ভাবতেই পারতাম না। একরুমের একটা ছোট্ট বাসা নিয়েছিলাম। প্রায় সব আসবাবপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলাম। বাড়িভাড়া,কলেজের বেতন সব কিছুর জন্য শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। আচ্ছা বাবা তুমিতো স্বর্গে আছো না? সৃষ্টিকর্তাকে একটাবার জিজ্ঞেস করো আমাদের এভাবে কষ্ট দেয়াটা খুব কি জরুরী ছিল?খুব কি পাপ ছিল আমাদের?
আচ্ছা বাবা নিতুকে তো চিনতে তুমি তাইনা?ঐ যে সেই মেয়েটা।যাকে নিয়ে মা সারাদিন আমাকে বকা দিত।কিন্তু তুমি সব জেনেও আমাকে সাপোর্ট দিতে।মেয়েটাকে বেশ পছন্দ ও করেছিলে তুমি।ওর সাথে এখন আর আমার যোগাযোগ নেই।কি করে থাকবে বল?তুমি বাবা হয়েই চলে গেলে আর ও তো অন্য মানুষ।জানো বাবা ওর পরিবার নাকি পিতৃহীন একটা ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিল।
শঙ্কাটা ওর নিজেরও ছিল।ওর সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলার টাকাও ছিলনা আমার তখন।এখন অফিস থেকেই আমার ফোনের টাকা দেয়।মেয়েটা কি বোকা তাইনা?তবে ওকে আর কি দোষ দিব বল।কত মানুষ কত কি বলত।সবচাইতে খারাপ লাগে কখন জানো?যখন মানুষ এতিম নামক এক অদ্ভুত জঘন্য শব্দ ব্যবহার করে আমার পরিচয় দিত।
আচ্ছা বাবা কে বলেছে তুমি নেই?আমার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে পুব দিকটায় যে তারাটা দেখি,কথা বলি সেটাতো তুমিই তাইনা বাবা?আমি আগে বৃষ্টি দেখতাম আগ্রহ নিয়ে।এখন মেঘলা আকাশ আমার ভালো লাগেনা।মেঘগুলো যে আকাশে তারা হয়ে থাকা বাবাটাকে ঢেকে দেয়।আমাকে তুমি হয়তো অনেক খারাপ ভাবো,অনুভূতিহীন একটা মানুষ ভাব।কিন্তু তোমার অসুস্থতার সময় কত রাত আমি কেঁদেছি তা শুধু আমিই জানি বাবা।
মাকে তুমি খুব ভালবাসতে কি?মা কিন্তু তোমাকে বেশ ভালোবাসতো।তুমি চলে যাবার পর আমি দেখেছি মানুষটার কান্না,মনের অবস্থা।আসলে মধ্যবিত্ত জীবনটা ভালোবাসার অনুভূতিকেও মেরে ফেলে।সংকোচে ফেলে দেয় তা প্রকাশে।
মা কি পৌঁছে গেছে তোমার কাছে?হ্যাঁ বাবা।গত পরশু মাকেও তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।তোমাকে ছাড়া সে যে আর থাকতে পারছেনা।এজন্য আমার খুব একটা মন খারাপ নয়।দেখছনা কি সুন্দর তোমাকে লিখে যাচ্ছি।আমি জানি তুমি মাকে ভালো রাখবে।বেশ ভালো রাখবে।
বাবা একা হয়ে আমি খুব ক্লান্ত।তোমার আর মায়ের কাছে আমারও আসতে ইচ্ছে করছে।আমাদের পরিবারটা আবার একসাথে থাকবে।আবার তোমাকে জ্বালাব,মার বকা খাব।বাবা,সকালে ক্লাস মিস হলেও তুমি আমাকে জাগাতে না।বলতে ছেলেটা আরেকটু ঘুমাক।আমি ঘুমাতে চাই বাবা।যে ঘুমের পথ ধরে তোমার আর মায়ের সাথে থাকতে পারব।কখনো বলিনি।কিন্তু সত্যিই তোমায় ভালোবাসি বাবা,তোমাদের ভালোবাসি...
লেখক: রুবায়েত তন্ময়
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/এসবি