মায়ের ঠিকানা যখন বৃদ্ধাশ্রম
পাঠকই লেখক : অফিসের অর্থব্যয়ের হিসাবটা কোনমতেই মিলাতে পারছে না আরিফ। ফাইল হাতে নিয়ে পড়ছে আর মাথা চুলকাচ্ছে। যে কোন উপায়েই হোক হিসাবটা মিলাতে হবে।
এমন সময়েই ফোন বেজে উঠল আরিফের। ফোন হাতে কলারের নাম দেখে বিরক্ত হল সে।
তার স্ত্রী শায়লা ফোন করেছে। নিশ্চয় কোন না কোন অযথা বিষয় নিয়ে বকবক শুরু করবে। এমনিতেই কাজের অতিরিক্ত চাপ, তার উপর এই অযথা বকবক যে কারোরই বিরক্ত লাগবে।
অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও ফোনটা রিসিভ করল আরিফ। কারন না ধরলে তো আবার এটা নিয়েও বকবক শুরু হবে শায়লার।
‘হ্যা বল কি বলবা?’ দায়সারা ভাবে বলল আরিফ।
‘এমন ভাবে বললা কেন? আমি কি ফোন দিয়ে বিরক্ত করলাম নাকি?’
‘না। বিরক্ত হওয়ার কি আছে?’ এইবার মধুর সুরে বলল।
‘তাহলে ঐভাবে বললা কেন?’
‘কাজের চাপে বলে ফেলেছি। এখন বল কি বলতে ফোন দিলা?’
‘আমি যখনই ফোন দেই তখনই তুমি এইভাবে কথা বল। আমি কি খুব খারাপ নাকি যে আমার সাথে ভাল ভাবে কথা বলা যাবে না?’
‘আরেহ! তা হবে কেন? আচ্ছা বাদ দাও, এই নিয়ে পরে কথা বলব। এখন রাখি কাজের চাপ খুব বেশি।’ অযথা ঝামেলা এড়ানোর জন্য বলল আরিফ। ফোন রেখে দেওয়াই উত্তম হবে এখন।
‘আরেহ! আরেহ! যা বলতে চেয়েছিলাম তাই তো বলা হল না। তোমার মা হুট করে বাসায় এসেছেন। আসার পর থেকেই পাগলামী শুরু করে দিয়েছেন।’
মা এসেছে শুনে বেশ অবাক হল আরিফ, ‘মা এসেছে? এই কথাটা আগে বললে কি ক্ষতি হত? আর পাগলামী করছে মানে? তুমি তো মাকে দেখতেই পারো না, মা যাই বলুক ঐটা তোমার কাছে পাগলামীই মনে হয়।’ শেষ কথাটা বলার সময় শায়লার প্রতি ঘৃনা নিয়েই বলল সে।
‘আগে কথা তো পুরাটা শুনবা। মা এসেই বলা শুরু করে দিয়েছেন উনার ছেলে কই! উনার ছেলে কই! অবশ্য আমি বলেছি যে তুমি অফিসে।’
‘এইটাই মায়ের পাগলামী?’ শায়লার কাছ থেকে মায়ের পাগলামীর বিবরনের কথা শুনে শায়লার প্রতি ঘৃনার পরিমান আরো বাড়ল তার।
‘পাগলামী নয়তো কি? তোমাকে এক্ষুনি বাসায় আসতে বলার জন্য ফোন করে ছিলাম, কিন্তু তুমি তো ব্যস্ত। আসতে পারবে না। তোমার আসার আগ পর্যন্ত এই পাগলামী সহ্য করা লাগবে আমাকে।’
আর কোন কথা না বলে সোজা ফোন কেটে দিল আরিফ। মেজাজ গরম হয়ে গেছে তার।
অবশ্য তার মা বাসায় এসেছে ভেবে তার মনটা আবার খুশিতে ভরে উঠল।
দীর্ঘ সাত বছর তার মাকে সে দেখে না। সেই সাত বছর আগে বৃদ্ধাশ্রম নামক খাচায় মাকে রেখে এসেছিল। আসার সময় মায়ের কান্নাভরা মুখটা দেখে এসেছিল। এরপর আর দেখে নি।
একটা খোঁজও নিতে পারে নি সে মায়ের। শুধু কয়েক মাস অন্তর অন্তর আশ্রমে তার মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছে কুরিয়ার করে।
ধরলে হিসেবে আরিফ তার মায়ের জন্য এইটুকুই করেছে। যদিও সে কখনোই চায় নি তার বৃদ্ধাশ্রমে থাকুক, কিন্তু শায়লার অতি যন্ত্রনায় মাকে শান্তিতে রাখার জন্যই রেখে আসতে হয়েছিল।
তার আর শায়লার বিয়ের তিনমাসও তখন হয় নি, শায়লার চোখে আরিফের মা এক প্রকার বিষ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
আরিফের অনুপস্থিতিতে শায়লা নাকি তার মাকে নির্যাতনও করত। এমন খবর পেয়ে আরিফ শায়লার নামে নারী নির্যাতনের মামলাও করতে চেয়েছিল।
কিন্তু দেশের আইনে নারী নির্যাতন বলতে শুধু স্ত্রী বা অল্প বয়সী মেয়েদের পুরুষ কর্তৃক নির্যাতনই সংজ্ঞায়িত, মাও যে নারী সমাজেরই একজন সেইটা আইন প্রনয়নকারীরা বেমালুল ভুলে গেছে।
আরিফের মামলাটা ধোপে টিকে নি তাই। তাই মাকে শান্তির জন্য রেখে আসতে হয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমে।
এইটা না হয় বুঝা গেল সে কিছু করতে চেয়েছিল মায়ের জন্য কিন্তু করতে পারে নি। কিন্তু সাত বছরে একবারও মাকে দেখতে যায় নি, এইজন্য সে কি অজুহাত দিবে?
দেখতেও যেতে পারেনি এই শায়লার কারনেই। আরিফ যতবারই মনোনিবেশ করত তার মাকে দেখতে যাবে, ততবারই শায়লার শপিং করার ভূত চাপত মাথায়।
শায়লাকে তো কিছু বলতেও পারে না। কারন কিছু বলতে গেলে ঐ কথিত নারী নির্যাতনের মামলায় পড়তে হবে আরিফকে। তাই, সাত বছরে মায়ের চেহারাটা আর দেখাও হয়নি।
এমনভাবে চলতে চলতেই আরিফের অনূভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। তার মা মরে গেছে না বেঁচে আছে সেইটা জানার অনুভূতিও তার হারিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এতবছর পর মা আবার তার বাসায় এসেছে। অনুভূতিগুলো ফিরে আসতে শুরু করল তার একটু একটু করে। কাজের চাপের তোয়াক্কা না করে ছুট লাগাল মাকে দেখার জন্য।
তবে মনে মনে এইটাও ঠিক করে রেখেছে, শায়লা যদি আজ উল্টা-পাল্টা কোনকিছু তার মায়ের সাথে করে তাহলে শায়লার কপালে দুর্গতি আছে।
বাসায় এসে খানিকটা অবাক হল মাকে দেখে আরিফ। ইনি অবশ্যই মা, তবে তার মা এই মহিলা না।
সত্তর উর্ধ্ব এক বৃদ্ধা এই মহিলা। চোখে বোধহয় ছানি পড়ে গেছে। চোখে ঠিকমত দেখতে পারেন না। হাতে একটা কাগজ দেখতে পেল আরিফ। ঐ বৃদ্ধা যক্ষের ধনের মত কাগজটাকে ধরে রেখেছেন।
আরিফকে বাসায় আসতে দেখে এগিয়ে আসল শায়লা। এসেই বলা শুরু করল, ‘যাক এলে তাহলে! যাও এখন তোমার মাকে সামলাও।’
শায়লার কথা শুনে আরিফের মাথায় রক্ত উঠে গেল। ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল শায়লার গালে। একটা না, পরপর কয়েকটা। যতক্ষন হাত চলল ততক্ষন মেরেই গেল।
‘তুমি খারাপ তা আমি বিয়ের পরদিনই বুঝে গেছি। কিন্তু এতটা বুঝতে পারি নি। আমার মাকে তুমি দেখতে পেতে না জানি কিন্তু মায়ের চেহারাও যে তুমি ভুলে যাবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অবশ্য তোমার মত মেয়ের পক্ষে ভোলাটা স্বাভাবিকই। তুমি তো মানুষ না, মানুষের আদলে থাকা সাক্ষাৎ ডাইনি।’
আরিফের আচরনে থতমত খেয়ে গেল শায়লা। হঠাৎ যে আরিফ এতটা রেগে যাবে আগে বুঝতে পারে নি।
আরিফের অনবরত থাপ্পড় খেয়ে মাথায় ঝিম লেগে গেছে। কি বলতে হবে বুঝতে পারছে না। এখন আবার একটু ভয়ও পাচ্ছে কথা বলতে। যদি কথা বললে আবারও তাকে মেরে বসে আরিফ। তারপরও মিনমিনে গলায় বলল, ‘তাহলে ইনি কে?’
‘হবে হয়ত আমারই মত বউ এর হাতের কোন কুলাঙ্গার ছেলের মা।’ খেকিয়ে উঠে বলল আরিফ।
আরিফের গলা শুনে বৃদ্ধা মহিলা হাতড়ে হাতড়ে তাদের রুমে আসলেন। বললেন, ‘কিরে খোকা! আসলি কখন তুই? বউমা না বলল তুই অফিসে?’
বৃদ্ধা মহিলার কথা শুনে আরিফ আর বলতে পারল না যে সে উনার ছেলে না। এমনিতেই বৃদ্ধা মহিলা অনেক দুর্বল – এই কথা শুনলে যে কোন মুহুর্তে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই বলল, ‘মা তুমি আমার বাসায় এসেছ শুনে কি আর আমি অফিসে থাকতে পারি? হাজার হোক আমার স্থান তো এখনো তোমার কোলেই।’
‘ঢং করিস না খোকা। এসেই তো বউমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলি। যাওয়ার সময়ও তো তোদের এই ঝগড়াই দেখে গেলাম।’ অভিমানী সুরে কথাটা বললেন বৃদ্ধা মহিলা।
‘এই সব ঝগড়ার কথা বাদ দাও তো এখন। অনেকদিন তোমার সাথে গল্প করি না। আজকে আস তোমার সাথে গল্প করি। তোমার সাথে গল্প করাটা এতদিন অনেক মিস করেছি।’ বৃদ্ধা মহিলার অভিমান কাটানোর জন্য বলল আরিফ।
‘এতই যদি মিস করতি তাহলে আমাকে কেন রেখে আসলি ঐ পঁচা জায়গায়? কেন আমাকে কোনদিন দেখতেও গেলি না?’ বৃদ্ধার অভিমান কমেনি, আরো বাড়ছে ক্রমেই। স্বাভাবিক ব্যাপার। অভিমান করবেই।
‘ভুল করেছি মা। তোমাকে রেখে আসা ঠিক হয় নি। অবুঝ ছিলাম আমি তখন। জানই তো তোমার ছেলে সব সময়ই অবুঝ। মাফ করে দাও মা।’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে আরিফের গলা কান্নার তোপে প্রায় আটকে যাচ্ছিল। এই বৃদ্ধাকে হয়ত সে মাফ করে দেওয়ার জন্য সহজেই বলতে পেরেছে – কিন্তু নিজের মাকে তো আর এত সহজে সে কথাটা বলতে পারবে না।
আর সে বলবেই বা কোন মুখে?
‘কাঁদার কি হলরে খোঁকা? ছেলের সব দোষই মা মাফ করে দেয়। তবে এইবার এত সহজে মাফ করব না। একটা শর্তে মাফ করতে পারি।’
‘কি শর্ত মা?’
‘আমাকে আর কখনো ঐ জায়গায় রেখে আসতে পারবি না। ঐ জায়গাটা আমার ভাল লাগে না।’
‘এইটা তোমারই বাসা মা। এইখানে তুমি যা বলবে তাই হবে। দরকার পড়লে তুমি আমাদেরকে যে কোন জায়গায় রেখে আসতে পার।’
আরিফের এই কথাটায় বৃদ্ধা মহিলার মুখে হাসি ফুটে উঠল। জড়িয়ে বুকে টেনে নিল আরিফের। মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল আরিফের। হোক না সে কারো না কারো মা, কিন্তু মা তো।
‘মা বাসা চিনে আসলে কিভাবে?’ আরিফ জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধা মহিলাকে।
‘ঐ জায়গায় থাকতে আর ভাল লাগছিল না। এসে পড়তে চাইছিলাম। ঐখানের সবাইকে বললাম। তারাই এসে দিয়ে গেল।’
‘ঠিকানা জানলে কিভাবে?’
‘তুই তো ঠিকানা লিখে একটা কাগজ দিয়ে এসেছিলি আমার হাতে। এখন ভুলে গেছিস?’ বলে বৃদ্ধা তার হাতে থাকা কাগজটা দেখাল আরিফকে।
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল বাসার ঠিকানা, রোড নং, এলাকার নাম সবই ঠিক আছে – শুধু উপরে লেখা নামটা তার নয়। নামটা সে বাসাটা যার কাছ থেকে কিনেছিল তার। অবশ্য খুব দুর্দশায় পড়েই বাসাটা বিক্রি করেছিল বৃদ্ধা মহিলার আসল ছেলে।
কারন মাকে কষ্ট দিয়ে তো আর কেউ আরামে থাকতে পারে না। তার বিপদ সবদিক দিয়ে লেগেই থাকে। সেই লোকেরও এমন বিপদে পড়েই তার হাতে গড়া বাসাটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।
পরে যট্টুক জানে সড়ক দুর্ঘটনায় সেই লোকটি পুরো পরিবার সহ মারা গেছে। তারমানে এই মহিলার আর আপন বলতে কেউ আর নেই।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আরিফ। এই বৃদ্ধাকে সে নিজের কাছেই রাখবে।
সাথে আরেকটা সিদ্ধান্তও নিল। শায়লার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠাল।
শায়লা যদিও কিছু বুঝতে পারছে না। তার মাথা এখনো ঘোলাটেই আছে। আরিফকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছে না এখন।
‘কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইলে না?’ আরিফ নিজে থেকেই বলল শায়লাকে।
শায়লা উত্তর দেওয়া নিয়েও ভয় পাচ্ছে এখন। উত্তর দিলে কি আরিফ আবার রেগেই যায় কিনা! না দিলেও তো রেগে যাবে দেখে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি?’
না রাগে নি আরিফ। বরং নির্বিকারভাবে উত্তর দিল, ‘গেলেই দেখতে পারবে।’
অস্থায়ী ঘরটাই গোছগাছ করছিলেন রাহেলা বেগম। উনি জিনিসপত্রের এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা পছন্দ করেন না।
উনার গোছগাছের কাজে বাধা পড়ল উনার কাধে কারো হাত পড়ায়।
হাতটা কার উনার বুঝতে কোন অসুবিধা হল না। কিন্তু বুঝেও পিছনে ফিরে তাকালেন না।
সাতটা বছর তিনি অপেক্ষা করেছেন কাধে হাতপড়ার। অপেক্ষায় থেকে অশ্রু ঝড়িয়েছেন। উনার অপেক্ষার আজ অবসান ঘটল। তিনি চাইলেই পারেন পিছন ফিরে হাতের মালিকটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে।
কিন্তু তিনি তা করলেন না। খানিকটা থমকে গিয়েই তিনি গোছগাছের প্রতিই মনোনিবেশ করলেন আবার।
‘মা! পিছন ফিরে একবার দেখ। না আমাকে দেখতে হবে না। আমিই দেখব শুধু তোমাকে। শুধু একবার পিছনে ফিরে তাকাও।’ বলে উঠল হাতের মালিক। আর পারলেন না রাহেলা বেগম। চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করেছেন। উনার চোখে কোন সমস্যা নেই – কিন্তু এই মুহুর্তে তিনি ঝাপসাই দেখছেন।
ফিরে তাকালেন। ছেলে আর ছেলের বউকে দেখতে পেলেন। ছেলেকে দেখেও না দেখার ভান করলেন।
এগিয়ে গেলেন ছেলের বউয়ের দিকে। ‘কেমন আছো বউমা? শাশুড়িকে কি একবারো দেখতে ইচ্ছে করল না তোমার?’ বলে ছেলের বউকে বুকে টেনে নিলেন। চোখে অশ্রু এসে গেছে।
এতক্ষন মাথা ঘোলাটে লাগছিল শায়লার। রাহেলা বেগমের জড়িয়ে ধরার পর তার ঘোলাটে ভাবটা কেটে গেল। চোখ দিয়ে তার ফোটায় ফোটায় পানি পড়া শুরু করল।
আরিফ তার সম্পর্কে ঠিকই বলেছিল তার সম্পর্কে। সে আসলেই কোন মানুষ না, মানুষের আকৃতিতে বসবাস করা এক ডাইনি সে। আরিফ কেন তাকে আরো আগে এই থাপ্পড় গুলো দিল না – সেইটা নিয়েই তার আফসোস। আগে দিলে হয়ত এই মমতাময়ী মায়ের আদর মাখা স্পর্শটা সে আরো আগেই পেত।
যে মহিলাকে সে দিনরাত এত অত্যাচার নির্যাতন করত, যেই মহিলার চেহারাই সে ভুলে গিয়েছিল – সেই মহিলা ঠিকই এত বছর পরেও তাকে চিনতে পারল, বুকেও টেনে নিল। এইসব ভেবে এখন একধরনের অপরাধ বোধ কাজ করা শুরু করে দিল শায়লার।
‘মা। আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ গলার সুরে কান্নার ছাপ স্পষ্ট।
‘তুমি কোন অপরাধ কর নি মা। সব মেয়েই চায় তার নিজের সংসারটাকে নিজের মত সাজাতে। তুমিও তাই চেয়েছিলে। আর মায়ের কাছে সন্তানের কোন অপরাধ থাকতে পারে না।’ হেসে জবাব দিলেন রাহেলা বেগম। যদিও উনার হাসিটা যে সত্যিকার না তা স্পষ্টই বুঝা যায়।
শায়লার সাথে এতক্ষন কথা বললেও আরিফের দিকে ফিরেও তাকান নি তিনি। উনার সমস্ত রাগটা আরিফের উপরই।
উনাকে এইখানে রেখে যাওয়ার জন্য না, উনাকে এখানে রেখে যাওয়ার পর যে উনাকে একবারও দেখতে আসেন নি – রাগটা সেই জন্যই।
রাগতস্বরেই আরিফকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কতক্ষন থাকবি তোরা এইখানে? চা-নাস্তা খেয়ে যাওয়ার সময় হবে তোদের?’
‘মা! চা-নাস্তা অবশ্যই খাব। তবে এইখানে না। বাসায় গিয়ে।’
‘ও আচ্ছা! আমি ভাবলাম হয়তো মায়ের হাতের চা টা অন্তত খাবি। কিন্তু বাসায় গিয়েই যদি খেতে চাস তাহলে তো আর আমার কিছু বলার নেই।’
‘কে বলল তোমার হাতের চা খাব না। তোমার হাতের চা ই খাব। তবে বাসায় গিয়ে তুমি চা তৈরি করে খাওয়াবে।’
‘নাহ! আমি তোর বাসায় আর যাব না। আমি এইখানেই ভাল আছি।’
‘মা! চল না! বড় একটা বাসা আছে আমার। কিন্তু তোমাকে ছাড়া বাসাটা খালি খালি লাগে। তোমার জন্যই তো আমি এই বড় বাসাটা কিনেছি।’ মিথ্যে বলে নি আরিফ। মায়ের জন্যই সে বাসাটা কিনেছে, তার মায়ের নামেই।
কিন্তু এতদিন শায়লার ভয়ে মাকে ঐ বাসায় নিয়ে যাওয়ার সাহস সে পায় নি। আজ পেয়েছে। আজ সে নিয়েই ছাড়বে তার মাকে ঐ বাসায়।
রাহেলা বেগম প্রচন্ড আত্ন-অভিমানী মহিলা। আত্ন-সম্মান বোধটাও অনেক উনার। তিনি যাবেন না বলে যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাহলে উনাকে কোনমতেই নেওয়া যাবে না।
যদিও উনার মন চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উনার ছেলের বাসাটায় গিয়ে থাকতে, ছেলেকে প্রতিদিন অফিসে যেতে দেখতে, ছেলের বউকে সংসারের কাজকর্ম করতে দেখতে – তারপরও তিনি যাবেন না। কারন ছেলের বাসায় গেলেই আবার সেই পুরোনো ঝামেলা শুরু হবে, উনার ছেলে এইসব দেখে কষ্ট পেলেও কিছু বলতে পারবে না, একাকী নীরবে কাঁদবে।
ছেলের ঐ নীরবে কান্না তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই যাবেনও না তিনি।
আরিফ অনেক জোরাজুরি করল মাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। মায়ের জেদের কথা তার ভালই জানা। সে জানে মা একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে আর সেটা পরিবর্তন করানো যায় না।
তারপরও শেষবারের মত বলল, ‘মা! বাসায় গিয়ে আমি তোমাকে আমার চেহারাও আর দেখাব না। কিন্তু তোমার নাতিটা কি দাদীর মুখে গল্প না শুনেই বড় হবে? তুমি কি চাও তা হোক?’
নাতির কথা শুনে চকিতে ঘুরে দাড়ালেন রাহেলা বেগম। রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোর ছেলে হয়েছে সেই কথাও কি তর আমাকে জানানোর কথা মনে থাকে না?’
‘মনে তো ছিলই মা।’ এইটুক বলে শায়লার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার বলল, ‘এতদিন একটা ভীতির বলয়ে ছিলাম। সেই জন্যেই মনে থাকলেও তোমাকে জানাতে পারি নি। ক্ষমা করে দিও।’
‘তোর কোন ক্ষমা নাই। তোকে কোনদিন ক্ষমাও করব না। এখন আর বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি আমাকে বাসায় নিয়ে চল। আমার ছেলের ছেলেকে দেখার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছি না আমি।’ বলে রাহেলা বেগম নিজেই সবার আগে বের হয়ে আসলেন আশ্রম থেকে।
আর কোনদিন ফিরবেনও না এই স্থানে। বাকী জীবনটা নাতির সাথে রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প করেই কাটিয়ে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।
আরিফ বৃদ্ধা মহিলার হাতে থাকা কাগজটা হাতে নিয়ে একবার হাসল। এই কাগজটাই তাকে পরিপূর্ন ছেলের কাজ করতে সাহায্য করেছে। কাকতালীয় ঘটনাই হোক আর যাই হোক এই কাগজটাই তার মাকে আবার কাছে টেনে আনতে সাহায্য করেছে, তার স্ত্রীকে পরিবর্তন হতে বাধ্য করেছে – সর্বোপরি, ফিরিয়ে দিয়েছে তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া প্রশান্তিকে।
লেখক: রাফায়েত রহমান রাতুল
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/সিধু/এসবি