অসমাপ্ত ভালোবাসার নীল গোলাপ
পাঠকই লেখক ডেস্ক : দেরীতে ঘুম থেকে ওঠাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। প্রতিদিন ১০টায় আমার সকাল হয়। আর বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে ১১টা বেজে যায়।
আজ হঠাত কোন এক কংসমামা আমার সুখের সংসারে আগুন ধরিরে দিল। দিব্যি ঘুমাচ্ছিলাম। সকাল ৭টা থেকে লোকটা আমার দরজায় এসে অবিরাম কড়া নেড়ে যাচ্ছে। আধাঘণ্টা পার হয়ে গেলো তবুও লোকটি ক্লান্ত হল না। তিনি রবার্ট ক্লাইভের নীতি মেনে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অবশেষে যখন ১ ঘন্টা পার হবার উপক্রম তখন আমার বোধদয় হল। বুঝতে পারলাম নিশ্চই গুরুত্বর কিছু হয়েছে। হয়ত বাইরে পুলিশ এসেছে নয়ত অন্য কোন দুঃসংবাদ। যাক, চিন্তা ভাবনার সময় আর দীর্ঘস্থায়ী না করে ধীরে ধীরে গিয়ে দরজা খুললাম।
- শুভ সকাল। কথাটা খুব হাসিমুখেই বললেন তিনি। অথচ তার উচিৎ ছিল দরজা খোলার সাথে সাথে আমার গণ্ডদেশের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক সেখানে একটা কম্পনের সৃষ্টি করা, যা প্রথমে শব্দের সঞ্চার করবে তারপর আস্তে আস্তে আগুনের মত লাল বর্ণ হবে। লোকটা ধৈর্যশীলতার তারিফ না করে পারা যায় না। কারন তিনি এমন কিছুই করলেন না। এমনকি তার মুখের বিরক্তির ছাপটুকুও নেই।
লোকটা আমার দিকে একটা ডায়েরি এগিয়ে দিলেন। কেউ কোন কিছু ফ্রীতে দিলে আমি অকারণেই খুশি হই, এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু আমার আনন্দভরা মুখ মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেলো যখন দেখলাম ডায়েরীটা পুরনো।
লোকটা বলল," এটা আপনাকে একজন পাঠিয়েছেন। অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। আমি এখন আসি।"
আসি বলেই লোকটা চলে গেলো।
আমি ডায়েরীটা বিছানার ওপর রেখে নাস্তা করতে গেলাম। আমি ব্যাচেলর মানুষ। অফিসের জন্য রেডি হয়ে বের হই আর পথিমধ্যে নাস্তা করে নিই। রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরলাম। এর মধ্যে ডায়েরীটা কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসায় এসে দেখি ডায়েরীটা বিছনার ওপরই আছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে ডায়েরীটা খুললাম।
০২/০১/২০১২
আমি নূপুর। মা'এর দেওয়া নাম। ছোটবেলা থেকেই আমি ডায়েরী লিখতাম। ডায়েরী লিখতে আমার খুব ভাল লাগতো। আমি আমার সব আনন্দের মুহূর্তগুলো ডায়েরীর পাতায় বন্দী করে রাখতাম। যখন দুঃখ-কষ্ট এসে আমাকে গ্রাস করার চেষ্টা করত তখন ডায়েরীর পাতায় চোখ বুলাতাম। এগুলো আমায় আনন্দ দিতো।
অনেকদিন থেকে ডায়েরী লেখা বাদ দিয়েছি। আজ আবার লিখতে বসেছি। কারন এই ডায়েরীটা আমাকে আমার খুব কাছের বন্ধু দিয়েছে। ওর নাম নীল। আমি ওকে নীলু বলে ডাকি। ওর জন্য আমার ডায়েরী লেখার নেশাটা আবার শুরু হল। ধন্যবাদ তোমাকে বন্ধু।
১৪/০২/২০১২
আজ ভালোবাসা দিবস। দিনটা আমার জন্য খুব স্পেশাল। আজ ও আমাকে ৫টা নীল গোলাপ দিয়েছে। আমি আজ অনেক খুশি। আমার মত খুশি আজ পৃথিবীতে কেউ নেই। না চাইতেই আমি অনেক বড় একটা জিনিস পেয়েছি, এটা আমি হারাতে চাই না। ও ওর নামি তো বলা হল না। ওর নাম কবির। সবাইকে একটু আলাদা নামে ডাকতে আমার খুব ভালো লাগে। ওকেও আমি অন্য নামে ডাকি। কবি বলে। কিন্তু ও আবার কবিতা লিখতে পারে না।
নীল অনেক সুন্দর কবিতা লেখে। এসব ও ওর ডায়েরীতে লেখে কিন্তু আমাকে কোনদিন পড়তে দেয় নি। আমি ওর এত ভালো বন্ধু আর ও আমার কাছেই লুকায়। একবার জোর করেছিলাম বলে ও আমার জন্য প্রতিদিন কবিতা লিখে নিয়ে আসতো। কিন্তু ওসব ওর ডায়েরীর কবিতা ছিল না। আজ আমার এত স্পেশাল একটা দিন গেলো অথচ আজ নীলের সাথেই দেখা হল না। ওকে কতবার যে ফোন দিলাম, ধরলো না।
১৭/০৪/২০১৩
আজ আমাদের রিলেশনের ১ বছর হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম সারা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবো, বিয়ে করব না। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর পারলাম না। বাসায় আমার বিয়ের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমার পক্ষে সব কিছু সাম্যাবস্থায় রাখা মুশকিল হয়ে পরছিল। কবি'কে বার বার বললাম, চল, পালিয়ে বিয়ে করি। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হয় না।
১০/০৫/২০১৩
শেষপর্যন্ত আমাদের পালিয়েই বিয়ে করতে হল। নীল আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। বিয়ের পর ট্রেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত ও আমাদের সাথেই ছিল। ট্রেনে ওঠার সময় যখন ওর কাছ থেকে বিদায় নিব তখন পিছু ফিরে দেখি ও নেই। এমন তো ওর করার কথা নয়। হয়ত আমি চলে যাচ্ছি বলে ওর খারাপ লাগছে। ট্রেন যখন ছেড়ে দিলো তখন দেখলাম ও দৌড়ে এসে আমার হাতে একটা ডায়েরী এগিয়ে দিলো। সেদিন আমি ওর চোখে জল দেখতে পেয়েছিলাম কিন্তু জিজ্ঞেস করার আগেই ট্রেনটা ছেড়ে দিলো।
১৪/০৩/২০১৪
কবি কেমন যেন পালটে গেছে। আগের মত আর নেই। আমার সাথে আর ভালো করে কথা বলে না। অকারণে আমার সাথে ঝগড়া করে। কিন্তু তবু আমি ওকে ভালবাসি।
আজ বিয়ের এক বছরের মত পেরিয়ে গেলো। ভেবেছিলাম বাসা থেকে সবাই মেনে নিবে কিন্তু তেমনটা হল না। নীল অনেক চেষ্টা করেছিল বাসায় বুঝানোর কিন্তু ওরা ওকে অনেক অপমান করেছে। বেচারা নীলের জন্য খুব খারাপ লাগছে!
২৮/০৪/২০১৪
কবি'র ব্যবহার দিন দিন পশুর মত হয়ে যাচ্ছে। আজ ও নেশা করে বাড়ি ফিরেছে। নেশার ঘোরে আমাকে বলেছে ও নাকি আমাকে বিয়ে করে কিছুই পায় নি। আমি তো ওকে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দিতে পারব না। আর বিয়ের আগে ও তো শুধু আমার ভালোবাসাই চেয়েছিল। এখন তাহলে কি হল!
আজ আর ঘুম আসছে না। খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ব্যাগের ভেতর থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে হঠাত নীলের দেওয়া ডায়েরীটা চোখে পড়লো। বুঝতে পারলাম এটা ওর সেই কবিতা লেখার ডায়েরীটা। মন ভালো হয়ে যাবে ভেবে ডায়েরীটা পড়তে শুরু করলাম।
ডায়েরীর প্রথম পাতায় ছিল শুকিয়ে কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। নিচে লেখা, "আজ ওকে আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিলাম। ওর জন্য একটা নীল গোলাপ কিনেছি ওকে দেবো বলে। কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেলাম ওর এক হাতে পাঁচটা নীল গোলাপ আর এক হাত ধরে আছে কবির। দুইজন লেকের ধার দিয়ে হাঁটছে আর হাসাহাসি করছে।
নূপুর আমাকে কেন বলে নি ও কবিরকে ভালোবাসে। ওর প্রেমে পড়ার অনুভূতিগুলো যখন আমাকে বলতো তখন ভাবতাম ও আমার জন্য এসব অনুভব করে। আজ বুঝলাম সেগুলো কবির'এর জন্য। হাহাহা...। আমি কত বোকা।
নূপুর আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আর আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না। তাই ওর সাথে দেখা না করেই চলে আসি। ভালোবাসা অনেক নিষ্ঠুর, কাউকে হাসায় আবার কাউকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ডায়েরীতে লেখা কবিতাগুলো আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। যার জন্য এসব লিখেছি সেই এখন অন্য কবির কবিতার লাইন হয়ে গেছে।"
নীলের ডায়েরীটা পরে অবাক হয়ে যাই আমি। ও আমাকে ভালোবাসতো অথচ আমি কখন বুঝতেই পারি নি। তাহলে রাত জেগে আমার জন্য নোট করে দেওয়া, অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আমার জন্য কলেজে আসা, রাস্তার ছেলেদের সাথে মারামারি করা, পরীক্ষার সময় নিজে না ঘুমিয়ে আমাকে ভোর বেলা ডেকে তুলে দেওয়া- এসবের কারণ কি তাহলে এটাই ছিল?
আমি হয়ত বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। দোষটা নীলেরই। ও বলতে দেরি করায় কবির সে জায়গা দখল করে নিয়েছে। আর আমি ওকে আমার প্রিয় বন্ধুর জায়গাতেই রেখেছি।
ডায়েরীর মাঝের পাতায় আর কিছু লেখা নেই। শেষের দিকে লেখা, "বুকে পাথর দিয়ে কষ্টগুলো চেপে রেখেছি। কাল ওরা বিয়ে করছে। আমি চাই নি এই মুহূর্তটার সম্মুখীন আমি হই। কিন্তু নূপুর আমাকে থাকতে বলেছে। তাই কষ্ট হলেও আমাকে ওদের সাথে থাকতে হবে।
কালকের পর হয়ত নুপুরের সাথে আর দেখা হবে না। বুকের ভেতরটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু আমি ওদের ভালোবাসায় কাঁটা হতে চাই না। ভালো থেকো, নূপুর। সুখে থেকো।"
২৯/০৪/২০১৪
আজ কেন জানি নীলের কথা খুব মনে পড়ছে। কবিরকে বললাম, চল, নীলের সাথে দেখা করে আসি। ও তো আমাদের অনেক উপকার করেছে। কবির আমার ওপর রেগে গেলো। আমাকে যা নয় তাই বলে গালি-গালাজ করল। যখন আমার বাবা-মা'কে নিয়ে খারাপ কথা বলতে শুরু করল, আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। প্রতিবাদ করি আর সেটাই আমার অন্যায় হয়ে যায়। ও আমার ওপর হাত তুলল, শুধু তাই নয় আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিলো। সারারাত আমি বাইরে বসে কাটালাম।
আমি কবিরকে অনেক ভালোবাসি। এখনও ভালোবাসি। আমি জানি, ও ওর ভুল ঠিক বুঝতে পারবে। ডায়েরীতে আর কিছু লেখা ছিল না। শেষের পাতায় একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। লেখাগুলো অন্য রকম, নুপুরের হাতের লেখার মত নয়।
"নূপুর এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। আজকের রাতটা ও পার করতে পারবে কি না তা নিয়ে ডাক্তাররা সন্দিহান। চলে যাবার আগে ও একটি বার তোমার সাথে দেখা করতে চায়। নিচে ঠিকানা দেওয়া আছে, পারলে একটি বার এসে দেখে যেও।"
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চারিদিক কেমন অচেনা লাগছে। মাথা ঝিম মেরে আসছে। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাত ফোন বেজে উঠলো,
-হ্যালো, নীল সাহেব বলছেন??
- জী, বলছি।
- আপনি একটু তাড়াতাড়ি আমাদের হাসপাতালে চলে আসুন। নূপুরের ম্যাডামের অবস্থা ভালো না।
ফোনটা কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে বের হলাম। বাসার দারোওয়ান আমাকে দেখে বলল যে সকালে এক লোক নাকি আমার ফোন নাম্বার নিয়ে গেছে। আমি আর দেরি করলাম না, তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে ঢোকার সময় দেখি একজন লোককে তিনজন পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে গাড়িতে তুলছেন।
চিনতে খুব একটা কষ্ট হল না যে এই সেই কবির। জানতে পারলাম, প্রতিদিন নেশা করে এসে নূপুরের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাত সে। বার বার বলতো বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে কিন্তু নূপুরের সাথে ওর বাবা-মা সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাই ওকে প্রতিদিন এসব অকথ্য নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হত।
কয়েকদিন আগে সে নাকি নুপুরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে গেলো নূপুর এখন মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় পরে আছে।
নূপুরের কাছে গেলাম। ওকে দেখে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করল। এতদিন পর আজ নুপুরকে সামনে পেয়েও খুশি হতে পারছি না। কিছু
কিছু হারানো জিনিস খুঁজে পেলে যে সেটা অপরিসীম কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা আজ বুঝতে পারছি।
নূপুর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। ও কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না। শুধু চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ওর হাত স্পর্শ করলাম। ওর হাত বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
কাঁপা কাঁপা গলায় নূপুর আমাকে বলল,"আমাকে মাফ করে দাও।"
কথাটা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কষ্টের পরিমান এতটাই বেশি যে সেগুলো আমার মুখের কথাকে আটকে রেখেছে।
নূপুরের দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর চোখের পাতা নড়ছে না। নূপুরের মুঠো করা হাত আমি ধরে রেখেছি। ওর হাতের ভেতর
গোলাপ ফুলের কয়েকটি শুকনো পাঁপড়ি।
লেখক: মিরাজ উল কবির