রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:০৭:২৭

বিয়েতে বিবাহবার্ষিকী

পাঠকই লেখক ডেস্ক : সবেমাত্র অনার্স শেষ করে মাস্টার্স শুরু করেছি। বিয়ের জন্য তোরজোড় শুরু করলেন আব্বা। আম্মা আর আত্মীয়-স্বজন মারফত আব্বা হুজুরের কানে পাঠালাম আমি বিয়ে করবোনা। কারণ পিতাজির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করার সাহস তখনো হয়নি। যাইহোক কিছুদিন উনাকে এড়িয়ে চললাম। পারতপক্ষে সামনে গেলামনা। তবে বেশীদিন এই লুকোচুরি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলোনা। একদিন রাত্রিবেলা বাসায় ঢুকার সময় উনার হাতে ধরা পড়ে গেলাম। উনি সম্ভবত আমার অপেক্ষাতেই করিডরে পায়চারি করছিলেন।
-রাত কয়টা বাজে?
-আমার মোবাইলের টাইম ঠিক নাই আব্বা।
ঢাহা একটা মিথ্যা বলে দিলাম।
উনি তখন উনার শ্বশুর মশাইয়ের দেয়া ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন-
মোবাইলটা বের করে টাইম ঠিক করে নাও। রাত ১১টা বেজে ২৬ মিনিট।
আমি মোবাইলটা বের করে ডিস্পলেতে একটু ঘসাঘসি করলাম।
-খাওয়া দাওয়া করে এসেছ নাকি খাবে?
রাতে আমি কখনোই বাইরে খাইনা। তবুও বললাম খেয়ে এসেছি।
-আমি তো জানি তুমি বাইরে খাওনা আজ বাইরে খেলে যে?
এ কোন মুসিবতে পড়লামরে বাবা। সত্যিইটাই বললাম এবার- আমি খেয়ে আসিনি।
-আচ্ছা যাও খেয়ে দেয়ে একটু ড্রইংরুমে এস, কথা আছে।
কি কথা আছে সেটাতো আমি ভালো করেই জানি।

-তুমি নাকি বিয়ে করতে চাচ্ছনা?
-না।
-কেন জানতে পারি?
-পড়াশুনা শেষ করিনি, চাকরি বাকরি করিনা তাই।
-বয়স কত হয়েছে খেয়াল আছে, তোমার আম্মা একা একা আর কত এই সংসারের ঘানি টানবে? তোমার বয়সে যখন আমি ছিলাম তখন তোমার প্রাইমারীতে যাওয়ার বয়স হয়ে গেছে।
আপনার সময় আর আমার সময়ে বিস্তর ফারাক। পিতাশ্রীকে কথাটা বলার লোভ অনেক কষ্টে সংবরণ করলাম।
-আব্বা স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করা ঠিক না। বউকে খাওয়াব কি?
-তুমি কি খাও তাই খাওয়াবে নাকি তোমাকে হাতি বিয়ে করতে বলছি যে প্রতিদিন কলাগাছ এনে খাওয়াতে হবে?
আব্বারে ক্যামনে বুঝাই অনেকটা হাতির মতই বউ চালানোর খরচাপাতি।
-আমাকে তো আপনি খাওয়ান।
-তো তোমার বউকে আমি খাওয়াবনা কখন বললাম?
রক্ষা কর মাবুদ। ইনার এইসব প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেব?
-আমাকে তো পেলেপুলে বড় করেছন এখন আমার বউকেও যদি আপনি খাওয়ান তাহলে লোকে বলবে কি আর আমিই বা পড়াশুনা করছি কেন?
-দু দিন পর পর মোবাইল চ্যাঞ্জ করছ, অমুক জায়গায় তমুক জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছ কার পয়সায়? বলি সেসব টাকা পয়সা কোন লোকে দেয়?
পিতাশ্রী মোক্ষম জায়গায় টান দিয়েছেন। আমার কোন জবাব নেই।
-বি প্রিপেয়ারড ম্যান্টালি। আগামীকাল থেকে তোমার বিয়ের কার্যক্রম শুরু। যাও ঘুমাও গিয়ে।
আম্মা দেখি অপাশের ঘরে বসে মুচকি হাসছেন।
-হাস হাস আমি বিয়ে করে বউ তোমাদের ঘাড়ে ফেলে গৃহত্যাগী হব।
-সমস্যা নেই, তুই ঘরে থাকা না থাকা সমান। বউমা চাই আমাদের।
এতবড় অপমানজনক উত্তরের পর আর কিছু বলার মনোবল পেলামনা।

অবশেষে আমার বিয়ে হয়ে গেল। প্রেমটেম জীবনে করা হয়নি। বান্ধবী অনেকেই ছিল কিন্তু প্রেমিকা ছিলনা একটাও। যদিও আমার বান্ধবীদের অনেকেই প্রেমিকা ভাবতো কিন্তু আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সবার ধারণা পাল্টাল। আমি কোন কাজের ছেলে না সবাই একযোগে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল। আসলেইতো প্রেম করতে না পারা মানুষগুলো কোন কাজের নাকি।
সে যাই হোক আমার সৌভাগ্যবতী নাকি দূরভাগ্যবতী বউ বলব বুঝছিনা উনি এইচ এস সি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবার যুদ্ধে নেমেছিলেন। সে যুদ্ধে জয়লাভের আগেই তিনি আমার বউ পদে নিয়োগ পেলেন। এই চাকরি পেয়ে উনি কতটা খুশী ছিলেন কে জানে তবে আমি বেশ ভজগটের মাঝে পড়ে গেলাম। ভজগট শব্দের মানে আপনারা নিজ দায়ীত্বে বুঝে নেবেন।
নতুন বউ আমার মাথায় ইয়াবড় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে এমন দৃশ্য কল্পনা করতে করতে বাসর ঘরে ঢুকতে যাব কিন্তু আবিষ্কার করলাম দরোজাটা ভেতর থেকে বন্ধ! ভাবলাম নতুন বউকে কেউ কোন টিপস শিখিয়ে দিচ্ছেন। মা, চাচি বা ভাবি টাইপ কেউ হবেন হয়তো। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে দুরজায় টুকা দিলাম।
সাথে সাথে ভেতর থেকে কেউ তীক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল-কে?
ভ্যাবাচেকা খেলাম। কারণ নিজের ঘরে প্রবেশ করার সময় পরিচয় দেয়ার অভিজ্ঞতাতো এই প্রথম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম-জ্বী আমি।
-জ্বী আমি কে, নাম নেই?
মেজাজটা গেল গরম হয়ে।
-না নাম নেই। দরজা খোলার প্রয়োজনও নেই। গুড বাই।
জোরে জোরে কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে আসব দেখি আমার আব্বা অদূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন। আমি খুব অপমানিত বোধ করলাম। শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম- হুহ বিয়ে না করলেই নয় যেন। প্রথমদিনই এই অবস্থা।
আব্বা হুজুর আমার কথা না শুনার ভান করে চলে গেলেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা প্রয়োজনীয় বিনোদন তিনি পেয়ে গেছেন।
-এই যে আস।
নারীকণ্ঠ শুনে আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার নতুন বউ দরজা খোলে আমাকে ডাকছেন। উনার মাথাটাই শুধু দেখা যাচ্ছে।
-আসতে পারবোনা, আমি ছাদে যাচ্ছি।
-ঠিক আছে আমিও আসছি, আমি শাড়িটা চ্যাঞ্জ করে আসছি, একটু অপেক্ষা কর।
কি বলে এই মেয়ে! আমি গিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
-তুমি আসলে কেন আজিবতো! বললামনা আমি কাপড় চ্যাঞ্জ করব?
আমি হা করে বউয়ের দিকে তাকিয়ে তাকলাম। আগেও দেখেছি দুয়েকবার কিন্তু আজ যেন সাক্ষাৎ পরীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাহ আমার বউটা তো বেশ সুন্দর।
-কি হক এভাবে আহাম্মকের মত তাকিয়ে আছ কেন, বাইরে যাও।
প্রায় আমাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেয়া হল।
পৃথিবীর কোথাও বাসর ঘরে এমন ভাবে নতুন বউয়ের কর্মকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে হয়না।

মিনিট কয়েক পর উনি দরজা খোলে বের হলেন। শাড়ি আর ভারী গহনাগাঁটি খোলে এসেছেন। একটা জামদানি থ্রী পিছ গায়ে তার। পিংক কালারের খুব সম্ভবত। আমি আবার রং চিনিনা। সাদা, কাল আর হলুদ এই তিনটা একটু বেশী বুঝি। মাঝে মাঝে তাতেও তালগোল পাকে। অফহোয়াইট, খয়েরী, অরেঞ্জ,টিয়া এসব বুঝিনা। যাই হোক আমার বউ বের হয়েই আমাকে বলল-আমি শাড়ি টারি একদম পড়তে পারিনা। প্লীজ কখনো অনুরোধ করনা।
আমি কিছু বললাম না, কারণ শাড়ি আমারও পছন্দ না।
-এই ছাদে যাবার আগে কিছু খাবার নিয়ে আস, খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ছাদে বসে খাওয়া যাবে।

আমাদের ছাদের দক্ষিন পাশে একটা ছাউনির মত ঘর আছে। চারপাশেল দেয়াল নেই কিন্তু উপরে ছাদ আছে। তার নীচে চারটি চেয়ার আর একটি টেবিল। আব্বা প্রায়ই এখানে বসে চা খান, মাঝে মাঝে আম্মাকে নিয়েও গল্প করেন। নতুন বউকে নিয়ে সেখানেই বসলাম। এখন পর্যন্ত ওর সাথে আমার কোন স্বাভাবিক আলাপ হয়নি। সামনা সামনি চেয়ারে বসলাম আমরা। আমি ইচ্ছে করেই ছাদের বাতিটা দেইনি। আকাশে চাঁদ আছে যদিও মেঘের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বেচারা হয়রান। মেঘেদের দল যেন চাঁদের সাথে ফাজলামো করছে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলো এসে পরছে আমার বউয়ের মুখে।
আর ধুর আমি তো এতক্ষন ধরে ওর নামটাই বলিনি। ওর নাম প্রিয়ন্তি।
-প্রিয়ন্তি বড্ড কঠিন নাম, আমি বরং তোমাকে প্রিয়া বা অন্তি বলে ডাকি।
-এই খবরদার আমার নাম নিয়ে কোন ঢং না বলে দিলাম। আমার নাম প্রিয়ন্তি, এই নামেই ডাকবে। না পোষালে রাস্তা মাপ।
-রাস্তা মাপ মানে আমি কি ঠিকাদার নাকি!
-নাহ তুমি টেইলার।
-মানে!
-মানে টেইলারদের স্বভাব শুধু কাটাকাটি তুমিও আমার নাম নিয়ে কাটাকাটি করতে চাও।
-ওকে আর করবনা বাবা সরি।
-মনে থাকে যেন। কিঞ্চিত কৃত্রিম অভিমানী গলায় বললো প্রিয়ন্তি।
জিজ্ঞেস করলাম, -প্রিয়ন্তি কেমন আছ?
-মন্দ আছি।
-মন্দ থাকার কারণ?
-বিএফ কে বিয়ে না করে অপরিচিত কাউকে বিয়ে করলে মন্দই থাকে মানুষ।
ধড়াস করে উঠলো বুকের ভেতর। মেয়েটাকি সিরিয়াস কথা বলছে তার চোখের দিকে তাকিয় বুঝতে চেষ্টা করলাম। বুঝার উপায়ই নেই তবে আমি ধরে নিলাম সত্যি বলছে।
-বি এফ এর কথা মনে পড়ছে নাকি খুব?
আমি এমন ভাবে জিজ্ঞেস করলাম যে, সে যদি হ্যা বলে তবে তাকে বিএফ এর কাছে দিয়ে আসব
-হে খুব মনে পড়ছে দাও ফোনটা একটু কথা বলি।
আমি রোবটের মত মোবাইল এগিয়ে দিলাম।
-নাও কথা বল।
প্রিয়ন্তি মোবাইলটা হাতে নিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর নাম্বার টিপতে লাগলো। আমি ভাবছি আমার কি এখানে থাকা উচিৎ? আমি উঠে দাঁড়ালাম।
-কই যাও তুমি? প্রিয়ন্তি একটু ধমকের সুরেই যেন বলল।
-এইতো আছি এখানেই, তুমি কথা বল।
-তোমার কোথাও যেতে হবেনা, বস চুপ করে। আমার এক্সের সাথে তোমার পরিচয়টা থাকলে ভালো হবে। আমি আবার বসে পড়লাম।
প্রিয়ন্তি কানে মোবাইল ঠেকিয়ে আমার দিকে তীক্ষ চোখে তাকিয়ে আছে আবছা আলোতে চোখ দুটো জ্বলছে মনে হল।
-আম্মাগো তোমরা এ কার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছ আমার। লোকটা তার মোবাইল দিয়ে আমার পূরাতন প্রেমিকের সাথে কথা বলতে বলছে। শুধু তাই না, আমাকে একা কথা বলার সুযোগ দিয়ে সে চলেও যেতে চাচ্ছে।
ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। প্রিয়ন্তি দেখি তার মাকে ফোন দিয়েছে। তাহলে এক্স ফেক্স কিছুনা। আমার সাথে মজা করেছে। অনেকটা স্বস্থি পেলাম। যদিও আমি তার এক্সের সাথে পরিচিত হতে মানসিক ভাবে প্রস্থুত ছিলাম। কয়েক মিনিট চললো প্রিয়ন্তির কান্নাকাটি। এই কয়েক মিনিটে কমপক্ষে চারবার আমাকে বোকা সম্বোধন করেছে তার মায়ের কাছে। অবশেষে বাতচিত শেষ হল। বিপদ তখনো কাটেনি।
-আমি আম্মুর কাছে যাব। আমি তোমার মত বোকা মানুষের সংসার করবনা।
-আমি বোকামীটা কি করলাম! তুমি কথা বলতে চাইলে আমি ফোন দিলাম।
-চুপ একটা কথাও না। তোমাকে আমি চিবিয়ে খেয়ে ফেলব।
একথা বলেই আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে টেবিল থেকে একটা আপেল তুলে কামড় বসালো।
জিজ্ঞেস করলাম-আম্মুর কাছে যাবে?
-অবশ্যই যাব।
-তাহলে চল। পরে আবার ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়বে। তোমার আম্মুকে বলেছ আমরা যাচ্ছি?
-তুমি কোথায় যাবে! ড্রাইভারকে নিয়ে আমিই যাব।
আমি একদম দমে গেলাম। সত্যি সত্যি যদি এই মেয়ে চলে যায় এখন তবে মানসম্মান আর কিছুই থাকবেনা।
-তুমি কি সিরিয়াসলি বলছ প্রিয়ন্তি?
প্রিয়ন্তির জবাব শুনার আগেই দেখি ছাদে আব্বা আর আম্মার আগমন। কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আবার আব্বাকে দেখে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেলাম।
আমি ঠিক বুঝলামনা উনারা আমরা আছি একথা জেনে এসেছেন নাকি এমনি। আমি উঠে দাঁড়ালাম, সেই সাথে প্রিয়ন্তিও। নাহ মেয়েটা বেশ আদব কায়দা জানে দেখা যায়। তবে এই মেয়েকে আর বিশ্বাস নেই। কখন কি বলে।
-এতরাতে কে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
বাবা প্রশ্নটা কাকে করলেন বুঝা গেলনা। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। প্রিয়ন্তিও তাই।
আব্বা আম্মা চেয়ার দুটি টেনে বসলেন।
-বৌমা দাঁড়ালে কেন, বস।
বাহ আম্মা যেন বউমা কে নিয়ে পারলে কোলে বসান। আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছেওনা। প্রিয়ন্তিও কি সুন্দর বসে পরলো।
-ওয়েটারের মত দাঁড়িয়েছ আছিস কেন তুই? মনে হচ্ছে আমরা অর্ডার করব আর তুই খাবার নিয়ে আসবি। বস।
উক্তিটি কার তা বোধকরি আপনাদের আর বলে দেয়া লাগবেনা। হে আমার পিতাজির উক্তি। আমি আর কি করব, আমিও বসলাম। কোন কিছুর উপর একটা লেকচার চলবে বুঝতে পারছি।
-তা বললেনা যে কোথায় যেতে চাচ্ছিলে তোমরা।
আমি ঠাস করে বললাম-নীচে আব্বা।
কিন্তু কে জানত ভরা মজলিসে আমার নতুন বউ আমার ইজ্জতের ফালুদা করবে।
-উনি মিথ্যা বলছে আব্বা, আমি বাসায় চলে যাব বলেছি।
-বাসায় চলে যাবে! কেন মা?
আম্মা যারপর নাই অবাক হয়েছেন। আর আব্বা জিজ্ঞেস করলেন-এই অকম্মাটা কিছু বলেছে বউমা?
আব্বার প্রশ্ন শুনে প্রিয়ন্তি ফিক করে হেসে দিল। আমি লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলাম না।
-আপনার ছেলে আস্ত একটা বোকা আব্বা...
প্রিয়ন্তির কথা শেষ হবার আগেই আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম।
-কিরে তুই রোবটের মত লাফ দিলি কেন? বস বলছি।
আমি আবার বসলাম। আমার প্রায় কান্না আসছে। আর প্রিয়ন্তি হেসেই যাচ্ছে। আম্মা আব্বা দুজনেরই সাপোর্ট পাচ্ছে। একবার সুযোগ পাই, মজা দেখাব। ভেতরে ভেতরে পণ করলাম।
-তোমাদের দুজনকে একটা মজার কথা বলি আজ বউমা।
-জ্বী আব্বা বলেন।
-আজ আমার আর আফসানার ৩১ তম বিবাহ বার্ষিকী। কোনদিক দিয়ে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল টেরই পেলামনা।
-এই তুমি চুপ করতো।
আম্মা আব্বাকে থামিয়ে দিতে চাইছেন।
আম্মা লজ্জা পাচ্ছিলেন খুব। কিন্তু আমার দস্যি বউয়ের কারণে আব্বা আম্মার মানা সত্যেও বলা শুরু করলেন।
-হ্যাপি রিটারনস অফ দ্যা ডে বাবা এন্ড মা। এই তুমি শুভেচ্ছা জানাবেনা বাবা-মাকে?
আমি যেন এতক্ষন এখানে ছিলামইনা। প্রিয়ন্তির কথায় তাড়াহুড়ো করে বললাল-হ্যাপি এনিভারসারি আব্বা-আম্মা।
আমার কাছে সবকিছু সপ্নের মত লাগছিলো। বিশেষ করে আব্বাকে এত কাছ থেকে আর কখনো দেখা হয়নি। সারাজীবন উনার সাথে একটা বিশাল গ্যাপ ছিল আমার। প্রিয়ন্তি আবার তাড়া দিল আব্বাকে সেদিনের ঘটনা মানে তাদের বিয়ের গল্প বলার জন্য। আব্বাকেও যেন আজ গল্প বলার নেশায় পেয়েছে।
-সেদিন এরকম মাঝ রাতে ঠিক তোমাদের মত আমরা ছাদে চলে এসেছিলাম চুপি, চুপি। তোমার শ্বাশুরী মায়ের যদিও প্রথমে আপত্তি ছিল।
আম্মা ওদিকে লজ্জায় যেন শূণ্যে ভেসে যাবেন।
-এই তুমি থামবে এবার?
এমন সময় আমার বউয়ের মাথায় কি ভূত চাপল কে জানে। হঠাত আব্বা আম্মাকে বসে থাকতে বলে আমাকে প্রায় টেনে হিচড়ে নীচে নিয়ে আসল।
-কি ব্যাপার এভাবে নীচে নিয়ে আসলে কেন?
-তুমি আসলেই বোকা। আব্বা-আম্মাকে একটু পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগ দিলাম। আর কিছু কাজও আছে।
-কি কাজ?
-উনাদের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করব।
-কিন্তু কিভাবে, দোকান পাঠ কিছুইত এত রাতে খোলা পাবেনা।
-তা ঠিক তবে উপায় হয়ে যাবে। তুমি কয়েকটা মোমবাতি যোগাড় কর আর কিছু কেক পাওয়া যাবে বাসার ফ্রীজে?
আমি মোমবাতি খুব সহজেই যোগাড় করলাম। ফ্রিজে কয়েক পিছ সাদা কেক পাওয়া গেল।
-আরেকটা জিনিস বাকি। আল্লাহ যেন পাওয়া যায়।
আমি কি জানতে চাইলাম।
-সস।
সসও পাওয়া গেল ফ্রিজে। আমি আমার বউয়ের কর্মকাণ্ড দেখে সত্যি অবাক হলাম। সে একটা ট্রেতে সাদা কেকের পিছগুলা রেখে চারদিকে মোমবাতি বসালো। আর সস দিয়ে কেকের উপর লিখলো "আব্বা-আম্মার ৩১তম বিবাহবার্ষিকী "।
রান্নাঘর থেকে সে নিজেই চাকু নিয়ে আসল। আমাকে বলল, চল এবার ছাদে।
আমি ট্রেটা হাতে নিয়ে বিমোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইচ্ছে হল প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু তা না করে বললাম- তুমি না আম্মুর কাছে যাবে?
সে গালফুলিয়ে বলল-তুমি চাও আমি চলে যাই?
আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। ওর সামনে কাঁদতে চাইলামনা। বললাম- চল চল আব্বা-আম্মা অপেক্ষা করছেন।

রাত দুইটা বাজে। আমার বাসার ছাদটা একটা ছোট স্বর্গতে পরিণত হয়েছে যেন। নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে এই দৃশ্যের একজন হতে পেরে। শতাব্দীর পর শতাব্দী গেলেও এমন দৃশ্যের অবতারণা হয় বলে মনে হয়না।
আব্বা-আম্মা মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটলেন। আমার প্রিয়ন্তি আমাকে নিয়ে তারস্বরে বললো "হ্যাপি এনিভারসারি ডিয়ার আব্বা-আম্মা।"
আমরা প্রত্যকেই একজন আরেকজনের অলক্ষ্যে চোখের জল মুছায় ব্যাস্ত। বুঝ হবার পর এই প্রথম আব্বাকে আমি জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখের জলে তার কাধ ভিজে যাচ্ছে খেয়ালই করলামনা। আব্বা-আম্মা একে অন্যকে কেক খাওয়ালেন,আমাদেরকেও দিলেন। প্রকৃতি হল নীরব দর্শক এই অসাধারণ বিয়েতে বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানটির।

লেখক- সৈয়দ মাহফুজ আহমেদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে