রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৩২:১২

সেই দিনটাতেই বিয়ে আমার

সেই দিনটাতেই বিয়ে আমার

পাঠকই লেখক :
অন্তু,
কেমন আছিস গাধা?
তোর খবরাখবর শোনার পর তোকে আর ফোন করতে ইচ্ছে হল না, তারচেয়ে বরং মেইল করাটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। ফোনের আলাপের কোন রেকর্ড থাকবে না, কিন্তু এই মেইলটা সারা জীবন তোর কাছে থেকে যাবে। কোন একদিন হয়তো তুই এই ইলেক্ট্রনিক চিঠি পড়ে হাসবি, আর ভাববি এইসব কথা তোকে লিখেছিলাম! আবার হয়তো এই মেইল পড়তে পড়তে একদিন আমায় স্মরণ করবি, আমাকে পাল্টা মেইল করার ইচ্ছে থাকলেও করতে পারবি না। আমি হয়তো অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেব ততদিনে। দেখেছিস গাধা, চিঠির কত সুবিধা! আজকাল মানুষ এই চিঠির আনন্দ থেকে বঞ্চিত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে আড্ডা দেবে, ঝগড়া করবে, অথচ এই শৈল্পিক জিনিসটার আনন্দ টের পাবে না। বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।

মূল আলোচনায় আসি। শুনলাম খালুসাহেব নাকি তোকে বিয়ে দেবার প্ল্যান করছেন? ঘটনা সত্য হলে বিরাট চিন্তার বিষয়। আমার ধারনা তুই ব্যাপারটা রিমিকে এখনো বলিস নি(তোর বুদ্ধিশুদ্ধির উপর আমার পূর্ণ আস্থা থেকেই ধারনা করছি)। দেরি না করে ওকে বুঝিয়ে বল, ও ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। হয় তোকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, নয়তো সোজা গিয়ে খালুসাহেবকে সালাম করে বলবে, ‘বাবা, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’ খালুসাহেব বুদ্ধিমান মানুষ, তিনি মুখের উপর কিছু বলবেন না। তিনি বুদ্ধির খেলা খেলবেন। সেই খেলায় তুই দ্রুত ধরা খাবি, তবে ঈশ্বর তোর পাশে যে মায়াবতীকে
পাঠিয়েছেন, তার বুদ্ধিশুদ্ধি তোর বিপরীত। সে খালুসাহেবকে পরাস্ত করতে পারবে বলেই আমার ধারনা।

কিভাবে এতো নিশ্চিত হলাম জানিস? প্রকৃতি ব্যালেন্স পছন্দ করে, তুই এই সমস্যা নিয়ে যতটা চিন্তিত, রিমি এতোটা চিন্তিত হবে না। তোরা দুজন বিপরীত মেরুর মানুষ বলেই তোদের কেমিস্ট্রি ভালো জমেছে। এখন অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী বিক্রিয়া দেখার জন্য।
কি হল জানাবি।

ইতি-

তোর দুস্থ (তুই আমাকে দোস্ত ডাকিস, শব্দটা আসলে 'দুস্থ' হবে, তুই অর্থনৈতিক ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করতে পারিস না)

পুনশ্চঃ- তুই একটা গাধা।
পুনশ্চঃ- তুই একটা বিরাট গাধা।
পুনশ্চঃ- তুই অতি সৌভাগ্যবান গাধা, কারন তুই ভালোবাসার দেখা পেয়েছিস।

২.

দোস্ত,

কেমন আছিস?

আমি ভালো ছিলাম না, তবে তোর চিঠি পাওয়ার পর থেকে একটু ভালো আছি। তোর বুদ্ধি মত কাজ করেছি, রিমিকে সবকিছু খুলে বললাম, বাবা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে এইসব। তোর ধারনা ছিল রিমি সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলবে, বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। রিমি সবকিছু শুনে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, বেশ তো, বিয়েটা করেই ফেল।

ওর উত্তর শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এতো দিনের প্রেম, এইভাবে ও বলতে পারলো? হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে রিমি ফোন করে বল,'এক্ষুনি বাবার সামনে গিয়ে বল, আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবে না, যাও আমি লাইনে আছি...
আমি বিড়বিড় করে বললাম, এটা কিভাবে বলব?

রিমি কড়া গলায় বলল, যদি এক্ষুনি না বল, তাহলে আমার হাতে ত্রিশটা মিডাজোলাম ট্যাবলেট আছে, সবগুলো একসাথে খেয়ে ফেলব। যাও এক্ষুনি, আমি লাইনে আছি...

এক কানে ফোন ধরে আমি ড্রয়িংরুমে গেলাম। মা বসে বসে টিভি দেখছেন আর রিমোটে চ্যানেল পাল্টাচ্ছে, একপাশে বসে বাবা পত্রিকা পড়ছে। আমি বললাম, বাবা, একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম...

ফোনের অপর প্রান্তে রিমি গর্জে উঠলো, অ্যাই, মিনমিন করছো কেন? সরাসরি বলো,নইলে...

আমি এক নিঃশ্বাসে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেললাম,'বাবা, রিমি নামের একটা মেয়েকে আমি ভালোবাসি, ওকে ছাড়া আর কাউকে আমি বিয়ে করতে পারবো না...'

তারপর একসাথে তিনটি ঘটনা ঘটল। অপর পাশে রিমি ঘটাশ করে ফোনটা রেখে দিল, মায়ের হাত থেকে রিমোট পড়ে গেল, শুধু রিমোট না, মা নিজেও সোফার উপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল।

বাবা আমাকে হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু মায়ের অবস্থা দেখে আগে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও মা কে ধরলাম, মাকে বিছানায় শোয়ানোর কিছুক্ষনের মধ্যেই এম্বুলেন্স এলো। হাসপাতালের গেটের সামনে এসে মা'র জ্ঞান ফিরল। মা বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, এইটা আমার ছেলে? এইটা আমার ছেলে?

পুরো রাতটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। ডাক্তার বলেছে তেমন সিরিয়াস কিছু না, একটু অবজারভেশনে রাখতে হবে, ঘুমের ওষুধ দেবার পর থেকে মা ঘুমাচ্ছে। ছোটখালাকে সেখানে রেখে আমরা সবাই বাসায় ফিরে এলাম।

সকালে গিয়ে দেখি অদ্ভুত অবস্থা। মায়ের পাশে রিমি বসে আছে, মাথায় ঘোমটা। রিমিকে দেখিয়ে মা হাসতে হাসতে বলছে, তুই এই মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখেছিলি কেন গাধা? এতো লক্ষ্মী একটা মেয়ে, সেই সকাল থেকে আমার সেবা যত্ন করছে, আমিতো ভেবেছিলাম নতুন ডাক্তার কিনা, পরে পা ধরে বসে রইল, ওর জন্য নাকি এসব হয়েছে, আমি মাফ না করলে নাকি পা ছাড়বে না। কি মেয়েরে বাবা! এই লক্ষ্মী মেয়েটাকে তুই আমার থেকে দূরে রেখেছিলি? তুই গাধাই থেকে গেলি, মানুষ হলি না...

আমি হয়তো আসলেই গাধা। নাহলে রিমি কিভাবে মা'কে পটিয়ে ফেলল বুঝলাম না। বাবা আমার সাথে কথা বলছে না, অথচ রিমির সাথে শান্তিনিকেতনী ভাষায় 'মা গো' করে কথা বলছে। বাসায় আমি বেকুবের মত বসবাস করছি, অনেকটা নিজভূমে পরবাসী হওয়ার মত অবস্থা।

আমার বাপ-মা অলরেডি রিমির দখলে চলে গেছে, বেডরুম-বাথরুম সবকিছুই পুরোপুরি ওর দখলে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক হয়েছে।
আজ থেকে তিন বছর আগে, যেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওকে একগুচ্ছ কদম ফুল দিয়েছিলাম, ঠিক সেই দিনটাতে।

আগামী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার, আমাদের দোয়া করতে না হোক, অন্তত ভরপেট খাওয়ার জন্য হলেও চলে আসবি।

ইতি-

তোর গাধা

লিখেছেন -মাহবুব হোসেন

(এই চিঠিগুচ্ছ হুমায়ূন আহমেদ স্যারের পুণ্যস্মৃতিতে উৎসর্গ করা হল)

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে