পাঠকই লেখক : জানালার পর্দা বাতাসে উড়ছে । শীতকাল শেষ হল মাত্র, বাতাস থাকবেই । ঠাণ্ডা বাতাস । তবুও সিলভিয়ার বার বার মনে হচ্ছে, কাজটা রিমন করছে । মনে হবার পিছনে কারণ আছে । দরজা জানালা বন্ধ করেই রুমে বসে আছে । রুমের মধ্যে বাতাস আসার কথা না, জানালার পর্দা উড়বার কথাও না । তাছাড়া কাল রাতে স্বপ্নেও দেখল, রিমনকে । রিমন অনেক বড় একটা কাঁঠাল কাধে নিয়ে, হাঁটছে আর বলছে, " সিলভি, তোমার কাঁঠাল অনেক পছন্দ । আমি তোমার জন্য কাঁঠাল এনেছি । অনেক মিষ্টি । খেয়ে দেখো । "
কি বিচ্ছিরি স্বপ্ন । কাঁঠাল কোন জনমেই ভাল লাগত না সিলভিয়ার । এই কথা রিমন জানে । তবুও কাঁঠাল নিয়ে আসছে । এটার মানে কি হতে পারে ? প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে রিমন ? ওকে কষ্ট দেবার প্রতিশোধ? হতেই পারে। সিলভিয়া তো অনেক কষ্ট দিল রিমনকে। আর এই কষ্টের কারণেই এই অবস্থা ছেলেটার এখন। কষ্টের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে মনে হয়। তবুও ইচ্ছা করে কাজটা করেছে তা তো না। বাবা মা বিয়ে ঠিক করল, করে ফেলল। সিলভিয়া বন্ধু হিসেবে সঙ্গ দিয়েছে, ভালবাসার মানুষ হিসেবে না। রিমন উল্টা বুঝল। ভালবাসার মানুষ ভেবে বসেছিল। বিয়ের দিন সকালে রিমন মেসেজ দিল, তুমি সত্যি বিয়ে করে ফেলবে?
সিলভিয়ার সোজাসাপ্টা উত্তর- না করার তো কোন কারণ নেই।
- তুমি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে?
- না পারার তো কথা না। তোমাকে কখনও বলেছি তোমাকে আমি বিয়ে করব?
- না তা বল নি। তবে ভালবাসি তো বলেছ।
- সেটা বন্ধু হিসেবে।
- তাই বলে এতবার?
- হ্যাঁ এতবার। বন্ধুকে ভালবাসি বলা যায়। আর তোমাকে কখনও আমার প্রেমিক হিসেবে ভাবিনি।
- আচ্ছা। ঠিক আছে।
রেখে দেয় রিমন। রিমনের সাথে সম্পর্কটা হবার কথা না। তবুও হয়ে গেল কিভাবে। ভার্সিটির পরীক্ষায় সিট পড়ল রিমনের সিলভিয়ার সামনে। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে ক্লাসে দেখত। নিয়মিত না। মাঝে মাঝে ক্লাসে আসত। এসে পিছনের বেঞ্চে বসত। খানিক পর আর নাই। এই ছেলেটার সিট পড়েছে সিলভিয়ার সামনে। সিলভিয়া দেখে, রিমন চুপচাপ বসে আছে, কিছু লেখে না। ঘণ্টা খানেক চলে যায় তাও না। সিলভিয়ার খারাপ লাগে। পাগল নাকি ছেলেটা? এভাবে বসে থাকলে নিশ্চিত ফেল। কি মনে করে সিলভিয়া, নিজের খাতার কয়েকটা পেজ, রিমনের দিকে লুকিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, লেখ, দেখে দেখে, স্যার যেন না বুঝে। ধরা পড়লে কিন্তু দুজনই এক্সপেল। রিমন লুকিয়ে লুকিয়ে সিলভিয়ার খাতা দেখে লিখে। সব লিখে না, পাস করার মত লিখেই উঠে চলে যায়। কথা হয় না। পরের পরীক্ষায়ও একই কাজ। সিলভিয়া বলে, বাহিরে একটু দাড়িও।
রিমন পরীক্ষা দিয়ে বাহিরে দাঁড়ায়। সিলভিয়া এসে বলে, পাস করবে তো?
- তুমি ভুল লিখে না দিলে করব।
- পড়াশুনা কর না কেন?
- ভাল লাগে না।
- ভাল লাগাতে হবে তো।
- না লাগলে কি করব?
- কিছু তো একটা করা যায়। দেখ, এভাবে দেখে লিখলে হঠাৎ ধরা পড়লে কিন্তু সমস্যা।
- আচ্ছা, তোমাকে আর খাতা দিতে হবে না।
- না আমি সেটা বলিনি। তোমার ফেল করলেও আমার কিছু না, পাস করলেও না। তবুও কেন যেন খারাপ লাগছিল, তাই তোমাকে একটু সাহায্য করলাম। এর পরের পরীক্ষায় পড়ে আসবে। ঠিক আছে?
- আমার কাছে পড়ার মত নেই কিছু, শিট, বই, কিছু নেই।
- আমার সাথে চল। আমি শিট দিচ্ছি। ফটোকপি করে নিও।
- আচ্ছা।
রিমন সিলভিয়ার সাথে যায়। সিলভিয়ার বাসার সামনে। মগবাজারে। রিক্সা করে যাবার সময় নানা কথা বলে। অল্প সময়ে বন্ধুত্বটা হয়ে যায়। রিমন হুট করে বলে দেয়, না পড়ার পিছনের কারণ। মাস খানেক আগে, মিষ্টির সাথে ব্রেক আপ। ভালবাসার মাত্রা বেশী থাকাতে, ভুলতে একটু বেশীই কষ্ট হচ্ছিল। ভুলতে না পেরে, কষ্ট থেকে রেহাই পেতে, মাদকাসক্ত হয়ে যায়। পড়ালেখা খুব বাজে লাগে। তবুও এক বন্ধু জোর করে ফর্ম ফিল আপ করিয়ে, পরীক্ষা দিতে নিয়ে আসে। তবে পড়া হয় না। কষ্ট হয়। মিষ্টির কথা মনে পড়ে। কষ্ট হলেই গাঁজা, সিগারেটে বুদ হয়ে থাকে। সিলভিয়া শুনে সব কথা, কিছু বলে না। বাসার সামনে এসে বলে, রিমন, তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি শিট দিয়ে যাচ্ছি। আমার আম্মু আমার ছেলে বন্ধু পছন্দ করেন না। তাই বাসার ভিতর নিতে পারছি না। যদিও আম্মু বাসায় নেই। তবুও জানলে সমস্যা হবে।
- আচ্ছা আমি দাঁড়াচ্ছি। তুমি নিয়ে আসো।
সিলভিয়া খানিক পর ফিরে আসে। এক গাদা শিট নিয়ে। বুঝিয়ে দেয়, কোথা থেকে কি পড়তে হবে। আর বলে তাড়াতাড়ি ফটোকপি করে ফেরত দিয়ে যেতে।
রিমন ফটোকপি করে এনে সিলভিয়াকে ফেরত দেয়, শিট গুলো। বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় সিলভিয়া বলে, শোন।
- হ্যাঁ।
- পড়ালেখা কর ভাল করে। যে চলে গেছে তাকে নিয়ে কষ্ট পাবার কিছু নেই। তার জন্য ভেবেও লাভ নেই। জীবন তোমার, তার না। তবুও কষ্ট লাগলে, আমাকে ফোন দিও। বন্ধু হিসেবে এতো কিছু বললে, চেষ্টা করব পাশে থাকার।
- নাম্বার তো জানিনা তোমার।
একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দেয় সিলভিয়া। তাতে নাম্বারলেখা। রাতে গিয়ে সত্যি পড়তে বসে রিমন। একটু একটু করে মাথার ভিতর যখন মিষ্টির কথা আসে, কাঁপা কাঁপা হাতে কল করে সিলভিয়াকে। ভাবে বিরক্ত হবে সিলভিয়া। পড়ার মাঝে বিরক্ত করছে। সিলভিয়া বিরক্ত হয় না। কথা বলে, সুন্দর করে। কথা শুনে রিমনের। রিমন কোথাও পড়া না বুঝলেও কল করে সিলভিয়াকে, সিলভিয়া বুঝিয়ে দেয় ধৈর্য নিয়ে। বুঝানো শেষে বলে, তুমি খুব পচা ছাত্র। ছোট জিনিস বুঝতে এতো সময় লাগে?
আসলে বুঝতে সময় বেশী লাগে না রিমনের। ইদানীং সিলভিয়ার সাথে কথা বলতে ভাল লাগে। কষ্ট গুলো হাওয়া হয়ে উড়ে যায়, সিলভিয়ার সাথে কথা বললে। তাই ইচ্ছে করে না বোঝার ভান করে। সিলভিয়া রিমনকে না করেছে আর সিগারেট বা পচা কিছু খেতে। রিমন সত্যি ছোঁয় না আর। বদলে যায়। সিলভিয়ার খাতা ছাড়াই পরীক্ষা দিতে পারে। পরীক্ষা শেষে সিলভিয়ার বাসার সামনে দাড়িয়ে, শিট নিয়ে আসে। চলে আসার সময় প্রতিদিন সিলভিয়া বলে, দুঃখী দুঃখী থাকবে না। কোন সমস্যা হলে কথা বলবে আমার সাথে।
কথা বলে, বন্ধু হিসেবে সব বলে। এমন করতে করতে এক সময়, মিষ্টির জন্য আর কষ্ট হয় না রিমনের। মিষ্টিকে নিয়ে ভাবেও না। মনেও আসে না মিষ্টির কথা। সারাদিন সিলভিয়াকে নিয়ে থাকে। পড়াশুনার কথা বলা, ক্লাসে এক সাথে বসা, ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয়া। সময় গুলো বেশ যায়। হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবন, হঠাৎ করেই খুব সাজানো গুছানো হয়ে যায়। মনে হয় এমন এক জন মানুষ, জীবনে আরও আগে আসে নি কেন? বুকের ভিতর সিলভিয়ার জন্য অন্যরকম কিছু অনুভব করে রিমন। সিলভিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে। কানে কথাগুলো শুনতে ভাল লাগে। সারাটাক্ষণ সিলভিয়াময় হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। থাকেও রিমন। সারাটা দিন, সিলভিয়ার ভাবনায় বা সিলভিয়ার সাথে। বন্ধুর গণ্ডি পেরিয়ে, মন সিলভিয়ার প্রতি অন্য কিছু অনুভব করে। এটা বন্ধুত্ব না, এটা অন্য কিছু। এই অন্য কিছু মিষ্টির জন্য, একসময় কাজ করেছিল। এখন সিলভিয়ার জন্য। মনের কথা একদিন বলেই দেয় রিমন। সিলভিয়াকে একদিন বলেই ফেলে, সিলভি আমি তোমাকে ভালবাসি।
সিলভিয়াও যেন এটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল। বলে দেয় সাথে সাথে, হ্যাঁ আমিও ভালবাসি।
এরপর যতবার বলেছে রিমন ভালবাসি। সিলভিয়াও ভালবাসি বলেছে। তবে বিয়ের দিন সকালে সেই সিলভিয়াই বলল, ভালবাসি বলাটা ছিল বন্ধু হিসেবে। বন্ধুকে ভালবাসি বলা যায়। রিমনও জানে বন্ধুকে ভালবাসি বলা যায়। তবে রিমন বন্ধু নয় শুধু, এর চেয়ে বেশী কিছু হিসেবে ভালবেসেছিল। স্বপ্ন গুলো এর চেয়ে বেশী কিছু হিসেবে ছিল। কিন্তু সিলভিয়া স্বপ্নগুলো এক নিমিষেই ভেঙ্গে দিল। বুকের ভিতর আবার কষ্ট হচ্ছিল প্রচণ্ড। কষ্ট গুলো উড়িয়ে দেবার মানুষটা অন্য কারও হয়ে যাচ্ছে। রিমন আবার মেসেজ দেয় সিলভিয়াকে, আমি তোমার সাথে দেখা করব। আমার কষ্ট হচ্ছে সিলভি।
- দেখো, আমার বিয়ের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিও না প্লিজ।
- তুমি দেখা না করলে আমি খারাপ কিছু করব।
- তোমার যা ইচ্ছা কর গিয়ে। আমার নাম্বারে আর মেসেজ দিবেনা। আর আবার বলছি, আমার বিয়েতে ঝামেলা বাঁধিও না।
কথাটা কষ্ট দেয় খুব রিমনকে। নিজেকে অসহায় লাগে। কষ্ট ভুলতে আবার নেশায় বুদ হয়। সারাদিন ওসব নিয়ে পড়ে থাকে। সাত দিনের টানা নেশায়, অবস্থা বেগতিক। খারাপ অবস্থা দেখে, হাসপাতালে নেয় বন্ধুরা। সেখান থেকে একজন কল করে সিলভিয়াকে। বলে, রিমনের অবস্থা ভাল না। খুব খারাপ। আপনার নাম্বার দেখলাম শুধু কল লিস্টে। তাই আপনাকে জানালাম।
সিলভিয়া নিঃশব্দে শুনে। বলে না কিছু। শ্বশুর বাড়ি থেকে এখন যাওয়া সম্ভব না। নতুন বউ তার ছেলে বন্ধুকে দেখতে যাচ্ছে, এটা পরিবারের অন্য সবাই ভাল চোখে দেখবে না। তাই যাওয়া হয় না। শাহেদ, সিলভিয়ার স্বামী। ভাল লোক অনেক। সিলভিয়া এই সাত দিনে যা দেখেছে, এই লোকটা আসলেই ভালবাসে সিলভিয়াকে। এই লোকটার কাছেও খারাপ হতে চায় না সিলভিয়া। রিমনের সাথে দেখা করা সম্ভব না। শাহেদ অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় আসে, রাত দশটায়। এখন বাজে নয়টা। সন্ধ্যার পর থেকেই একটু একটু ভয় করছে, সিলভিয়ার। বার বার মনে হচ্ছে, ঘরের কোণে রিমন আছে। পর্দার ওপাশে। বাথরুমে গেলেই রিমনকে দেখবে। বাসায় একা সিলভিয়া। ভয়টা আরও ঝেঁকে বসেছে। এতো বাতাস বাহিরে ঠিক বুঝতে পারছে সিলভিয়া। তবে ঘরে বাতাস আসবে না, দরজা জানালা বন্ধ।
তবুও বাতাসে উড়ছে পর্দা। সিলভিয়ার মনের মধ্যে বার বার বলছে, এটা রিমন করছে। ঘরের মধ্যে ঠিক কোথাও রিমন আছে। মনের মধ্যে থেকে বের হয়ে রিমন ঘরের কোণে জায়গা নিয়েছে। রিমন জানতে চাইবে, রিমনকে কষ্ট দেবার কারণ। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে উত্তর সিলভিয়া। অশরীরী রিমনের সাথে কথা বলবে সিলভিয়া। হঠাৎ করে ঘরের বাতি নিভে গেল। লোড শেডিং। কুটকুটে অন্ধকার। সিলভিয়া ওর পাশে কাউকে অনুভব করছে। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে। কানের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। সিলভিয়া জানে রিমন এটা। এক রিমন হাসপাতালের বেডে শুয়ে। আর অন্য রিমন সিলভিয়ার মনের ভিতর থেকে, বের হয়ে অন্ধকারে পাশে বসে। ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে রিমন। উত্তর চাইছে কষ্ট দেবার, জীবনটাকে এলোমেলো করবার। সিলভিয়া ভয়ে কেঁপে, সাজিয়ে রাখা উত্তর বলে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস আরও গভীর হচ্ছে। ঘন হচ্ছে। রিমন কি হারিয়ে যাচ্ছে? যাক হারিয়ে। সিলভিয়া আর থাকতে পারে না রিমনের জীবনে।
মাঝে মাঝে খুব স্বার্থপর হতে হয়। সময়ের সাথে সাথে মানুষগুলো স্বার্থপর হয়ে যায়। মিষ্টি হয়েছিল স্বার্থপর। এখন সিলভিয়া। কিছুদিন নিজের নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনিকে, রিমনের নিঃশ্বাস ভেবে কথা বলে, মন থেকে রিমনকে ঘরের কোণে বের করে এনে, এক সময় তাড়িয়ে দিবে, অনেক দূরে। ফিরে তাকাবার সময় হবে না। মনের কোণেও জায়গা পাবে না। ভাল থাকবে সিলভিয়া, ভাল আছে মিষ্টি। মাঝে মধ্যে একটু স্মৃতি হাতরে, মনে পড়তে পারে এই যা। কষ্ট পাবার স্মৃতি ভেবে, হারিয়ে যাবে তাও। আর রিমন অমন পাগলামি করে যাবে। করতে করতে হয়ত, আবার কাউকে পাবে জীবনে, পাগলামি সামলে নেবার জন্য।
মিষ্টিকে ভুলছিল, সিলভিয়া দিয়ে। সিলভিয়াকে ভুলবে অন্য কাউকে দিয়ে। জীবন থামে না। চলতে থাকে। কষ্ট গুলোও হয়ত ঝাঁক বেধে, সারাক্ষণ বুকের ভিতর ঝাপাঝাপি করে না। যখন যে কষ্ট আসে, মনে হয় ভুলতে হয়ত পারব না। যখন যে হারায় মনে হয়, এর জায়গা পূরণ হবার না। তবুও কষ্ট গুলো হারায়, জায়গা গুলো পুরোপুরি না হলেও, একটু একটু কাউকে দিয়ে পূরণ হয়। কেউ স্বার্থপর হয়ে সুখী হয়, কেউ স্বার্থ বিলিয়ে সুখী।
লেখক : শেষ রাতের আঁধার