একজন নীরার গল্প
পাঠকই লেখক : চাকরিটা কি বেশি দরকার?
জ্বী, স্যার।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ শেষে সামাদ সাহেব বললেন, আচ্ছা এখন তো সময় নেই, বুঝতো, ব্যস্ত মানুষ। রাতে কি ফ্রি থাকবে? না, মানে একসাথে ডিনার করাও হবে, বেতনটা স্যাটেল করা যেতো।
নীরার কল্পনায় অসুস্থ বাবার ছবিটা ভেসে উঠলো। চাকরিটা যে খুব দরকার। তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে, মুদি দোকানে বাকি শোধ হয় নি। ছোট ভাইটার রেজিস্ট্রেশন হয়নি, সময়ও বেশি নেই।
এই মেয়ে কি বলো? আমি উঠবো এখন।
হ্যাঁ, না , না মানে স্যার, হ্যাঁ। জ্বী স্যার একসাথেই ডিনার করবো, নিচু স্বরে বলে নীরা।
ওকে, ইয়াং লেডি। রাতে তাহলে কথা হচ্ছে। আর শোনো বাসায় বলো যে চাকরি পেয়েছি তার জন্যে আজ রাত থেকে কাজ বুঝে নিতে হবে। আচ্ছা।
অফিস থেকে নীরা যখন বের হলো তখন মনে হলো ওর দুনিয়াটা যেনো কালবৈশাখীর ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই মনে হলো, আমি ঠিক আছি, আমার পরিবারকে তো আমাকেই দেখতে হবে।
শায়লা বেগমের মনে আনন্দ আজ আর ধরে না। মেয়ে চাকরি পেয়েছে। এখন থেকে আর ভাবতে হবে না। মেয়েই সব দেখতে পারবে, কিন্তু রাতে আবার কি কাজ থাকতে পারে সেটা নিয়ে মনের ভিতর কেমন যেনো খটমট করছে। আরেহ এখনকার দুনিয়ার কত্ত হিসেব নিকেশ, আমি কি তার সব বুঝি নাকি? আপনমনেই বলেন তিনি।
মা, কি করছো? মা, দেখেছো বাবা একটুও খুশি হয় নি আমার চাকরির কথা শুনে। কপট রাগ দেখায় নীরা।
শুনো, দেখি পাগলীর কথা! বাবা খুশি হবে না তো কে হবে? তোর বাবা তো কষ্ট পায় তোর এই সময় ঘর-সংসার করার কথা, আর তুই আমাদের টানছিস। দীর্ঘশ্বাষ ফেলেন মা।
মা, এসব কথা বলবে না। আমি যদি তোমাদের বড় ছেলে হতাম তবে কি দেখতাম না?
আচ্ছা, ঠিক আছে মা । মেয়ের কপালে আলতো চুমো খেয়ে মা উঠে যান।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, নীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। ইসস আকাশ যদি ছোয়া যেতো। তবে আকাশ ছুঁয়ে খেলা করতাম। ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠে সে। মাঝে মাঝে ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, কি দিন গুলো-ই ছিলো তখন! মোবাইলের রিংটোনে বাস্তবে ফিরে আসে সে। সামির ফোন,
কি, ব্যাপার কই থাকো তুমি? তোমার যে কোনো খবর-ই নাই? শুনলাম চাকরি নাকি পেয়েছো?
এইতো, কে বলেছে তোমাকে যে আমি চাকরি পেয়েছি? আর আমার খবর নাও তুমি?
আরেহ রাগ কোরো কেনো, সুন্দরী? জানো তো আমি কত্ত বিজি থাকি।
রাগ করলাম কোথায়? বললে না তো কে বলেছে আমার চাকরি হয়েছে?
সুমনের সাথে দেখা হয়েছিলো আজ, সেই বললো যে তোমার চাকরি হয়েছে।
আচ্ছা, শুনো, মাথাটা না একটু ধরেছে। পরে কথা বলবো আর তোমার কি কাল বিকেলে সময় হবে?
আমি তো সব সময়-ই ফ্রি। শব্দ করে হাসে সামি।
তাহলে প্রথম যেখানে আমাদের দেখা হয়েছিলো সেখানে ওয়েট করো। আমি অফিস শেষে আসবো, বলেই সামিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয় নীরা।
শোনো তোমাকে অনেক দিন ধরে একটা কথা বলবো বলবো করে আর বলা হচ্ছে না। আজ ভাবছি বলেই ফেলি, আই লাভ ইউ, নীরা। আই লাভ ইউ সো মাচ।
অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক আগেই কল কেটে গেছে। ধুর, শালা। ফোন দেয়ার উপায় নেই, আজ তিন দিন ধরে মোবাইলে দশ পয়সা ব্যালেন্স নিয়ে ঘুরছে। এই মাসে এখনো টিউশনির টাকা দেই নাই। শালার দুনিয়া! রোজা রেখে এতোটা পথ হেঁটে যাই, মাসের হয়ে গেলো বার তারিখ কিন্তু টাকা দেয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। নিজেদের শপিং তো ঠিক-ই চলে! মানুষ আর মানুষ থাকলো না, আপনমনে-ই কথা বলে সামি।
আপু, তোমার ফোন? ছোটো ভাইয়ের কাছ থেকে ফোনটা নেয় নীরা।
হ্যালো
আমি তোমার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি, তোমার বাসার নিচে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে।
আচ্ছা, স্যার। আমি আসছি।
কিরে, মা! বসে আছিস কেনো? তোর না এখন চাকরিতে যাওয়ার কথা। কি কাজ নাকি বুঝে নিতে হবে
এই তো মা এখুনি যাচ্ছি।
মা, দেখছো। আপুকে নেয়ার জন্যে নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কি সুন্দর গাড়ি!
কি ছেলে আমার! মুখ লাগবে তো, মাশাল্লাহ বল।
মা, আমি গেলাম।
দাঁড়া, একটু দোয়া করে দেই।
হুম, নীরা দাঁড়ায়। দোয়া দুরুদ পড়ে মেয়ের মাথায় ফুঁ দিয়ে দেয় মা।
গেলাম। ছোটো, গেলাম রে।
দোতোলার ভাঙ্গা রেলিং থেকে মা আর ছেলে নীরার গাড়িতে উঠা দেখে।
এক মাস পর। সামির মোবাইলে একটা মেসেজ আসে, দেখে নীরা পাঠিয়েছে...
তুমি আমাকে ভুলে যাও। তোমার মতো বেকার ছেলের জন্যে আমি আমার জীবনটা নষ্ট করতে পারবো না। আমার নিজের জন্যে ভাবতে হচ্ছে, পরিবারের জন্যে ভাবতে হচ্ছে। এক কলিগের সাথে আমার বিয়ের কথা বার্তা চলছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাসে বিয়ে হয়ে যাবে। আমি চাই না তোমার জন্যে কোনো ঝামেলা হোক।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে সে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার দেখে। এই কি তুমি? নাহ, এই আমি না। আমি এখন অন্য এক মানুষ, মনহীন শরীর সর্বস্ব নীরা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন সামাদ সাহেব-
শুধু ঘর থেকে নয়, নারীদের সম্মান দিতে হবে অফিস থেকে কেননা নারীরা আজ কর্মক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আমরা যদি তাদের কর্মক্ষেত্রে যথার্থ সম্মান দিতে না পারি তবে তারা পর্যাপ্ত উৎসাহ পাবে না..................
বক্তব্য শেষে নিজের আসনে ফিরে আসেন সামাদ সাহেব। পাশ থেকে একজন বলেন, স্যার অনেক ভালো বলছেন। বাস্তব সম্মত বক্তব্য হয়েছে।
খুশিমনে মোবাইলটা বের করে মেসেজ পাঠান তিনি, নীরা, আজ রাতে...............
লিখেছেন - NH Moon