রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৫৪:২৮

অসমাপ্ত ভালোবাসা (পূর্ব প্রকাশের পর)

অসমাপ্ত ভালোবাসা (পূর্ব প্রকাশের পর)

পাঠকই লেখক ডেস্ক : আজই প্রথম বুঝতে পারলাম তুমি নেই। অনেক অপেক্ষার পরও যখন তোমার কোন ফোন পেলাম না ঠিক তখনই দীর্ঘ এক বছর পর এই বিশ্বাসটা আমার মনে গেঁথে যায়। আজ আমার জন্মদিন আর তোমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বিগত ৬ বছর ঠিক এই সময় তোমার আগে আমাকে কেউ ফোন করতে পারে নি। এবারই প্রথম তার ব্যাতিক্রম হলো। ৬টা বছর কেমন করে যে পার হয়ে গেল একটুও বুঝতে পারলাম না। সময় তার আপন গতিতে যে কতটা দ্রুত চলে যায় একটু ও টের পাওয়া যায় না।

তোমার সাথে যেদিন আমার প্রথম পরিচয় হয় সে দিনটার কথা আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। সদ্য কৈশর পেরুনো আমি। চোখে মুখে নতুন স্বপ্নে বিভোর। তেমনই এক পড়šত দুপুরে মামার প্রয়োজনে তোমার বাসার দরজায় নক করার পরই প্রথম দেখলাম সদ্যস্নাত করা তোমাকে। এত বেশ অবাক হয়েছিলাম তোমাকে দেখে। তাই তো সব কিছু ভুলে তোতলাতে তোতলাতে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “আচ্ছা গোসল করলে মেয়েদের কে এত সুন্দর দেখায় কেন?”
তুমি নিরব হয়ে আমার দিকে ধ্যানমগ্ন মানুষের মত তাকিয়ে রইলে। তোমার নিরবতা দেখে আমি আবারও প্রশ্নটা করেছিলাম।
তুমি কোন উত্তর দিলে না।
আমাকে বাসায় আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে।
আমি আমার পরিচয় দিলাম, আসার কারন বললাম।
তুমি বাসায় বসতে বললে।
আমি বসলাম। অমি একা একা বকবক শুরু করলাম।
তুমি মনযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছিলে। তারপর ১ঘন্টা পর তোমার বাবা আসল। কাজ শেষ করে চলে গেলাম।

চিরদিনই হয়ত সেই স্মৃতি নিয়ে চলতে হত। অথবা আস্তে আস্তে হয়ত কোন এক সময় সেই স্মৃতিতে মরিচা পড়ত যদি না আবার ফার্মগেট আনন্দ হলের সামনে তোমার সাথে দেখা না হত। আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম যদিও, তবুও তোমাকে একটু সময় দিয়েছিলাম। সেই থেকে শুরু। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমাদের। আস্তে আস্তে বছর গড়িয়ে ৬ বছর অতিক্রম।

আজ স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ছে ৬ বছরে তোমার সাথে কাটানো কিছু স্মরনীয় মুহূর্ত যা হয়ত কখনও ভুলতে পারবো না।

প্রথম তোমার হাতধরার দিনটির কথা মনে পড়ছে খুব বেশি। প্রথম তোমার সাথে বাহিরে কোথায় দেখা হয়েছিল সে দিন। নারায়ণগঞ্জ বরফকল ঘাটে নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকায় বসে প্রথম তোমার হাত ধরলাম। তুমি শীতগ্রস্থ মানুষের মত থরথর করে কাঁপছিলে। সেই স্পর্শের অনুভূতিতে মনে হয় তুমি বেঁচে আছো।

প্রথম হুডখোলা রিকসায় বৃষ্টিভেজার দিনাটার কথা ও মনে পড়ছে। জুরাইনের সেই ঝুম বৃষ্টিতে বৃদ্ধ রিকসাওয়ালার রিকসায় বসে ভিজতে ভিজতে শ্রীকান্ত আচার্যের “আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ” গানটি শোনা। ভালো লাগায় তুমি কাঁদছিলে। চোখের পানি ও বৃষ্টির পানিতে মিশ্রিত তোমার সেই মুখ.......

জন্মদিনে তোমার পায়ে নূপুর পরিয়ে দেওয়া, আনজুম ফারিয়া, তুমি, আমি বৌদ্ধ পূর্ণিমার রাতে সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে বসে জ্যোস্নাস্নান, রাতে অর্নিদিষ্ট গন্তব্যে কার ড্রাইভ করা, হাইওয়ে পুলিশকে জরিমানা দেওয়া, আমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে আমাকে ড্রাইভিং শিখানো, কলেজ ফাঁকি দিয়ে সোনারগাঁ ঘুরতে যাওয়া, রাতভর ঘুমঘুম কন্ঠে মোবাইলে কথা বলা, রাতের ঢাকা শহরে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে পায়ে হাটা এমন আরও অনেক ছোট ছোট ঘটনা, নিজেকে উজাড় করে দিয়ে একে অন্যের কাছে প্রকাশ করা, শত শর্ত, মান অভিমান সবকিছু মিলিয়ে আমাদের পথচলা।

সবকিছু যখন ভালোভাবেই চলছিল ঠিক তখনই তোমার শর্তের বেড়াজাল। তোমার বাবা ও ভাইয়ের মত সামরিক বাহিনীর অফিসার হতে হবে। শুধুমাত্র তোমাকে পাওয়ার জন্যই শুরুকঠিন এ পথে যাত্রা শুরু করি। অনেক পরীক্ষা, কষ্টের পর যখন সামরিক ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হলাম, প্রশিক্ষণ-এ যাব ঠিক তখনই আবার শর্তের বেড়াজাল। আমার সাথে একদিন কথা না বললে তুমি থাকতে পারবে না। তাই আমাকে ছাড়তে হবে প্রশিক্ষণ। একসময় ছোট্ট একটি দুর্ঘটনার ফলে চলে আসতে হল সামরিক বাহিনী থেকে। তখনকার তোমার হাসিমুখের কথা কখনও ভুলতে পারবো না।

তোমার সাথে শেষ দেখার দিনটির কথা এখনও খুব মনে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো সেই দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন। সারাদিন আমি, তুমি, চৈতি, আনজুম ফারিয়া একসাথে আড্ডা দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে দুপুরে খাওয়া, লেকে অতিথি পাখি দেখা, গনিত বিভাগের পিছনে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা, নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগের সামনে বখাটেদের গাঁজা কিনতে টাকা দেওয়া, মুজিব হলের মাঠে বড় ভাইয়াদের উপদেশ শোনা, বা জিমনেশিয়ামের সামনে রাগ করে বসে থাকা। যদিও সবই এখন স্মৃতি।

তারপর একসময় তুমি চলে গেলে প্রয়োজনের তাগিদে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে। প্রযুক্তি এই যুগে কয়েক লক্ষ মাইল দূরত্বকে জয় করে আমরা একজন ছিলাম আরেকজনের খুব বেশি কাছে। ফেইসবুক, ইয়াহু, স্কাইপির মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও চ্যাট করে পাশাপাশি ছিলাম একজন আরেকজনের।

বন্ধুদের সাথে টিএসসিতে জন্মদিন উদযাপন করছি। হঠাৎ তোমার নম্বর থেকে কল। রিসিভ করলাম, তোমার রুমমেট স্নেহার কন্ঠ। তুমি সড়ক দুর্ঘটনার কবলে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তোমাকে। তুমি আর নেই। শুনে আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

দীর্ঘ অনেক সময় পর দেখি তোমার মুখ। শত আঘাতে শরীর জর্জরিত। কিন্তুু মুখে একটা আঁচড়ের দাগ ও নেই। নিষ্পাপ ঘুমন্ত অনাবিল হাসিতে ভরা তোমার মুখ। নিশ্চিন্তে ঘুমানো, যে ঘুম কখনও ভাঙ্গবে না আর। আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেই সদ্যস্নাত তুমি আর লাশ তুমি। আকাশ পাতাল তফাত।

দীর্ঘ একবছর পার হয়ে গেল। তোমার স্মৃতি নিয়ে একা একা পথচলা। কোনো অভিযোগ নেই তোমার প্রতি, নেই কোনো অনুযোগও। একটাই প্রার্থনা তোমার জন্য সবসময়। রাহমানুর রাহিম যেন তোমার আত্মাকে শান্তিতে রাখেন।

লেখক : Mustafiz Mamun
 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে