পাঠকই লেখক ডেস্ক : জীবনে চলার পথে কতো বন্ধু মেলে। তবে তাদের মধ্যে ক’জনই বা আপন হয়। ক’জনই বা বন্ধুর বিপদে এগিয়ে আসে। এজন্য খুব বেশি বন্ধুর দরকার হয় না। আসলে বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা রাখে- এমন দু’একজনই বন্ধু হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু দিনদিন সোস্যাল নেটওয়াকিং ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ছোট-বড় সকলের কাছে ফেসবুকের গুরুত্বই অন্য রকম। তেমনি ফেসবুকে ইউসুফেরও বন্ধুত্বের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু ফেসবুকে ইউসুফের হাজারো বন্ধু থাকলেও বাস্তবে তার উল্টো রূপ। মাঝে মধ্যে এখন অবসর সময়টা ফেসবুকেই কাঁটিয়ে দেয় ইউসুফ।
তবে মানুষের ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের বন্ধুত্ব তৈরী হয়। প্রথমে বাড়ির আশপাশের খেলার সাথী, তারপর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মস্থলে ক্রমান্বয়ে বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এদের সবাই আবার সব সময় আপন থাকে না, কখনোবা এরাই আবার শত্রুতে পরিণত হয়। অন্তরঙ্গ বন্ধু তারা ছাড়া সবাই, সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দূরে সরে যায়। তাইতো বলে সুসময়ে বন্ধু মেলে দুঃসময়ে নয়।
এরকম হাজারো ধারণা ইউসুফের। বন্ধুত্বের মানে তার কাছে বরাবরই অন্যরকম। তাইতো একাকীত্ব জীবন বড়ই ভালো তার কাছে। হঠাৎ ক্যাম্পাসে একদিন তাঁর মনে হলো এ জীবন কোনো জীবন নয়। এ একাকীত্ব জীবন বড়ই দূর্বিষহ। যখন খুব প্রিয় মানুষটি অপছন্দ, অবহেলা কিংবা ঘৃণা করে তখন প্রথম প্রথম সবাই খুব কষ্ট পাই এবং চাই এলোমেলো সব কিছু ঠিক হয়ে যাক । কিছুদিন পর সেই প্রিয় ব্যক্তিকে ছাড়া আবার থাকতে শিখে যায় । আর অনেকদিন পরে সে আগের চেয়েও অনেক বেশি খুশি থাকে, যখন সে বুঝতে পারে কারো ভালবাসায় জীবনে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়। আবার কারো অবহেলায় সত্যি কিছু আসে যায় না ।
অতপর ইউসুফ ক্যাম্পাস থেকে বাসায় এসে রাগে গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ অন করে একটি আধুনিক গান ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সুমধুর গানের সাথে সাথে পুরো ঘর যেন সুগন্ধে ভরে গেছে! সুমিষ্ট কন্ঠের গানগুলোর মধ্যেই যেন সুগন্ধ মিশানো। মিউজিক প্লেয়ার অন করে দিলেই সারা ঘর ফুলের সুভাসে মোহিত হয়ে ওঠে। গান শুনতে শুনতে ঘুমের জগতে হারিয়ে গেলো ইউসুফ। আর যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বেশ সকাল। হালকা কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারিপাশ।
এমনিতেই শীতের সময় উঠি উঠি করেও সুর্য্যিমামা উঠে না।সাইবেরিয়ার শীতল হাওয়া এবার সময়ের অনেক আগে চলে আসায় এই অবস্থা। ইউসুফ আড়মোড়া ভেঙ্গে অলসভঙ্গীতে ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে, শরীরে তোয়ালে জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে এলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় কানে গুনগুন শব্দ ভেসে এলো। আরেকটু এগুতেই দেখতে পেলো পাশের বিল্ডিং এ একটি মেয়ে গভীর মনোযোগের সাথে ফুলগাছে পানি দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। দুটো বিল্ডিং এর মধ্যে দুরত্ব মাত্র দেড়হাত।
ইউসুফ এমনিতে কারো সাথে গা ঘেসে কথা বলার পাত্র নয়। তাই মেয়েটির সাথে কথা বলার ইচ্ছা জাগলেও নিজেকে সামলে নিয়ে আবার রুমে চলে গেলো। কিন্তু মেয়েটির রূপ লাবণ্যের কিছুই দেখা হয়নি।
এমন অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ইউসুফের দিন কেঁটে যায়। কয়েকজন বন্ধুরা মিলে প্রায় সময়ই ফেসবুকে চ্যাট করে রাতে। কিন্তু হঠাৎ অপরিচিত একটি মেয়ে কি যেন বার্তা দিলো। ফেসবুকে মেয়েটির নাম রাত জাগা বৃষ্টি। ইউসুফ মনে করে কে এটা, একটু চ্যাট করে দেখি। এমনইভাবে প্রায় সময় এখন ফেসবুকে চ্যাট হয় তাদের মধ্যে। কিন্তু এখনো কেউ কাউকে চেনে না।
তবু কথার ফুলঝুরি বেড়েই চলেছে, রাত অবধী সকাল পেরিয়ে এখন তাদের চ্যাটিং। হঠাৎ একদিন মেয়েটি চ্যাটে বলেই বসলো, আচ্ছা আমি কে, কোথায় থাকি, কি করি, কি আমার পরিচয় এগুলো কি তোমার জানার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিউত্তরে ইউসুফ জবাব দিলো, আমরা তো বন্ধুর মতো এর চেয়ে বেশি কিছু আমি তো ভাবি না। কিন্তু মেয়েটি এতোদিনে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর সেটি ইউসুফের কাছে এখনো অজানা।
এদিকে ইউসুফও ফেসবুকে মেয়েটির ছবি দেখে মনের মানুষ ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু কেউ কাওকে বলতে পারে না। অবিশ্বাস্য একদিন হঠাৎ চ্যাটে ইউসুফ বলেই বসলো, “আমি তোমাকে ভালোবাসি”। সে হয়তো মনে করেছিলো, আজই মনে হয় আমাদের শেষ কথা কিন্তু প্রতিউত্তরে যে উত্তর এলো। তাতে আজ রাতটা বড়ো ভালোই কাটলো ইউসুফের। এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছে আমি তোমাকে ভালোবাসি কথাটি শোনা। যদিও সেটি শুধুই দেখার, কানে শ্রবণ করার নয়। তারপরও তো শব্দটি অতি মধুর। আর এ ভাষাটি সবার কাছে অতি প্রিয় একটি শব্দ নয় আরো অনেক কিছু।
এভাবে ফেসবুকের চ্যাটে কথা বলতে বলতে, একদিন ইউসুফ বললো তোমার ফোন নাম্বারটা কি আমাকে দেওয়া যাবে? এতোদিনে যতোটুকু তাঁদের জানা দরকার ততোটুকু জানা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বৃষ্টি তার ফোন নাম্বারটা দিতে অস্বীকৃতি জানালো। শুধু চ্যাটে এতোটুকু বললো, যখন সময় হবে তখন তোমাকে বলতে হবে না, আমি নিজেই তোমাকে আমার নাম্বারটা দিবো। তার সব আশা পন্ড হয়ে গেল। ভেবেছিলো ভালো যখন বাসে তখন হয়তো চাইলে ফোন নাম্বারটা দিবে। কিন্তু হলো হিতে বিপরীত। বিষন্ন মনে তারপরও চলছে তাদের ফেসবুক ভালোবাসা।
এখন ইউসুফ আর আগের মতো নেই। তার মধ্যে এখন ব্যাপক পরিবর্তন। সারারাত অবধী ফেসবুকে থাকা আর সারাদিন বাসায় ঘুমানো। এই হলো তার নতুন রুটিন। এদিকে মেডিকেলের ক্লাস শুরু হলেও এখন আর ইউসুফের দেখা মেলে না ক্যাম্পাসে। যে ছেলেটি পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝতো না, পড়ালেখা নিয়ে যে সবার মাথা খারাপ করে দিতো। সেই ছেলের একি হাল। কি হয়েছে ইউসুফের? এমন অনেক কথা তার বন্ধুদের মাঝে।
হঠাৎ করে কি এমন হলো যে, এখন আর ক্যাম্পাসে আসেই না ইউসুফ। তাই সবাই মিলে একদিন সিদ্ধান্ত নিলো, তার মেসে যাবে। হাসিব বললো আচ্ছা, তাঁর আগে তো ওর সাথে যোগাযোগ করতে হয়। কিন্তু ফোন ও তো বন্ধ। কিন্তু কি হয়েছে ওর কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বন্ধুরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো ও আগের বাসাতে নেই। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইউসুফের ও পরিবর্তন হয়েছে।
এদিকে এখন ফেসবুক প্রেমে মত্ত ইউসুফ এবং বৃষ্টি। সরাসরি না দেখেও দু-জনে ডুবে আছে ভালোবাসার অতল গহ্বরে। আগের মতো এখন আর শুধু রাতে নয়, দিনে-রাতে চলে ওদের ফেসবুক প্রেম। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ইউসুফের ভবিষ্যত এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলে পড়ালেখা শেষ করে মস্ত বড়ো ডাক্তার হবে। এখন একদিকে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ আর অন্যদিকে ফেসবুক প্রেমে বৃষ্টিকে পাওয়ার স্বপ্ন।
বাড়ি থেকে পাঠানো অর্থ দিয়ে এখন আর পড়ালেখা নয়, চলে সারাদিন ফেসবুক আর ফেসবুক। এরই মধ্যে বৃষ্টির বার্তা এলো ইনবক্সে। বড়ই সমস্যা তার এই মূহর্তে প্রয়োজন কিছু টাকা, সত্য নাকি মিথ্যা সেটি দেখার সময় নেই ইউসুফের। যেভাবে হোক টাকা জোগাড় করতেই হবে। নয়তো ভালোবাসার মানুষটি হারিয়ে যাবে। তাই ইউসুফ বাড়িতে ফোন করে বাবা-মাকে বোকা বানালেন আর বললেন কিছু টাকা দিতে। ভালোবাসার জন্য কি না পারে মানুষ। অতপর বৃষ্টিকে দিলেন বাড়ি থেকে পাঠানো সমস্ত টাকা। কিন্তু এটা ছিলো বৃষ্টির সম্পর্ণ বানানো একটি নাটক।
অবশেষে ধনীর দুলালী বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করবেন ইউসুফ। কিন্তু বৃষ্টি কি জানে তার ভালোবাসার মানুষটি সামান্য মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ইউসুফ গেলেন দেখা করতে, দামি গাড়ীতে করে চড়ে আসা বৃষ্টি, ইউসুফকে দেখে হতবাক হলেন। এই তার মনের মানুষ, যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতেন ইউসুফ। আজ সমস্ত পৃথিবীর সুখ যেন তাঁর কাছে। হঠাৎ বৃষ্টি বললেন, তুমি থাকো আমি আসছি। কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও আর ফিরে এলোনা বৃষ্টি। বিষন্ন মনে রুমে ফিরে, ল্যাপটপ অন করে ফেসবুকের ইনবক্সে একটি বার্তা পেলেন, তোমার মতো একটা ছোট লোক আমার চাকরের যোগ্য, মনের মানুষ হওয়ার যোগ্য নয়।
অতপর ফেসবুক প্রেমে ইউসুফের জীবন তছনছ হয়ে গেলো। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে বাড়ি ফেরা আর হলো না। স্কুল, কলেজ ও মেডিকেলের সেরা ছাত্রটির স্বপ্ন এখানেই অবসান হলো। কালের অতল গহ্বরে তাঁর স্বপ্ন হারিয়ে গেলো। মেডিকেলের সকল বন্ধুরা যখন ডাক্তার হয়ে বাড়ি ফিরলো আর ইউসুফ তখন না ফেরার দেশে পাড়ি দিলো। যেখানে যাওয়া যায় কিন্তু ফিরে আসা যায় না।
নদী, সাগর ও সমুদ্রে দীর্ঘদিন পাড়ি দেয়ার পর হয়তো তারও একটা কূল-কিনারা পাওয়া যায়। কিন্তু ভালো বন্ধুত্বের আসলে গভীরতা ও প্রশস্ততা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অনেকে আছেন যারা নিজের কিছু স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য বন্ধুত্ব করেন। আবার কেউ আছেন তাঁদের বন্ধুর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। আসলে কেউ যদি আপনার বন্ধু হতে চায় বা আপনি কাউকে বন্ধু করতে চান তাহলে সব সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখবেন। না হলে জীবনে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
একজন ভালো বন্ধুই পারে আপনার জীবনকে সাফল্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে। আবার একজন বন্ধুই আপনার জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এখন আপনাকেই বেছে নিতে হবে আসলে কে আপনার জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ার যোগ্য।
লেখক : শেখ জাহিদুজ্জামান