বুয়া থেকে খালা!
পাঠকই লেখক ডেস্ক : সাদিয়া ভার্সিটি থেকে এসে বিরক্তি নিয়ে কলিংবেল বাজিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু বুয়া এসে দরজা খোলার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। একটু পরেই ভিতর থেকে শোনা গেল 'দাঁড়ান আম্মা আইতেসি' এতে তার বিরক্তির মাত্রা আরো বেড়ে গেল। সে আরো আগেই বুয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তাকে এসব আজেবাজে নামে না ডেকে ম্যাডাম ডাকতে। কিন্তু এই মহিলা বরাবরই একই কাজ করে যাচ্ছে! দরজা খোলার সাথে সাথেই;
- এই মহিলা কই থাক তুমি? দরজা খুলতে এতক্ষণ লাগে!
- জে আম্মা, ভাতের মার গালতেছিলাম।
- আমি যে কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি সে খেয়াল নাই তোমার?
- এইবারের মতন মাফ কইরা দেন আম্মা। আর হইব না।
- এই শোন তোমাকে না কতবার নিষেধ করছি আমাকে আম্মা ডাকতে! যতসব গাইয়া ভূত!
২.
বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় সাদিয়া। সাদিয়ার পরিচয় আলাদাভাবে দেয়ার মত কিছু নেই। ব্যবসায়ী ধনী বাবার একমাত্র দুলালি হলে ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে যা হওয়ার কথা এখানেও ঠিক তাই। পার্থক্য শুধু তাকে ৪ বছরের ছোট্ট মেয়েটি রেখে তার মা না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা দ্বিতীয় কাউকে আসতে দেন নি। সেই তখন থেকেই সাদিয়ার বুয়ার কাছেই বেড়ে উঠা। ভিটেমাটি, স্বামী-সন্তানহারা হালিমাও এতদিনে সাদিয়ার মাঝে নিজের সন্তানকে খুঁজে নিয়েছে। তবুও মেয়েটা কিভাবে যে এমন হয়ে গেল সে রহস্য হালিমার অজানা। সে সব হাসিমুখে মেনে নেয় আর ভাবে আজ যদি নিজের সন্তান এমন করত তবে কি সে পারত তাকে ফেলে দিতে! কক্ষনই না। রান্না শেষ করে সাদিয়ার রুমে গিয়ে দেখে মেয়েটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছু না বলে আস্তে করে জানালার পর্দাগুলো ঠিক করে লাইট অফ করে বেরিয়ে যায়।
৩.
- বুয়া... আই বুয়া এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো।
- আম্মা আমি ইপ্তারি বানাইতাছি। আপনে নিয়া খাইয়া ফালান।
- তোমাকে বলছি দিয়ে যাইতে।
- কেন আপনে কি এক গেলাস পানিও লইয়া খাইবার পারেন না!
- কি বললা তুমি? আই তুমি আমাকে কি বললা??
চিৎকার করতে করতে হাত থেকে ছোলার বাটি কেঁড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। কাড়াকাড়ির এক পর্যায়ে বুয়ার মাথার লম্বা সাদা ঘোমটা পড়ে যায়। সাদিয়া চমকে উঠে দুইপা সরে গিয়ে চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না এটা কিভাবে সম্ভব! সামনে যে তার মা দাঁড়িয়ে আছে!!
৪.
সাদিয়া লাফ মেরে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে। তার সাড়া শরীর থরথর করে কাঁপছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে রান্না ঘরের দিকে দৌড়ায়। তাকে এদিকে দেখে বুয়া জিজ্ঞাস করে 'কি আম্মা...কিসু লাগবো আপনের' উত্তরে কিছু না বলেই সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বুয়া আর কথা বাড়ায় না। কিছুক্ষণ পরেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বুয়াকে জড়িয়ে ধরে;
- আমাকে মাফ করে দাও খালা। আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলছি।
- আরে আরে কানতাছেন কেন? কি হইসে আম্মা?
- দেখ আমাকে একদম আপনে করে বলবা না। নিজের মেয়েকে কেউ আপনি করে বলে!
- (হাসতে হাসতে) আল্লারে কি পাগল মাইয়া।
সাদিয়া আজ নিজ হাতে তার খালার জন্য শরবত বানাচ্ছে। খালাকে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। মেয়ের এসব পাগলামি দেখে হালিমা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকায়। চোখের পানিও যেন আজ কিছুতেই বাঁধ মানছে না। হঠাৎ করেই প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির ভার বেশি হয়ে গেলে তার প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটা বোধ হয় এরকমই হয়। জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই তার। সুখ নামক সোনার হরিণটি যে নিজে থেকেই এসে ধরা দিয়েছে।
[কিছু কথাঃ সাধুতা বা ভালমানুশি প্রদর্শনের জায়গা থেকে নয় বরং নিজের অবস্থান থেকে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেই কথাটা বলছি, আপনার ডিকশেনারি থেকে বুয়া শব্দটি মুছে ফেলুন। এই গরীব মানুষটিকে আজ থেকে জাস্ট 'খালা' বলে ডেকে দেখুন উনি আপনার প্রতি কতটা আন্তরিক আর খুশি হন! অবশ্যই উনাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া আমাদের কর্তব্য বৈকি?]
লেখক- রিয়াজুল ইসলাম হৃদয়