পাঠকই লেখক ডেস্ক : রাত এগারটা। ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে বাবা সিগারেট টানছেন। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে বাবা দেখতে পায়নি। আমার কথা শুনে বাবা চমকে গেলেন। ফট করে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললেন,
- কে? কে সিগারেট টানছে? কি বলিস এগুলা?
- হেহে। আব্বা তুমি ধরা পড়ে গেছ। আমি আম্মুকে বলে আসছি।
আমি সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বাবা দৌঁড়ে এসে আমাকে ধরে বলল,
- ছি ছি! এগুলো আম্মুকে বলতে হয় নাকি? শোন তনয়, তোর আম্মা এমনিতেই ক্যাচক্যাচ প্যানপ্যান বেশি করে। এটা শুনলে তো বুঝতেই পারছিস? তুই বলিস না বাপ আমার. .
- একশ টাকা দাও।
- কেন?
- না দিলে আম্মুকে বলে দিব কিন্তু।
- আচ্ছা দিব দিব।
আমি একটা শয়তানী হাসি দিলাম।
এই হল বাবা আর আমি। মা, বাবা আর আমি মিলে আমাদের ছিমছাম মধ্যবিত্ত পরিবার। ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমাকে যদি কেউ বলে তোমার বাবা আর মার মাঝে কাকে বেশি পছন্দ কর? আমি অকপটে বলে দিব, বাবা। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কেন জানি এই মানুষটাকে আমার খুব ভাল লাগে।
শুক্রবার। বাজার নিয়ে এসে আব্বু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। জুম্মার আর বেশি দেরি নাই। তরকারি কাটতে কাটতে আম্মা আমাকে ডেকে বলল,
- ঐ তোরা কি নামাজে যাবি না? যা তোর বাপ কে উঠা।
আমি তখন আব্বুকে গিয়ে উঠাই। আব্বু আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
- এই যাহ! দেরি হয়ে গেল তো। গোসল করেছিস তনয়?
- আরে নাহ। এখনই ঢুকব।
তখন আমরা তাড়াহুড়া করে গোসল সেড়ে একসাথে নামাজে যেতাম। যদিও আমি নামাজ শিখিনি। আব্বার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রুকু সিজদাহ তে যেতাম।
এভাবে কেটে যাতে থাকে সময়গুলো। একসময় ক্লাস এইট পাস করলাম। বৃত্তিও পেলাম। বাবা মা যে সেদিন এত খুশি হয়েছে আমি বলে বোঝাতে পারব না। আব্বু একটার পর একটা মিষ্টি আমার মুখে তুলে দিলেন। ছোট্র পরিবারে বাবা মায়ের এই হাসি আনন্দটুকু আমার কাছে স্বর্গের শান্তি মনে হল।
কিন্তু সবসময় মানুষ হয়তো একরকম থাকে না। যতই বড় হচ্ছি ততই যেন বাবার সাথে আমার দূরত্বটা বেড়ে চলেছে। এর কারণ হয়তো বড় হচ্ছি তাই। অথবা ব্যস্ততা। আগে যেখান জুম্মার নামাজ একসাথে পড়তে যেতাম এখন সেখানে আব্বা আগে যায় আর আমি পরে যায়। এক কাতারেও দাঁড়ানো হয় না।
তবে দূরত্ব যে খুবই বেড়ে গেছে সেটাও বলা যাবে না। আব্বু আর্জেন্টিনা আর আমি ব্রাজিল।
- আব্বা টাকা দাও তো? ব্রাজিলের পতাকা কিনব।
- এই আইসে! ব্রাজিলের পতাকা কিনার জন্য টাকা দিব আমি? হোয়াট এ জোক!
- তো কি দিবা না?
- না। তুই যদি আর্জেন্টিনার পতাকা কিনিস তাহলে দিব।
- বারে আমি তো ব্রাজিলের সাপোর্টার।
- নিজের টাকা দিয়ে কিন।
- আব্বা আমি কি চাকরি করি নাকি?
- আহারে! তাইলে আর কি করা? ছাদে গিয়ে দেখ আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙানো আছে। ঐটা দেখতে থাক!
এসময় আম্মা রুমে এসে বলল,
- ঐ তনয়, তুই এদিকে আয়। টাকা আমি দিব! এহ কোথায় ব্রাজিল আর কোথায় আর্জেন্টিনা।
আলমারি থেকে আম্মু আমাকে টাকা বের করে দিলেন। আব্বার গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চোখ টিপন্নী দিয়ে বের হয়ে গেলাম। আমি জানি আম্মা ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা কারোরই সাপোর্টার না। আম্মু খেলা দেখেন না, বুঝেন না। তবুও আম্মা এই বাপ বেটার ঝগড়া উপভোগ করেন। এই ঝগড়ার মাঝেই হয়তো বাপ বেটার তৃপ্তিময় ভালবাসা খুঁজে পান।
২
কাল থেকে আমার এসএসসি পরীক্ষা। রাত জেগে পড়ছি। পড়ালিখার ছাত্র আমি নই। কেন জানি পড়ালিখাটা আমার ভাল লাগেনা। প্রায় তিনটা পর্যন্ত পড়লাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। সকালে উঠে নাস্তার টেবিলে নাস্তা করছি। আব্বু শেভ করতে করতে বলল,
- আজকে কি পরীক্ষা রে?
- বাংলা। আব্বুর প্রশ্ন শুনে আমি নিজে নিজেই হাসি। আমার আব্বুটা এরকমই। পড়ালিখা নিয়ে কখনোই তার মাথাব্যথা নেই। তবে মাঝে মাঝে উপদেশ দিতেন। "তনয়, ভালমত পড়ালিখাটা করবি। মানুষ হবি। একসময় হয়তো আমি থাকব না। তখন তোর মাকে তোকেই দেখতে হবে। জীবনটা তোর। সেটা উপভোগ করবি। পাশাপাশি পড়াশোনাও ঠিক রাখবি ।"
কিন্তু খারাপ সময় আমার জীবনে আসল। রেজাল্ট ৪.৯। মানে এ+ পাইনি। আব্বা রেজাল্ট শুনে হাসি দিলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন, "আরে ভালই তো করসিস! মন খারাপ করিস ক্যান? পরেরবার আরো ভাল করবি ।"
আচ্ছা আব্বার কি মন খারাপ হয়নি? নাকি মিছামিছি অভিনয় করছেন?
সারাটা দিন আমার মন খারাপ ছিল। আব্বুর মোবাইলে ফোন আসতেই থাকে। অমুক কলিগের ছেলে এ+ পেয়েছে, তমুক কলিগের ছেলে এ+ পেয়েছে। শুধু আমি পাইনি। রাতে বারান্দায় চুপচাপ বসে আছি। একসময় আম্মু এসে গ্রিল ধরে দাঁড়ালেন। বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, "তোর বাবার চোখে আজ প্রথম পানি দেখলাম ।"
আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই এবার।
- আমি পারিনি আম্মু। আমি ব্যর্থ।
- ছি বাবা এসব বলিস না!
তারপর একসময় কলেজে উঠলাম। আবার সব আগের মত। হাসিখুশি একটি পরিবার। তবে ভিতর ভিতর আমি শান্তি পাচ্ছি না যতদিন না এইচএসসি তে এ+ পাব।
আর বয়সেরও একটা দোষ আছে। এসময়টা খুবই ডেন্জারাস। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পার হতে না হতেই আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। মেয়েটির নাম তাবিহা। একই ক্লাসে পড়ি দুজন। খুব ভাল বন্ধু আমরা। অতঃপর বন্ধু থেকে একসময় রিলেশন। ও যথেষ্ট কেয়ারিং।
৩
একদিন দুপুরে বিছানায় বসে ফেসবুকিং করছিলাম। আব্বু আমার পাশে বসে বললেন,
- কিরে তনয় কি করছিস ?
- এইতো শুয়ে ছিলাম।
- তা মেয়েটা কে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, - কোন মেয়ে?
- আজকে দুপুরে দেখলাম একসাথে ফুচকা খাচ্ছিলি।
- ও তাবিহার কথা বলছ? সে খুব ভাল ফ্রেন্ড আমার।
- হেহে। শুধুই কি ফ্রেন্ড?
আব্বা এমনভাবে কথাটা বলল যে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
- না মানে ইয়ে. . . .
- তোর বয়সটা আমিও পার করে এসছি। এটা কোন ব্যাপারই না। তোর মাকে প্রথম দেখার পর খালি পিছু পিছু ঘুরতাম। ঘটনা শোন তাহলে। আব্বু তখন ঘটনা শোনাতে লাগল। ঘটনা শুনছি আর আমরা দুজনই হাসাহাসি করছি। প্রপোজ, বন্ধুদের হারামীপনা সবকিছুই শোনালেন।
৪
সময় যেতে থাকে। এইচএসসি রেজাল্ট ঘনিয়ে আসছে। পরীক্ষা এবার ভাল হয়েছে। রেজাল্টের দিন সকাল থেকেই আমার মাঝে উত্তেজনা। ঠিক করেছি যদি এ+ পাই তবে বাবাকে আমি নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়াব।
দুপুর বারটা। কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। বাবা বললেন,
- কিরে রেজাল্ট তো দুটার পর। এখনই কলেজে যাচ্ছিস?
- হ্যাঁ আব্বু। বন্ধুরা ডাকাডাকি করছে।
- তোর গার্লফ্রেন্ড ডাকাডাকি করছে না?
- যাও আব্বু সবসময় খালি ইয়ার্কি।
- হেহে। আচ্ছা ইয়ার্কি করব না।
আমার কি মনে হল কে জানে আব্বুর পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেই দিলাম,
- মিষ্টি নিয়ে আসছি। মুখে তুলে খাইয়ে দিব তোমাকে।
আব্বু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবার হাসিমাখা মুখটি দেখে বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে।
৫
দুপুর দুটা। আমি এ+ পেয়ে গেছি। ভাবলাম বাসায় গিয়ে রেজাল্টটা বলব। কিন্তু পারছি না আর। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আম্মুকে ফোন দিলাম। আম্মু কল ধরলেন। আম্মা কাঁদছে।
কি ব্যাপার কাঁদছে কেন? আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
- আরে কাঁদছ কেন?
এ+ পেয়েছি তো।
- তনয়, তোর বাবা আর নেই।
কথাটা শুনে আমি শকড। কি বলছে এসব? আম্মু বলেই যাচ্ছেন। আমি শুনতে পাচ্ছি না। আসলে শুনছিনা। ব্রেন স্ট্রোক না কি যেন বললেন আম্মু! আমি আর পারছিনা।
তবুও আমি মিষ্টি কিনলাম। তারপর হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলাম রিকশাতে। এটা কিভাবে সম্ভব ? দুঘন্টা আগেই তার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ওটাই কি শেষ বুকে জড়ানো ? নাহ আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
৬
মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দরজাতে ঠাই দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাবার নিথর দেহটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। মা আমাকে ধরে ভেতরে ঢোকালেন।
- তোর বন্ধুদের রেজাল্ট কেমন? মুখ দিয়ে কথা বের হয়না। গলাটা ধরে এসছে।
- হ্যাঁ ভাল।
- মিষ্টির প্যাকেটটা খোল। খাইয়ে দে আমাকে।
আমি এবার মাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, "কেন মা? কেন এমন হল আমার সাথে? আমি যে বাবাকে খাইয়ে দিতে চেয়েছিলাম মা। বাবা কেন চলে গেল? কেন?"
বাবার মুখটা শেষবারের মত দেখলাম। এখনও সেই হাসিটা মুখে লেগে আছে যেটা দেখে আমি বাসা থেকে বের হয়েছিলাম।
লেখক : Rj Kuber Majhi