পাঠকই লেখক : দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া একটা ছেলের বুদ্ধি এতোটুকু থাকে না, যতটুকু মিহির আছে। একটু আগে দুই টাকার একটা পয়সা মাটির ব্যাঙ্কটার মধ্যে ফেলল। টুক করে শব্দ হল। কাগজের দুই টাকা ফেললে, কোন শব্দ হয় না। টুক করে শব্দ হোক বা না হোক, ছোট খাতায় লিখে রাখে মাটির ব্যাঙ্কটায় কয় টাকা ফেলল। ছোট খাতার পৃষ্ঠাটায় আর একটা ২ লিখে যোগ দিল। এরপর ছোট ছোট হাতের কড়ি গুণে হিসাব করতে লাগলো মিহি। ৯ দিন ফেলেছে, তাই ১৮ টাকা। প্রতিদিন বাবা ২ টাকা করে দেন, স্কুলে যাবার সময়। শুক্রবার স্কুল বন্ধ, ঐ দিন পায় না। সেদিন স্কুল থেকে ফেরবার সময় বাজারের খেলনার দোকানটার সামনে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে দেখে সাজানো খেলনা গুলো। একটা খেলনা গাড়ি ভাল লাগে খুব। এই বয়সটায় রঙের নাম ওলট পালট করাই স্বাভাবিক। নীল রঙের খেলনার গাড়িটা, মুখ কুঁচকে ভয়ে ভয়ে দেখিয়ে দোকানদারের কাছে মিহি জানতে চাইল, আঙ্কেল, আঙ্কেল, সবুজ গাড়িটার দাম কত?
দোকানদার হাত দিয়ে দেখানো নীল রঙের প্লাস্টিকের গাড়িটার দিকে একবার তাকাল। আর একবার তাকাল, মিহির মুখের দিকে। ভাবলেশহীন ভাবে বলল, ৫০ টাকা।
মিহি একটু সময় কি যেন ভাবল। প্লাস্টিকের গাড়িটার দিকে আবার কিছুক্ষণ তাকাল। এই গাড়ির মাথায় সুতা লাগিয়ে টেনে টেনে চালাতে হয়। গাড়িটা খুব পছন্দ হয় মিহির। স্কুল ইউনিফর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা দুই টাকার নোট বের করে, দোকানদারকে দেখিয়ে বলে, আর কয় টাকা হলে কেনা যাবে?
দোকানদার মিহির মুখের দিকে তাকিয়ে হাতে রাখা দুই টাকার নোটের দিকে তাকায়।
- আরও ৪৮ টাকা লাগবে। এমন ২৫ টা নোট হলে, কিনতে পারবে।
মিহি দুই টাকার নোটটা পকেটে আবার রেখে, গাড়িটার দিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে, আচ্ছা বলে। বাবার কাছে টাকা চাইলে ৫০ টাকা দিতে পারবেন না, এই বয়সেও জানে বেশ মিহি। অনেক কিছুই জানে এই ছোট বয়সেই। তাই ৫ দিন টাকা জমিয়ে ১০ টাকা দিয়ে একটা ছোট মাটির ব্যাঙ্ক কিনে। এরপর সেই ব্যাঙ্কে টাকা জমানো শুরু করে। বাবার দেয়া প্রতিদিনের ২ টাকা। কোন দিন ২ টাকার পয়সা, সে পয়সা ফেললে টুক করে শব্দ, আর কোনদিন ২ টাকার নোট, তা ফেললে নিঃশব্দ। ৯ দিনে ১৮ টাকা জমেছে। লাগবে ৫০ টাকা। খাটের নিচের এক কোণায় লুকিয়ে রাখা মাটির ব্যাঙ্কটা মা দেখেছেন। মাকে বলেছে জমাচ্ছে টাকা। প্রতিদিনের খেতে দেয় যে দুই টাকা, সেই দুই টাকা। মা বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন মিহিকে।
মায়ের চোখ ভিজে আসে ছেলেকে জড়িয়ে বুঝতে পারে না মিহি। তবুও বুঝতে পারে, সংসারের অবস্থা ভাল না। ঘরে কিইবা আছে? একটা ভাঙা টিনের ঘরের মধ্যে ঘুণে ধরা কাঠের চৌকি, তার উপর বিছানো আধ ময়লা বিছানার চাদরের উপর তিনটা বালিশ। কাপড়ে গাদাগাদি করা একটা ছোট কাঠের আলমারি, কয়েকটা হাড়ি পাতিল, চামচ, বাটি আর কিছু প্লেট গ্লাস এই। সংসারের এই অবস্থায় একটা খেলনা গাড়ি চাওয়া, ঠিক নয়। বাবা কিনে দিতে পারবেন না। তাই নিজেই প্রতিদিনের খাবার টাকা জমাচ্ছে।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া একটা ছেলের বুদ্ধি এতোটুকু থাকে না, যতটুকু মিহির আছে, কথাটা ভুল। কথাটা হবে, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া একটা ছেলের বুদ্ধি এতোখানি থাকে না, যতখানি মিহির আছে। অবশ্য এতোটুকু আর এতোখানির পার্থক্য বুঝতে পারে না মিহি। বুঝতে পারে, তিন জনের এই সংসারে অনেক কষ্টে চলতে হয় মিহির, কষ্ট হয় মায়ের, ঠিক তেমনি অনেক কষ্টে চালাতে হয় বাবার। বাবা আসলে ওভাবে কোন কাজ করেন না। বাজারে যান, ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজেন।
দিন মজুরের কোন কাজ পেলেও করেন, পিছনে গাড়ি ঠেলার কাজ পেলেও করেন, করেন ট্রাক থেকে তরকারী নামাবার কাজ পেলেও তা। বাবাকে খুব ভালবাসে মিহি। মিহিকেও বাসেন বাবা। তবুও বাবা ঘরে যখন আসেন সন্ধ্যায়, সারাদিনের কাজ করে, তখন বড্ড ভয় করে। ঘরে এলেই মায়ের সাথে খুব রাগারাগি করেন। বাজার নিয়ে এসে মায়ের গায়ের উপর ছুড়ে মেরে বলেন, নে খা। যত পারিস খা। তোরা খাওয়া ছাড়া আর কি পারিস? খালি পারিস গিলতে আর ঘুমাইতে।
মা কিছু বলেন না, চুপ করে থাকেন। কিছু বলতে গেলেই রাগ আরও বেড়ে যাবে বাবার। সারাদিন অনেকে আসে বাসায়। দরজার কাছ থেকে বাবার নাম ধরে ডাকে। সবাই টাকা পায় বাবার কাছে। বাবা ধার করেছেন। মা এইতো কয়েক মাস আগে খুব অসুস্থ হয়ে গেল। নানা জনের থেকে টাকা এনে করানো হল, চিকিৎসা। সেই হিসেবে ধার করা। বাবার মাঝে মাঝে কাজ থাকে না। তখন নানা জনের কাছ থেকে টাকা এনে চলতে হয়। পেট চালানোর দায়। এই পেটের জন্য পৃথিবীতে এতো কিছু। পেট না থাকলে ক্ষুধা না থাকলে, মানুষ গুলো বড় ভাল থাকত। এতো ভেদাভেদ থাকত না, থাকত না এতো ধনী গরীব হিসেব। মায়ের মাঝে মাঝে মিহির মুখের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগে, কিছু ভাল মন্দ খাওয়াতে ইচ্ছা করে। বাকিতে এক লোকের কাছ থেকে, দুধ কিনে।
মিহিকে সেই দুধ ঘুমাবার আগে গরম করে খেতে দেন। সারা মাসের চাল, তেল, সাবান কিনে নিয়ে আসেন একটা মুদি দোকান থেকে। তাও বাকিতে। মাস শেষে টাকা দিয়ে দেন। বাবার কাজের খুব একটা ভাল দিন যাচ্ছে না। তাই এতো গুলো মানুষের কারও দেয়া হচ্ছে না টাকা। নিয়মিত বাসার সামনে এসে এরা তাড়া লাগায় টাকার জন্য। মা সবাইকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে বলেন, আগামী সপ্তাহে আসেন। অন্তত এক সপ্তাহের জন্য হাফ ছেড়ে বাঁচতে চান। এরা মায়ের সাথে খুব একটা ভাল ব্যবহার করে না। তবুও এরা পাওনাদার চাইলেই এদের মুখের উপর কিছু বলে দেয়া যায় না। মা মুখ বুজে সহ্য করেন। সহ্য করেন বাবার বলা সব গুলো কথাও। মাকে যখন বাবা বকেন, মিহির খুব ভয় করে। লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। যেখানে লুকালে এসব দেখতে হয় না। মিহির চোখ ফেটে কান্না আসে। কাঁদতে পারে না।
আজ দুপুর বেলা এক লেইস ফিতা বিক্রেতা বাসার সামনে এসে তার লেইস ফিতার ঝুড়ি খুলে। বাসার আশেপাশের সবাই সেখান থেকে কিনে নানা কিছু। মায়ের বয়স অনেক হয়ে যায় নি। মায়ের এখনও সাজগোজ করার বয়স আছে। মা কখনও করেন না এই যা। সবাই যখন কিনে, মা দূরে দাড়িয়ে দেখেন। মিহি দেখে কাছে গিয়ে। এক জোড়া চুড়ি ভাল লাগে মিহির, মনে হয় ভাল লাগবে মা পরলে। ছোট বাচ্চার মনের ইচ্ছা। মাকে টেনে নিয়ে চুড়ি দেখায়। মা বলেন, টাকা নেই। লেইস ফিতা বিক্রেতা বলেন, ভাবী রেখে দেন, ছেলে পছন্দ করছে। টাকা পরে দিয়েন। আমি পরে একদিন নিয়ে যাব।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিনে নেন চুড়ি জোড়া ছেলের মন রক্ষা করতে, বাকিতে। মিহির খুব ভাল লাগে। আলতো রোদ মায়ের সেই চুড়ির উপর পড়ে চকচক করে, মিহি তা দেখে। মায়ের হাতে চুড়ি দেখতে ভাল লাগে। মা কোমল হাতে হাত বুলিয়ে দেন, মিহির মাথায়। আজ সারাদিনেও আসে অনেকে, টাকার জন্য। বাবাও সন্ধ্যার পর ফিরে আসেন। আজও কাজ হয় নি। সারাদিন ঘুরেও কোন কাজ পান নি। মন মেজাজ খারাপ থাকবার কথাই। খারাপও মন মেজাজ। সব রাগ এসে দেখান মায়ের উপর। মায়ের হাতে নতুন চুড়ি দেখে রাগ আরও বেড়ে যায়। অকথ্য ভাষায় বকা দেন খানিক সময়।
- খাবার টাকা নাই, মনে রঙ লাগছে। চুড়ি পিনছিস?
হাতের কাছের তরকারির চামচটা দিয়ে সজোরে কয়েকটা বাড়ি মারেন মায়ের শরীরে। মা শুধু একবার আর্তনাদ করে, এরপর নিঃশব্দে কাঁদেন। মায়ের করার কিছু নেই। মা অসুস্থ। চাইলেই কাজ করতে পারেন না। অভাব অনটনের কিছুই দূর করার সাধ্য মায়ের নেই। মা তা জানেন। জানেন বাবাও। তবুও মায়ের উপর রাগ দেখান। মানুষ রাগ দেখায় কাছের মানুষ গুলোর উপরই। রাগ যত চরম মাত্রার, দেখাবার মানুষটা তত কাছের। মাকে মারার সময় মিহি চৌকির পায়া ধরে বসে থেক, চুপ করে। ভয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় চারপাশে। একবার তাকায়, মাটির ব্যাঙ্কটার দিকে। ভাবে, এই মাটির ব্যাঙ্কের টাকাটা বাবার হাতে দিবে কিনা। অনেক দিন ধরেই তো জমাচ্ছে। এই ১০ দিন। ১০ দিনের জমানো টাকায় কি বাজার করা যাবে? যাবে কি কারও ধার দেনা শোধ করা? এই ১০ দিনের টাকা দিলেই আর বাবা মারবে না মাকে, হাতে নতুন চুড়ি দেখলেও?
মিহি দিন রাতের হিসেব জানে, কখন সকাল হয়, কখন হয় সন্ধ্যা। কিন্তু সকাল সন্ধ্যার মাঝে বাস করা মানুষের জীবনের জটিলতার কিছুই জানে না। এই মাটির ছোট ব্যাঙ্কের টাকায় যে কিছুই হয় না বুঝতে পারে না মিহি। অভাবের সংসারে ঝগড়া ঝাটি, মাঝে মাঝে এমন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মারামারি বড় সাধারণ দৃশ্য। এসব ধরে বসে থাকে, উঁচু পরিবারের মানুষ গুলো। একটু ঝগড়া হলেই, চলে ব্যাগ গুছানো, তা গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবার আয়োজন। নিচু পরিবারে এসব হয় না।
মা শরীরে আঘাত নিয়েই, ভাত বসিয়ে দেন। ভাতের মধ্যে দিয়ে দেন আলু। বাবা সেই আলু ছিলিয়ে ভর্তা বানান। সেই আলু ভর্তা দিয়েই রাতের খাবার খেয়ে তিন জন ঘুমাতে যায়। একটু আগেই ঘটে গেল এমন একটা ঘটনা সেসব একদম মনে হয় না। অভাবের সংসারে মনে রাখার, চিন্তার অনেক কিছু থাকে। এসব ছোট বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় কই? কিভাবে কালকের দিনটা চলবে, সে চিন্তায় যখন চোখের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে মান অভিমানের সুযোগ কোথায়? সুযোগ কোথায়, শরীরের ভিতর জমে থাকা রোগ, ব্যথার কথা চিন্তা করার?
পরের দিন স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়। এতো অভাবের মাঝেও সকালে কাজে যাবার আগে মিহির হাতে একটা দুই টাকার পয়সা ধরিয়ে বাবা দিয়ে যান।
- বাবা রে, ভাল কইরা পড়িস।
বলে মাথায় জড়িয়ে আদর করে যান। অভাবের এই সংসারেও মিহি জানে, মিহির প্রতি বাবা বা মা কারও ভালবাসার কমতি নেই। ছিল না কখনও। সেই দুই টাকার পয়সাটাও ব্যাঙ্কে ফেলে টুক করে শব্দ করে। হিসাবে আসে, জমেছে ২২ টাকা। সূর্যের আলোর চলাচলের মত, সব আগের মতই চলে। মিহি যায় স্কুলে, ফিরে আসার পথে দেখে আসে গাড়িটা। বাড়িতে এসে দরজার কাছে একেক জনের আসা যাওয়া দেখে। পাওনা দার সব। সন্ধ্যা শেষে আবার বাবা সেই ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসেন। সব ঠিক আগের মত। একটা দম বন্ধ হওয়া, পরিবেশ। তবুও মিহি বুঝতে শিখে গেছে এটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিকে অস্বাভাবিক ব্যাপার এটাই, আজ সন্ধ্যার পর একজন বাবাকে ডাকছেন। বাবা ঘরের মধ্যে আছেন। তবুও মাকে বাহিরে যেতে বলেন। মা বলেন, আমাকেই শুধু পাঠান। আমি আর কত মিথ্যা বলব? আপনি যান। কথা বলেন। এরা বুঝবে আপনি বললে।
- কথা কম বল। যেতে বলছি যা।
মা বাহিরে যান। মুদি দোকানদার এসেছে। যেই দোকান থেকে বাকি আনে। সাথে দুজন লোক।
- কি ভাবী, আর তো মানা যাচ্ছে না। টাকাটা দেন আজকে।
- ভাই, একটু সমস্যা হয়ে গেছে যে।
- আরে রাখেন আপনার সমস্যা। এনে খাবার সময় চিন্তা ছিল না? আপনি টাকা দেন এখন।
- ভাই আর কয়টা দিন সময় দেন।
- কিসের সময়? কয় মাস ধরে ঘুরাচ্ছেন? হয় আজকে টাকা দিবেন, না হয় ঘরে যা আছে, সব নিয়ে যাব। লোক নিয়ে আসছি।
- ভাই একটু দেখেন। আগামী সপ্তাহে ঠিক দিয়ে দিব।
লোকটা আর কোন কথা শুনে না। সাথের লোক নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। ঘরে ঢুকেই দেখতে পায়, মিহিকে। মিহিকে কোলে নেয়া বাবাকে। লোকটা রাগী রাগী মুখে তাকিয়ে বলে, কি ভাই টাকা পয়সা দিবেন না? চোরের মত ঘরের মধ্যে লুকাইয়া আছেন।
- ভাই, কাজ কাম নাই। দিয়া দিব।
- আরে রাখ তোর কাজ কাম। তোরে কাজ দিবে কে? শালা চোর। ধইরা দুইটা লাগাইলেই না ঠিক ঠিক টাকা বাইর হবে।
লোকটার কথা শুনে। বাবার মুখটা লজ্জায় অপমানে শুকিয়ে গেল। বাবা এক হাত দিয়ে মিহিকে ধরে, আর হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলেন। লোকটা ঘরের আসবাব পত্র সব নেড়ে চেড়ে দেখছে। একটা বস্তা বের করে হাড়ি পাতিল সব তার মধ্যে ঢুকাচ্ছে। মায়ের বিভিন্ন সময় সখ করে কেনা কয়েকটা নতুন প্লেট তাও নিয়ে নিচ্ছে। মা বাবা দুজনেই লোকটার কাছে গিয়ে অনুরোধ করছে এসব না নেবার জন্য। বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে নিল এমনকি বালিশ গুলো। মায়ের কিছু শাড়ি আছে নতুন সেগুলো। বাবা এবার পায়ের কাছে পড়লেন লোকটার।
ভাই সত্যি কথা দিয়ে দিব, আগামী সপ্তাহে টাকা। একটা কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাইবে।
লোকটা বাবাকে হাতের লাঠি দিয়ে একটা আঘাত করে সরিয়ে দিল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বাবা। মা বাবাকে শুধু হাত দিয়ে ধরলেন। আঁচল মুখে গুজে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি। মিহি একটু দূরে তাকিয়ে ছিল। কাঁদছিল মিহিও। ছোট ছোট হাত দিয়ে মুছছিল গালের পানি। বাবা আর একবার পা জড়ালেন লোকটার।
লোকটা আবারও লাঠি দিয়ে পিঠের উপর জোরে আঘাত করলেন। বাবা একটু আস্তে করে আর্তনাদের মত করে উঠলেন। কেঁপে উঠল মিহি। মিহি চৌকির কোণা থেকে মাটির ব্যাঙ্কটা বের করল। লোকটার সামনে গিয়ে ধরাম করে ভেঙে ফেলল ব্যাঙ্কটা। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটির ব্যাঙ্কের টাকা গুলো একটা একটা করে হাতে নিল, দুই হাত ভরে সেই টাকা লোকটার দিকে বাড়িয়ে, ভেজা চোখে রাগ নিয়ে বলল, আমার আব্বুকে মারবেন না বললাম। এই টাকা নেন। আমাদের জিনিস দেন। আমার আম্মুর শাড়ি দেন। দেন বলছি। না দিলে কামড় দিব কিন্তু।
ঘরটায় খানিক সময়ের জন্য নীরবতা। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা মিহির দিকে। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে, মিহির বাবা, মিহির মা। আর গাল বেয়ে পানি পড়া, ভেজা চোখে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে মিহি। হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে ২২ টাকা। ১১ দিনে জমানো ২২ টাকা। সেই টাকা দিয়ে ফেরত চাচ্ছে, ঘরের সব কিছু, ফেরত চাচ্ছে মায়ের শাড়ি, চাচ্ছে বাবাকে আর আঘাত না করুক, চাচ্ছে শোধ করে দিতে লোকটার দেনা। মিহি জানে না, এই ২২ টাকায় কিছুই হয় না। তবুও নিজের সবটা দিয়ে চাচ্ছে প্রিয় কিছু বাঁচাতে।
এতোটুকু টাকার হিসেব এটা না, এটা যে এতোখানি এতোখানি টাকার ব্যাপার। মিহি এতোটুকু আর এতোখানির পার্থক্য বুঝে না।
লোকটা অবাক হওয়া চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, হাতের সব কিছু রেখে চলে যায়। সময় দিয়ে যায় আর সাত দিন টাকা শোধ করে দেবার। চলে যাবার পরও মিহি কাঁপছে রাগে। হাতের মুঠোর ভিতর ধরে রেখে টাকা গুলো। বাবা এসে জড়িয়ে ধরলেন মিহিকে, অন্য পাশ দিয়ে মা। বাবা মায়ের বুকের ভিতর বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। খুব এলোমেলো ঝড়। সেই ঝড়ের ঝাপটায় কাঁদছেন দুজন ছেলেকে জড়িয়ে। কাঁদছে মিহিও। শব্দ করে কাঁদছে। জড়িয়ে ধরছে বাবা মাকে অনেক শক্ত করে।
ঠিক যতটা শক্ত করে ধরে আছে, হাতের মুঠোও টাকা গুলো। বড় রাগ হচ্ছে টাকা গুলোর উপর, কেন হচ্ছে জানে না। এই কাগজ গুলো, এই পয়সা গুলোর ভিতর এমন কি আছে? যার অভাবে চাইলেই একটা ইচ্ছা পূরণ হয় না। যার অভাবে খেতে পায় না ঠিক মত, চলতে পারে না সুখে, জোটে না পরবার মত কাপড়, হাতে দেবার মত চুড়ি। যার অভাবে আঘাত সহ্য করতে হয় কখনও স্বামীর হাতে স্ত্রীর, কখনও একটা পাওনা দারের হাতে সন্তান বউয়ের সামনে একটা বাবা বা স্বামীর।
যার অভাবে অনেক করেও পূরণ হয় না মিহির মত ছোট একটা বাচ্চার করা অনেক দিনের কোন সখ। যার কারণে হিসেব হয়, যে বাঁচবে আর কে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। যার কারণে হিসেব হয়, কে উঁচুতে থাকবে আর কে পায়ের কাছে। কার ইচ্ছে চাবার আগেই পূরণ হবে, কার কারও কাছে হাত পাততে হবে।
হয়ত দিন গুলো বদলাবে না, চলবে আগের মত। পূরণ হবে না মিহির চাওয়া গুলো। কিংবা কখনও বদলে যাবে, হুট করে কিছু। বা সময় নিয়ে। অভাবের এই দিন গুলো, রাত গুলো, কাটবে কষ্টে, কাটবে হতাশায়, কাটবে চোখের জলে, কাটবে ব্যথা রোগ শোকে। জানে সবাই। জানে যারা আছে তারাও। যারা নেই এমন তারাও। তবুও মিহির মত কাউকে বুকে জড়িয়ে মিহির বাবার মত, মিহির মায়ের মত কেউ সুখ পায়। মিহি ছোট হাতে যখন মায়ের হাতে চুড়ি দেয়, মায়ের কাছের সুখটা বড় দামী। যখন বাবা হাজার কষ্টেও মিহির হাতে দুই টাকা ধরিয়ে দেয়, সে সুখটাও বড় দামী।
বড় দামী নিজের জমানো সেই মাটির ব্যাঙ্কের টাকায় কিছু হবে কিনা না জেনেও, বাবাকে বাঁচাবার জন্য, মায়ের শাড়ি বাঁচাবার জন্য, পাওনাদারের সামনে টাকা ধরে ছোট বাচ্চাটার অনেক বড় হয়ে যাওয়ার সুখটা। এই ছোট ছোট সুখ গুলো, এতো দুঃখের মাঝেও বেঁচে থাকার শক্তি। বেঁচে থাকার তুচ্ছ কারণ। বেঁচে থাকতে বড় কোন কারণ লাগে না, বড় কারণ লাগে মরে যেতে। বেঁচে থাকার জন্য খুব তুচ্ছ কোন কারণ লাগে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা হলেও তুচ্ছ কারণ অবশিষ্ট থাকে, মানুষটা বেঁচে থাকে। নতুন করে আশায় বেঁচে থাকার পথ খুঁজে।
by- শেষ রাতের আঁধার (রিয়াদ)
২৭ নভেম্বর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/এসএসুমন/এমএইসমুহিত/রিয়াদ