রঙিন স্বপ্নে কালো ছায়া
পাঠকই লেখক : বাবা তপু, যাওয়ার সময় টাকাটা নিয়ে যেও।
কথাটা শুনার পর থেকেই মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। দীর্ঘ একটা মাস অপেক্ষা করে সে এই দিনটির জন্য।
আজ মাসের ২ তারিখ। বেতন পাওয়ার কথা না। কারণ এখান থেকে বেতন পেতে পেতে ৬-৭ তারিখ হয়ে যায়।
তপু টিউশন করে সংসার চালায়। ঘরে মা আর ছোট বোন। সে ঝটঝঞ এর পদার্থবিদ্যার ছাত্র। অসম্ভব টেলেন্ট একটা ছেলে। বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক আগেই। তখন তপুর বয়স ৭ বছর আর তার ছোট বোনের মাত্র ৫ মাস। মা অনেক কষ্টে তাদের লালন পালন করেছেন।
সমাজ ব্যবস্থার নানা রকম সমস্যাসহ বিভিন্ন মানুষের খারাপ দৃষ্টি থেকে নিজকে বাঁচিয়ে তাদের বড় করে তুলতে তপুর মাকে সইতে হয়েছে নানা রকম বঞ্চনা। তিনি সব মুখ বুঝে সহ্য করেছেন তপু আর তানির মুখের দিকে চেয়ে।
বেতনের কথা শুনে তার মাথায় প্রথমেই আসে, আজ যাওয়ার সময় একটা মুরগী নিয়ে যাবো। অনেক দিন মা আর তানি মুরগী মাংস খায় না।
তানির মুখটা ভাবতেই তার চোখে আনন্দ অশ্রু চলে আসে।
হঠাৎ তার মনে হয়, কিছুদিন আগে মা কিছু ঔষধের কথা বলছিলেন। আজ যাওয়ার সময় ঔষধগুলো নিতে হবে।
গত পরশু তানি রং পেন্সিলের জন্য বায়না ধরেছিলো। এক প্যাকেট রং পেন্সিলের দাম কত হবে?
মনে মনে ভাবতে লাগলো সে।
নিজের জন্য একটা শার্ট আর পেন্ট বানালে কেমন হয়। বন্ধুদের ফরমাল ড্রেস নিয়ে ভাইবা দিতে এখন তার কেমন জানি লাগে। যদিও বন্ধুরা কিছু বলে না আর বলবেও না কখনো।
টিউশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার ছাত্র তাকে ছোট একটা প্যাকেট এনে দেয়।
তপু প্যাকেটটা তার বুক পকেটে রাখে।
তপু একটু পর পর হাত দিয়ে প্যাকেট টার অস্তিত্ব অনুভব করছে আর ভাবছে, আজ মা ও তানি অনেক খুশি হবে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে গাড়িতে উঠতে হয়। বাসে গেলে ২ টাকা আর ঈঘএ তে ৫ টাকা ভাড়া।
আজ আর বাসের জন্য অপেক্ষা না করে সে ঈঘএ তে উঠে।
ঈঘএ ঠিক তার পারার মোড়ে গিয়ে থামে। সে ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার মুখের মুদির দোকানের দিকে যায়। পাশেই মুরগীর দোকান।
তাকে দেখেই মুদির দোকানি ডাক দেয়।
তপু ঐ দোকানে যায়।
কি তপু সাহেব, অনেক দিন হলো টাকাগুলা দিলেন না। আপনার বাবা এক জবানের মানুষ ছিলেন আর আপনি উনার সন্তান হয়ে গড়িমসি করেন?
তপুরা সারা মাসের খুঁটিনাটি বাজার এই দোকান থেকে করে। মাস শেষে টাকা পরিশোধ করে দেয় তপু। কিন্তু গত মাসে তার ভার্সিটির সেমিস্টার ফি দিতে হয়েছে তাই দোকানের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হয় নাই। তাই আজ তাকে এই কথা গুলো শুনতে হয়েছে।
তপু তার বুক পকেটে হাত রাখে। সে কিছুটা সময় নেয়। তার পর টাকাগুলো বের করে গুনে গুনে ১৪৮০ টাকা দোকানিকে দেয় আর বলে, চাচা, আমি একটু ঝামেলায় ছিলাম। দয়া করে রাগ করবেন না। আর এ রকম হবে না।
তপু দোকান থেকে বেড়িয়ে আসে। পাশের দোকানের মুরগীগুলো যেন তার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে হাসছে। সেই হাসিটা বিদ্রুপের অট্টহাসির মতন!
সে ক্ষাণিক চিন্তা করে, পকেটে আছে আর মাত্র ৫২০ টাকা। মার ঔষধ কিনতে হবেই।
ফার্মেসি থেকে মার জন্য ঔষধ কিনে বাসার দিকে রওনা দেয় তপু।
তপু হাটছে আর ভাবছে, মাত্র এক ঘণ্টা আগে কত স্বপ্ন দেখেছিলো সে। আর এখন! একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তপুর ভেতর থেকে।
তার পর নিজে নিজে ভাবে, আচ্ছা আজ হলো না তাতে কি, অন্য আরেকটা টিউশনের বেতন পেলেই রং পেন্সিল আর ভালো বাজার করে বাসায় নিয়ে যাবো।
এখানে তপু চরিত্রটা কাল্পনিক। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন এমনেই, বিশেষ করে তপুদেরমত সবার জীবনটা এমনই হয়।
কখনো রঙিন স্বপ্ন দেখা, আবার উঠে দাঁড়ানো, আবার পথ চলা, হোঁচট খাওয়া, আরেকবার পড়ে যাওয়া আবার উঠা।
তবে এটাও ঠিক ছেড়া জুতা, শূন্য পকেট আর রক্তাক্ত একটা হৃদয় থাকলে তুমি কিছু হও আর না হও তবে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে।
লেখক : অর্থহীন অমিত