লাভ এ্যাট থার্ড সাইট
পাঠকই লেখক ডেস্ক : কেবল ৬.৩০ এত সকালে ভার্সিটিতে গেলে কাক পাখি ছাড়া আর কিছু মিলবে না খুব অস্থির লাগছে তার উপর সারা রাত ঘুম হয়নি আবিরের ।বার বার মায়াবতী কন্যার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। হলুদ শাড়িতে তাকে কাল অপূর্ব সুন্দরী লাগছিল। মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে হলুদ একটি পরী নেমে এসেছে তার সামনে। আর কপালের মাঝে লাল টিপ ইরার সৌন্দর্যকে যেন পূর্ণতা এনে দিয়েছিল।
-- কি রে ভাইয়া আজ এত তাড়াতাড়ি উঠলি যে? সূর্য কি আজ উল্টা দিক থেকে উঠল ?
= ধুর ! ফাজলামো করিস না তো
-- চেহারা দেখেতো মনে হচ্ছে সারা রাত ঘুমাস নাই! শরীর খারাপ করল নাকি ?
=আর ঘুম!অনেক নার্ভাস লাগছে ! ইরাকে গতকাল চিঠিটা দেওয়ার পর থেকে চিন্তায় আমার খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে গেছে ! ও যদি রাগ করে? তুই ওর রাগ চিনিস না !
--আচ্ছা তুই আজকে তোর রহস্যের সমাধান কর তো। মেয়েটার সাথে তোর পরিচয় কিভাবে? ইরার প্রেমে পরলিই বা কিভাবে তাও তোর মত ছেলে যে কিনা কখন প্রেমে পরবে না। ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন না? =কেমন কেমন না মানে কি। আমি কি রোবট নাকি? আমি কি ভালবাসতে পারি না? কি আজিব! --আরে না সেটা হবে কেন?
আগে তো সেরকমই ছিলি কখনো প্রেম করবি না। প্রেম করা মানে টাইম নষ্ট, এইটা সেইটা......তো এখন কি =ধুর ব্যাটা, তুই বেশি বুঝিস যাহ তোকে কিছু বলব না। --না না সরি ভাই, বল না আমি শুনতে চাই, আমি আর বেশি বুঝব না, কিছু বলব না তুই বল =আচ্ছা বলছি। ইরার সাথে আমার দেখা হওয়া কোন সিনেমা কিংবা গল্পের কাহিনীর মত নয়।
কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে ওর সাথে আমার পরিচয়। আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তবে ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। আমাদের পরীক্ষার পর যখন ক্লাস শুরু হল সেদিন পড়ন্ত বিকেলে ওকে প্রথম দেখি। গল্প করছিল অরুন আর কয়েকজন বন্ধুর সাথে। ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবাই কথা বলল। কিন্তু মেয়েটা আমার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা তাকালোই না। মনে হল মেয়েটা ভাব নিচ্ছে।
তাই আর কিছু না বলে চলে এলাম। আরেকদিন অরুন আর কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম দেখি পাশে বসে একটি মেয়ের সাথে গল্প করছে আর খিলখিল করে হাসছে। এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে আর ঠোঁটের কোণে টোল পরছে। মেয়েটাকে দেখে মনের মাঝে কেমন যেন একটু ভালোলাগা জন্ম নিল।
কিন্তু ভালোলাগা থেকে অভিমানের পরিমাণটা মনে হয় বেশিই ছিল তাই তো অভিমানের কাছে ভালোলাগাটা তেমন পাত্তা পেল না। যে দুইদিন ইরাকে দেখেছি বিশেষ ভাবে তেমন কিছুই মনে হয় নি। সবসময় সিম্পল সাদামাটাভাবে চলাফেরা করত, লম্বা চুলগুলো বেঁধে রাখত। কিন্তু একটি দিন আমার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। অরুনকে খুঁজতে এসে দেখি ইরা একটি মেয়ের সাথে বসে মোবাইল টিপছে।
যেহেতু ওর কাছে উত্তর পাওয়ার কোন আশা নেই তাই বাধ্য হয়ে ওর পাশে বসা মেয়েটিকেই জিজ্ঞেস করলামঃ =আচ্ছা অরুন কই জানো? --অরুন একটু বাইরে গিয়েছে। ওর আসতে একটু দেরী হবে! আমি অবাক হয়ে তাকাতেই দেখি ইরা আমার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে ওর উত্তর পেয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আরো পাগল হয়ে গেলাম যখন ওর কাজল দিয়ে আঁকা চোখের দিকে তাকালাম। মানুষের চোখ এত সুন্দর হতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। আমি ওর চোখের দৃষ্টিতে আমার সর্বনাশ দেখছি। মনের মধ্যে আশ্চর্য রকমের ভালোলাগা কাজ করছে। ইরা লক্ষ্য করেছে কিনা জানি না আমি পুরো একটি ঘণ্টা চুপিচুপি ওর চোখ আর হাসির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
মনে হচ্ছিলো আমার পাশে এক মায়াবতী কন্যা বসে আছে যার চোখে আর হাসিতে মায়ার আলো বেয়ে পড়ছে। তারপর.........এই দাড়া এক মিনিট,গল্পের মাঝপথে থামিয়ে দিল সৌরভ --ভাইয়া মায়ার আলো কিরে? জীবনেও তো শুনি নাই। =এসব বুঝবি না তুই শোন তো --আচ্ছা বল সারাক্ষণ মেয়েটার কথা ভাবলাম। নাহ ইরাকে ছাড়া থাকা সম্ভব হবে না। ওকে বলতে হবে।
কিন্তু পরে আবার ভাবলাম এভাবে বললে মনে করবে আমি ভালো ছেলে না উল্টো আরও কথা শুনতে হবে। পরে অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করলাম। ফেসবুকে ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অরুনের বদৌলতে ওর নামটা জানা ছিল। ইরা লিখে সার্চ দিলাম। অনেকক্ষন খুঁজাখুঁজির পর আমার সেই মায়াবতীর চেহারাটা দেখতে পেলাম।
মনে হল খুশিতে পাগল হয়ে যাই। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিলাম। কেন জানি মনের মধ্যে বিশ্বাস ছিল ইরা আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করবে। কিন্তু যখন দেখলাম সকাল পার হয়ে, দুপুর গড়িয়ে রাত হয়ে গেল কিন্তু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে নি তখন আমার বিশ্বাস ফিকে হয়ে এল। মন এত খারাপ হল যে বলার মত নয়। মন খারাপ নিয়েই ঘুমিয়ে পরলাম।
সকালে উঠে যথারীতি ফেসবুকে গিয়ে দেখি ইরা রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। খুশিতে আমার শূণ্যে ভাসার মত অবস্থা। । ওর প্রোফাইলে গিয়ে দেখি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে- " I am in an imaginary relationship and its complicated." স্ট্যাটাসটা দেখে মজা লাগল। ইরা মনে হয় আমার মতই পাগল।
এভাবে হাসিখুশিতে পুরোদিনটা পার করলাম। রাতে ফেসবুকে গিয়ে দেখি ইরার নামটা চ্যাট লিস্টে দেখাচ্ছে। বুকটা ধক করে উঠলো। নক করব কি করব না ভাবতে ভাবতে এক সময় দেখি মনের অজান্তেই "হাই" লিখে নক করে বসে আসি। কিছুক্ষন পর রিপ্লাই এলো --হাই। =কেমন আছো?
--এইত ভালো। তুই? =আমিও ভাল। --আচ্ছা শোন তুই যেহেতু আমার ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড সেহেতু তুই আমারও ফ্রেন্ড তাই এত ফর্মালিটি দেখাতে পারব না।
তুই করেই শুরু করলাম। আশা করি মাইন্ড করিস নি। =না না মাইন্ড করার কি আছ!!! --তাহলে তো ভালই। আচ্ছা কি করিস? =চ্যাট করি। তুই? --আমি ভাবি =তুই আবার ভাবিস নাকি? --আজকে থেকে তো আমাদের ফ্রেন্ডশিপ শুরু হল। সময় হলে দেখবি আমি কত ভাবতে পারি! কোন মেয়ে কাওকে এত জলদি আপন করে নিতে পারে এই প্রথম দেখলাম।
এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলা শুরু হয়। আমি আসলেই ভুল ছিলাম ভাবতাম যে মেয়েটা অনেক ভাব নেয়। কিন্তু সেরকম কিছুই না। তবে মেয়েটা অনেক মজার। সবসময় দার্শনিক টাইপের স্ট্যাটাস দিত। স্ট্যাটাসগুলো এত সুন্দর যে বলার বাইরে।
ইরার একটি স্ট্যাটাস আমার সবচেয়ে প্রিয়- "তোমার সাথে আমি কখনও নামীদামি রেস্টুরেন্টে যেতে চাই না বরং পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদের আলোয়ে তোমার হাত ধরে হাঁটতে চাই। ভালোবাসা দিবসে তোমার কাছ থেকে আমি হীরের আংটি চাই না, শুধু কয়েক গাছি লাল চুড়ি আর একটি লাল গোলাপ চাই। আমি তোমার কাছে কখন সুন্দর উপহার চাই না, তবে আমার খোপায় জড়িয়ে দেয়ার জন্য বেলিফুলের মালা আমার চাই।"
ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। আমরা অনেক ভাল বন্ধু হয়ে যাই। মনের যত কথা আছে ওর কাছে না বললে আমার শান্তি লাগেই না। ইরা আর আমি যখন একসাথে হই তখন আমাদের খুনসুটি দেখে কে! একদিন পাগলীটা আমার উপর এতই রাগ করল যে আমার খাতার সব পৃষ্ঠা ছিঁড়ে এতোগুলো নৌকা বানিয়ে ফেললো। আমি ওর নৌকাগুলো অনেক যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
একটুও নষ্ট হতে দেই নি। জানিস সৌরভ যতদিন যাচ্ছে আমি মেয়েটাকে আরও ভালবেসে ফেলছি। ওকে ছাড়া থাকা এখন আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। --তুই ইরাকে এত ভালবাসিস? =হুমম --তো বলে দিস না কেন? =আরে গাধা চিঠিতে তো সেইটাই লিখেছি! -- শেষ পর্যন্ত চিঠি? ! = কি করব বল ?! মেয়েটার রাগটাকেই যত ভয় আর কিছু না।
হঠাৎ ঘড়ির দিক চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠে আবির! ৯টা বেজে গেছে! ভাইয়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে কোন রকমে পাঞ্জাবিটা গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ল! গতকাল ভার্সিটি শেষে ইরার হাতে খামটা দিয়েই দৌড়ে চলে আসছিল । ইরা অনেক বার ডাকলেও পিছনে ফিরে তাকায় নি ! এদিকে আবিরের কাছ থেকে এরকম একটা খাম পেয়ে ইরা কিছুটা অবাক । ছেলেটা আসলেই একটা পাগল! কখন যে কি করে বসে না ?!
খামটা খোলার জন্য উৎসুক মন নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল ইরা । বাসায় ফিরেই সব কাজ বাদ দিয়ে আগে খামটা খুলতেই ভিতরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটি চিঠি আর একটি নৌকা আবিষ্কার করল
“প্রিয় মায়াবতী কন্যা, তোর ওই ভয়ংকর রাগের কথা ভেবে একটা কথা অনেক দিন থেকে বলার সাহস হয়ে উঠেনি। তাই চিঠির আশ্রয় নিলাম। মানুষ সবসময় লাভ এ্যাট ফাস্ট সাই্টের কথা বলে, কিন্তু আমার সাথে ঘটেছে পুরোপুরি উল্টো ঘটনা। জানিস যেদিন আমি তোকে প্রথম দেখি আমার মনে হয়েছিল তুই অনেক ভাব নিস।
তবে তৃতীয় বার দেখার পর তোর কাজল টানা মায়াবি চোখ আর গালের ওই সুন্দর টোলের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। ধীরে ধীরে যখন তোর সাথে আপন হতে শুরু করলাম তখন বুঝলাম আমার ধারনা ভুল । বরং মানুষকে আপন করে নেয়ার অপূর্ব ক্ষমতা তোর মাঝে দেখে আমি অবাক হয়েছি। তোর কি মনে আছে সেই নৌকাগুলোর কথা? যেগুলো আমার খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে বানিয়েছিলি? আমি সেগুলো আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
আচ্ছা তুই তোর নৌকায় আমাকে একটু ঠাই দিবি? জীবনের আর একটি নতুন বসন্তের শুরুতে ভাবনার অতীত রূপকথার রাজকন্যা ও কাঠুরিয়ার গল্পের মত অসম্ভব কিছুর প্রত্যাশায় থাকব.................” আজ ভালবাসা দিবস। আবিরদের ভার্সিটিতে চারিদিকে আজ লাল রঙটির সমারোহ। যে যার নিজের মত করে দিনটিকে বরণ করে নিচ্ছে ।
যেখানে ইরার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আবির সেখানে দাড়িয়ে তার মায়াবতীকে খুঁজছে আর সাত-পাঁচ ভাবছে,জীবনের ২৪তম বসন্তটাকে সে কি একটু অন্যভাবে পাবে? পিছন থেকে হঠাত ইরার ডাকে তার ভাবনায় ছেদ পড়ল... আবির চোখ ফেরাতে পারছিল না তার মায়াবতী কন্যা যে লাল অপ্সরী সেজে তার সামনে দাড়িয়ে আছে………..
-- ওই এইখানে ষাঁড়ের মত দাড়িয়ে আছিস কেন? = কিছু না এমনিই !!! -- এরকম গাধার মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখিস? =কই তাকিয়ে আছি। তুই না বেশি বুঝিস ! --হুম আমি তো বেশিই বুঝি! আচ্ছা ,চিঠির শেষে কি হয় তা কিন্তু তুই লিখিস নাই =অতঃপর রাজকন্যা ও কাঠুরিয়া একত্রে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল !! -- হুম অসম্ভব প্রত্যাশা!!! আবিরের খুব কষ্ট হচ্ছে।
ইরার সামনে থাকার মত শক্তিটুকু তার নাই এখন = আমি একটু ওই দিকটা দেখে আসি বলেই আবির ইরার জন্য আনা দুটো গোলাপ তাকে না দিয়েই চলে আসল ক্যাম্পাসের বড় শিমুল গাছটার নিচে । খুব কান্না পাচ্ছে আবিরের। হঠাত আবির তার হাতের মাঝে কোমল স্পর্শ অনুভব করল । হ্যাঁ ! তার মায়াবতী কন্যা তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। -আচ্ছা গোলাপ দুটো কি হাতে রাখবে নাকি আমাকে দিবে? -মানে? -মানে কি? গোলাপফুল কি অন্যকারো জন্য? আমাকে চিঠি লিখে অন্যকারো জন্য গোলাপফুল? আবিরের মুখে হাসি।
পরমভাবে চাওয়ার কিছু পেয়ে গেলে মানুষের চোখ যেভাবে খুশীতে ভিজে তারও ভিজে উঠল। আচ্ছা আবিরেরর মত করে কি ইরাও কাঁদছে!? কাদলে, কাঁদুক না ! তাদের দুজনের ভালবাসা মিশে এক হয়ে যাক অশ্রু জলের প্রতিটি কণায় আর তাদের অনুভূতি জেগে থাক রাতের বুকে জেগে থাকা চাঁদের মত করে । কারণ কিছু ভালবাসা প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে না অনুভূতিই তাদের মাঝে কথা বলে !
লেখক: তাসনিম হক মুনা