রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৩৫:১৩

অবশেষে

পাঠকই লেখক : ঠোটে রেড লিপস্টিক কেন দিয়েছিস? নিষেধ করেছি না? -রক্তচক্ষু নিয়ে শ্রাবন্তীর দিকে তাকিয়ে আছে মাহির।
নিশ্চুপ চোখ জোড়া একটি বারের মতোও পাতা বন্ধ করেনি শ্রাবন্তীর। চেয়ে আছে মাহিরের দিকে। মাহিরের হাতটা ধরে বলে, 'মুছে দে'। হাতটা ঠোটের কোনে চলে যাচ্ছে। তখনই শ্রাবন্তী দূরে সরে গেলো।

'এ্যাই, তুই আমার ঠোটে হাত দিবি কেন?'থুতনি বাকিয়ে বলল মেয়েটা। মাহির নিশ্চুপ চেয়ে আছে তার দিকে। কোন কথা বলছে না। শ্রাবন্তী খেয়াল করল মাহির কাপছে। তার হাতের লোম দাড়িয়ে আছে। এই ব্যাপার টা শ্রাবন্তীকে বরাবরই খুব ক্ষ্যাপায়। সব সময় শ্রাবন্তীর সামনে আসলে ছেলেটা এমন হয়ে যায়। অথচ অন্য মেয়েদের সাথে মাহির বেশ সাবলীল ভাবেই কথা বলে।

কারণটা শ্রাবন্তীর জানা আছে। অন্য মেয়েরা মাহিরের বান্ধবী। আর সে মাহিরের মনের মনিকোঠায় একা রাজত্ব করছে। ব্যাপার টা শ্রাবন্তীর বেশ ভালো লাগে। প্রত্যেকটা নারীই চায় তার মনসাজানিয়া প্রেমিক পুরুষের হৃদয় মন্দিরের একা মালিক হউক। যেখানে সে পূজা করতে পারবে তার প্রেমকে। যেখানে ফুল দিয়ে সাজাতে পারবে তার প্রেমের মূর্তিকে।

মনসাজানিয়া প্রেমিক পুরুষ!! চিকন হেংলা পাতলা ছেলেটা শ্রাবন্তীর ও মনে জায়গা নিয়ে নিয়েছে। নিস্পাপ চাহনী, চুপচাপ থাকা আর শ্রাবন্তীর সাথে সব কথা বলা, শ্রাবন্তীর কেয়ার নেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মাহির শ্রাবন্তীর মনে প্রেমের গাঁথনি বসিয়ে দিয়েছে।

মাহিরের এসব দিক ভালো লাগায় শ্রাবন্তীই মাহিরের সাথে স্বেচ্ছায় পরিচিত হয়। কিন্তু কেউ জানতো না একদিন তারা এভাবে বসে থাকবে। অথচ এই ছেলেই প্রথম দিকে মেয়েটাকে এড়িয়ে চলতো। সুন্দরী মেয়েদের সাথে কথা না বলা, তাদের কে এড়িয়ে চলা এসব মাহিরের অভ্যাস।

আর মেয়েরা তো!! তারাই। কোন ছেলে পাত্তা না দিলে ওই ছেলের সাথে যেতেই ভালোবাসে তারা। ওই ছেলের সাথে কথা বলতেই ভালোবাসে। কেন যেন ওই ইগো ওয়ালা ছেলেদের বাগে আনতে পারলে তারা নিজেদের ধন্য মনে করে। তাই তো শ্রাবন্তী মাহিরের জন্মদিনে সরাসরি তার বাসায় যায়। একটা কালো শাড়ি পরে। তার পেছনেও কারণ আছে। মাহিরের প্রিয় রং কালো। বাসায় পৌছে কলিং বেলটা কাপা হাতে চাপ দিলো শ্রাবন্তী। ঘুম ঘুম চোখে হেলেদুলে দরজা টা খোলে মাহির।

-আ আ আ আপনি?
-কেন আসতে পারি না?
-আপনি আমার বাসার এড্রেস পেলেন কোথায়?
-আপনার ফ্রেন্ডের কাছ থেকে।
-ও আচ্ছা।
এই ছেলেটা তো আসলেই বোরিং। একদম কম কথা বলে। যত্তসব। এত কম কথা বলে কেন। কারো বাসায় আসলে ভেতরে যেতে বলতে হয় সেটুকু ও বুঝি জানে না।
'আমি কি ভেতরে যেতে পারি?'-মুখ বাকা করে বললো শ্রাবন্তী।
মাহির চোখ মুছে বলল,'হ্যা অবশ্যই, আসলে স্যরি। ঘুম থেকে ওঠাতে মাথাটা কাজ করেনি। আসুন প্লিজ'
দেড় ইঞ্চি হিলের লাল জুতো জোড়া খুলে শ্রাবন্তী ঢোকে মাহিরের বাসায়। মাহিরের চোখ পড়ে শ্রাবন্তীর পায়ে। ফর্সা পা দুটোকে সাজিয়েছে পিংক নেইল পালিশ দিয়ে। চিকন করে লম্বা লম্বা আঙ্গুল গুলো। চোখ দুটো মুছতে মুছতে শ্রাবন্তীর দিকে তাকায় সে।
'হ্যাপি বার্থডে' মুচকি হেসে বলল শ্রাবন্তী। ছেলেটা কিছুটা অবাক হলো।

'আপনি আমার জন্মদিন কিভাবে জানলেন?'-চোখ গুলোকে ডিমের মতো করে তাকায় শ্রাবন্তীর দিকে। এবার আর চোখ সরেনা। অদ্ভুত এক মুগ্ধতা আছে মেয়েটার চোখে মুখে। মুচকি হাসছিল মেয়েটা আর তাতেই মনে হল যেন মুক্তো ঝরছে। হাত ভর্তি মেহেদি তার। সাদা হাতে মেহেদি পড়ে কালো হয়ে গেছে।কালো শাড়িতে বেশ ফুটে উঠেছে মেয়েটা। কালোর ভেতর সাদা।
'আপনি কি একা বাসায়?' ভয়ার্ত কন্ঠে বলে শ্রাবন্তী।
-জ্বি।
-আর কেউ নেই?
-সবাই গ্রামে বেড়াতে গেছে।
-আপনি যান নি?
-না। সেমিস্টার ফাইনাল চলছে।
-ও আচ্ছা। রান্না করে কে?
-কেউ না।
-তাহলে খান কি?
-বাইরে থেকে চিপস আর চানাচুর কিনে খাই।
-মানে? ভাত টোটালি খান না?
-নাহ।
-আচ্ছা আজ আমি রান্না করে দিবো।
-আপনি কেন রান্না করবেন?
-কেন? আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পারিনা রান্না করতে?
-হা হা হা শুভাকাঙ্খির নামই জানিনা আমি।
-ও আমি শ্রাবন্তী।
-আমি..
ব্যাস লাগবে না। আমি জানি আপনার নাম। সব জানি।।
-কিভাবে?(আশ্চর্য হয়ে জিগেস করলো মাহির)
-এমনি এমনি জেনে গেছি।
-ও
-রান্না করব?
-হ্যা সমস্যা নেই।
-সমস্যা আছে।
-কি?
-সমস্যা হল আমি রাঁধতে জানিনা। চা টা ও বানাতে পারিনা।
-আপনি মেয়ে তো?
-ডাউট হচ্ছে?
-হবার তো কথা।
-আচ্ছা, ঠিকাছে আজই দেখাব আমি কত গুণবতী।
ছেলেটার কাছে ব্যাপার গুলো আদিক্ষ্যেতাই লাগছে। তাও সৌজন্যতা বলতে একটা কথা আছে। এই মুহুর্তে মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে একা একা টিভিতে খেলা দেখতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু তা তো হচ্ছে না।

'মা গো' কিচেন রূম থেকে এই আওয়াজটা ভেসে আসলো মাহিরের কানে। দৌড় দিয়ে গিয়ে দেখে গরম পানি পড়েছে শ্রাবন্তীর হাতে। হাত টা চুড়ি ভর্তি ছিল। মাহির তড়িঘড়ি করে চুড়ি গুলো খুলে দিলো। তবে সেই চুড়ি আঘাত করেছে মাহিরের হৃদয়ে। কেমন যেন একটা জাদু আছে মেয়েটার ছোয়ায়। মাহিরের ভেতরে থাকা বুকের চব্বিশটা হাড় ভেঙ্গে দিতে যথেষ্ঠ ছিল সে ছোয়াটা। যত্ন করে এনে বসিয়ে দিল সোফায়।

-কি দরকার ছিল রান্না করতে যাবার?
-আপনিই তো বললেন আমি পারবো না।
-আপনি আপনি করে বলা কি ঠিক? আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারিনা?
শ্রাবন্তী খুশি। ছেলেটাকে টোপ গিলানো গেছে। এক কথাতেই রাজী হলো সে। সম্পর্ক টা মুহুর্তেই আপনি থেকে তুই তে গড়ায়।
দিন যাচ্ছে। তাদের ফ্রেন্ডশীপ চলছে। কিন্তু মাহিরের কেন জানি মেয়েটার হাত ধরতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
লাজ লজ্জা ভেঙ্গে প্রায়ই বলতো মাহির। কিন্তু কখনোই 'প্রপোজ' করা হয়নি।
-শ্রাবন্তী
-বল
-তোকে ভাল্লাগে আমার।
-জানি ।
-তোর সাথে প্রেম করব।
-প্রেম কিভাবে করে?
-ভালোবেসে।
-তো প্রপোজ কর।
-প্রপোজ কিভাবে করে আমি জানিনা ।
-শিখে আয়।
-শিখিয়ে দে।
-তাহলে আমাকে ভালোবাসতে হবে না। যাহ।
মেয়েরা ছেলেদের কে এক দিক থেকে কষ্ট দিয়ে বেশ মজা পায়। ভালোবাসে তাও স্বীকার করে না যে ভালোবাসি। তারা দেখতে চায় ছেলেটা কতটুকু সহ্য করতে পারবে। সহ্য ক্ষমতা দিয়ে ভালোবাসা মাপে আরকি!! ভালোবাসার মিটার বলা চলে।
নির্জন লেকের ধারে বসে আছে দুজন। সামনা সামনি।
মাহিরের হাতে একটা পানির বোতল আর শ্রাবন্তীর ভ্যানিটি ব্যাগ। ঘাসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহির। কপালের চামড়া গুলো এক হয়ে মাংস স্তুপ তৈরী করেছে। বিরক্তির ছাপ বসিয়ে বলে,
-বল কেন ডেকেছিলি।
-বাহ! এখন আর আমার কাছে আসা যায় না?
-ডেকেছিলি কেন সেটা বল।
-তুই কাপছিস কেন?
-কোথায় আমি কাপছি? আই এম ফাইন।
-না তুই কাপছিস।
-হুম কাপছি।
-কেন?
-তোর সামনে আসলে গায়ে শীত ও লাগে আবার আগুন ও ধরে। কিন্তু জানিনা কেন।
-ভালোবাসিস?
-হুম
-তো প্রপোজ কর।
-শিখিয়ে দে।
-আমি যেভাবে বলি সেভাবে করবি?
-হুম।
-ওই লেক টাতে গিয়ে সাঁতার দিবি। তারপর এসে বলবি।
-না। পারবো না।
-ওসব জানিনা। শিখাতে বলেছিস শিখিয়ে দিয়েছি ।
মাহির চুপ করে বসে থাকে। জেদ চাপে তার ভেতর। ইচ্ছে করছে সত্যিই সাঁতার দিয়ে আসতে।
আর মেয়েটার মন উতলা হয়ে আছে। কেন ছেলেটা হাটুগেড়ে সুন্দর করে বলতে পারেনা 'ভালোবাসি'। ধুর, এবার রাগ হচ্ছে শ্রাবন্তীর।
'মাহির আমি যাচ্ছি। বাসায় আম্মু চিন্তা করবে' কথাটা বলে উঠে চলে গেল শ্রাবন্তী। মাহির একটু ও ডাকলো না। পাশে একটা কাগজের প্যাকেট পড়ে ছিল। দ্রুত গোল করে নিল সে।
'শ্রাবন্তী শোন' বলে দৌড় দিলো। হাটু গেড়ে বসলো সে। মেহেদি মাখা হাতে কাগজের ওই রিংটা পরিয়ে দিল সে। মিষ্টি করে বলল,'আমাকে ভালোবাসবি?'ঘন চুল গুলো ঝাঁকড়া দিয়ে মেয়েটা বলল,'হুম'।
-সবসময় ভালোবাসবি?
-হুম।
-কখনো ছাড়বি না তো?
-না।
মেয়েটার ছোট্ট মুখটা লুকিয়ে ফেললো ছেলেটার বুকের ভেতর। জড়িয়ে ধরলো ছেলেটা। হৃদস্পন্দন অনুভব করছে মেয়েটা।।
ছেলেটা হাসতে হাসতে বলে,'শোন তুই রান্না জানিস না, শিখতে হবে তোকে'
-না পারবো না।
-তাহলে বিয়ের পর খাবো কি?
-ভালোবাসা।
-ওটা খাওয়া যায়?
-হুম যায়।
-না ওটা খাবো না।
-কেন?
-খেলে তো শেষ হয়ে যাবে।
-না শেষ হবে না।
-তবুও খাবো না। ওটা জমাবো।
-তাহলে রান্নাই শিখতে হবে?
-হ্যা হবে।
হেসে দেয় মেয়েটা। ছেলেটাও হেসে দেয়। মেয়েটাকে কাছে টানে।
-লিপস্টিক মুছে দিই?
-না, বিয়ের আগে কিচ্ছু না।
ভয়ার্ত গলায় শ্রাবন্তী বলে।
-হাতটা?
-কি হাতটা?
-হাতটা ধরি?
-হুম।
হাসি মুখে শ্রাবন্তী হাতটা বাড়িয়ে দিলো। শক্ত করে ধরে মাহির। শ্রাবন্তী ও মনের অজান্তে শক্ত করে ধরে রাখে তার হাত।

লেখক : Alaxender Abir

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে