রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৫৬:৩২

অপেক্ষা'

অপেক্ষা'

পাঠকই লেখক : ইস্টিসনে বসে আছি। এই ট্রেনে যাব,ঐ ট্রেনে যাব করে করে অনেকগুলো ট্রেন চলে গেল। ভাবছি পরের ট্রেন আসতে আসতে ও এসে যাবে। ও হচ্ছে জেসি।

আজ ২৯ ফেব্রুয়ারী। জেসিকে নিয়ে আজ পালাব। অনেকদূর কোথাও পালিয়ে চলে যাব, যেখানে অন্য কেউ আমাদের ভালোবাসায় বাধা দিবে না। জেসির ইচ্ছে অনুযায়ী ২৯ ফেব্রুয়ারী পালানো স্থির করলাম। যাতে করে ৪বছর পরপর এই দিনটা আসে। আজ অবশ্যই খুব কষ্টের দিন। আসার কোন নাম নেই।

ইস্টিসনের এক কোণায় একজন বিচলিত লোককে দেখা যাচ্ছে। লোকটাকে দেখে ধার্মিক মনে হচ্ছে। মনে হওয়ার পিছনে রয়েছে তার গোটানো ফুল-প্যান্ট। তবে তা ভুল প্রমাণ করছে হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি। খুব শান্তভাবে টানছেন তিনি সিগারেটটি। আর ছিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার কৌশলটার মধ্যেও কেমন জানি একটা ফিল্মিয় ভাব। মাথায় কালো টুপিটা মানিয়েছে। তবে সান-গ্লাস পড়লে হয়ত আরও ভালো লাগত। হাতে একটা ব্রিফকেস । কেন যেন তিনি তা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। লোকটার ফোন বাজছে। কথা বলার সময় ওনাকে ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছে।

উনি ফোনটা রাখলেন। হাতের সিগারেটটা এবার জোরে টানতে শুরু করেছেন। ওনাকে খুব অপ্রুস্তত আর ব্যস্ত লাগছে। সিগারেটটা শেষ হয়েছে কিন্তু তিনি তা বুঝতে পারেননি। টেনেই যাচ্ছেন। ঢাকাগামী লালমনিরহাট-এক্সপ্রেস ইস্টিসনে এসেছে। এবার লোকটাকে অনেক বিচলিত মনে হচ্ছে। উনি ঘামছেন। ব্রিফকেসটা হাতে নিলেন। ওটা ধীরে-ধীরে খুলছেন। কি আছে ব্রিফকেসটাতে? উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে......... ঠিক এমন সময় একটা আওয়াজ আসল "কাট কাট, অনেক সুন্দর শট"।

হাহাহা। উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। শুটিং চলছে।
কিনা কি ভেবে বসেছিলাম।

একটা বড় রকমের মস্করা হয়ে গেল। হাসিটা একটু বেশিই জোরে হয়ে গেছে হয়ত, যেভাবে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটা হালকা-পাতলা কেলেঙ্কারি।
এতক্ষণ অভিনয় চলছিল!

জেসির আর আমার মধ্যেও এতদিন অভিনয়ই চলেছিল। সেইদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। জেসিকে প্রপোজ করার জন্য ডেকে ৮মিনিট দাঁড়িয়ে রেখে কিছুই না বলা। আজ সেই জেসির সাথেই পালাচ্ছি।

নাহ! এখনো আসার নাম নেই।আমি এমন এক মেয়ের জন্য ওয়েট করছি যার সময় সম্পর্কে জ্ঞান নাই। এই মেয়ের সাথে দেখা হয় প্রথম দিন কলেজে।

কলেজে প্রথম দেখাতেই যে তাকে ভালো লেগেছিল তা নয়। ভালো লাগার পিছনে বন্ধুরা নিষ্ক্রিয় নয় বরং সক্রিয় প্রভাব ফেলেছিল। প্রতিটা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে হয়ত বন্ধুদের অনুরোধেই জোর করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। তাদের যুক্তি একটাই,মেয়েটাকে নাকি আমাকে পটাতেই হবে।
যাই হোক......। ভালো লাগা যেখানে শুরু,অস্থিরতার জন্মও সেখান থেকেই হয়। কিছুদিন পর ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তার দিকে তাকিয়ে থাকার কথা আর কাউকে মনে করে দিতে হয়নি। তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে।কেমন যেন একটা মায়া ছিল দুই চোখের ছোট্ট অবয়বে। তখনও হয়ত তাকে ভালবাসা শুরু করিনি।
কিংবা করেছিলাম।
ভেবেছিলাম তাকে নিয়ে অনেক দূরের পথ পাড়ি দেবার কথা।

এরপরের কাহিনী আরও মজার। তবে আমার জন্য নয়। পাঠকদের জন্য। জনৈকাকে একদিন ক্লাসের বাইরে ডেকে পাঠালাম। প্রেমের প্রস্তাব দেব আরকি! মেয়েদের আবার প্রপোজ পেতে বড়ই ভালো লাগে।তাদের মতে,এতে তাদের নারীত্বের এক প্রকার প্রমোশন ঘটে। রিমলেসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। যথারীতি উনি প্রপোজ নেওয়ার জন্য হাজির।
মুখে একটা হাসি।
এত হাসি কোথায় পায়,শুধু তাই ভাবছিলাম।

আমি বলব বলব করেও বলে উঠে পারলাম না। আর সে যাবে যাবে করেও যেয়ে উঠতে পারল না। পুরো ৮ মিনিট এই সুন্দরীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।এই ৮মিনিট সে যথেষ্ট পরিমাণ হেসেছে।হাসার মূল কারণ অবশ্যই আমি। খাট, শুকনা, একটা ছেলের চালচলন বড়ই হাসিবহুল লেগেছে তার কাছে। হুম। আজও তার হাসি বুকে বেজে ওঠে।

শুধু ক্লাসে নয়।ক্লাসের বাইরেও তার জন্য কত যে অপেক্ষা করেছি! আজও তার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সেই দিনের অপেক্ষা আর আজকের অপেক্ষার মধ্যে কোন মিল নেই। আছে শুধু পর্বততুল্য পার্থক্য। আছে সময়ের স্রোতে ভেসে আসা দুটি হৃদয়।একসাথে অনেকটা সময় কাটানোর,নশ্বর পৃথিবীতে একে অপরকে ভালবেসে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি।আছে নীল আকাশের গাঢ়ত্বের মত আমাদের পবিত্রতা।

আমার হাতে একটা বড় ব্যাগ।লালমনিরহাট এক্সপ্রেস এখনি ছেড়ে দিল।ঘোর কেটে গেল।এখন বড্ড একা লাগছে।পাশে কেউ থাকলে ভালো হত।জুটিয়ে গল্প করতাম।বলতাম যে মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছি,তাকে ভীষণ ভালবাসি।আর ভালোবাসার মানুষটির জন্য অপেক্ষা কখনো বিরক্তিকর হয়না।আমাকে দেখে বিরক্ত মনে হলেও আমি বিরক্ত নই।

একটা ছেঁড়া কাপড় পড়ে আছি। তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছি,কোথায় যেন লেগে ছিঁড়ে গেছে একটু। আবার অপেক্ষা।

ক্লাসে জেসি যে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত না তা নয়। মাঝে মাঝে তাকাত। আর তাকানোর পর মুহূর্তেই হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাসি দিত। তাই ওকে সবসময় হাসি মুখেই দেখেছি আমি। এত কিছু আওরাতে ভালো লাগছে না। আস্তে আস্তে একদিন খুব কাছাকাছি এসে গেলাম দুজনে। বুঝতে শিখলাম একে অপরকে।ভালবাসতে শিখলাম। বিকাতে পারলাম ভালবাসা।

'ঐ,ঐ পাগলটারে ধর ধর।বাড়িত থাইকা ফির পালাইছে।এইবার শেকল দিয়া বাইন্দা রাখার লাগবো।বাড়িত থাইকা পালাইয়া খালি ইষ্টিসনেই আসে এই পাগলা।ধর শালারে।কখন কার মাথা ফাটায়?'

এত লোকের ভীর কেন? এরা কি আমাকে পাগল বলছে?হ্যাঁ আমাকেই তো বলছে। আমি পাগল নাকি? এই লোকগুলার মাথাই নষ্ট।

'আমি পাগল না।আমি পাগল না। আমাকে ছেড়ে দিন।আমি ট্রেনের জন্য ওয়েট করতেছি। জেসি আসলে পালাব।ছাড়ুন বলছি।'

'পাগলের শখ দেখ! তোর জেসির বিয়া হইছে দুই বছর আগে। পাগলা শালা।ধর ব্যাটারে"

লোকগুলো এত বাজে কথা কিভাবে বলতে পারে? অনেক কষ্টে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পায়ের কাছে একটা ইট ছিল সেইটা ছুড়ে মারলাম।

'কঠিন পাগলা।ইট দিয়া ঢেল মারে।ধর ব্যাটারে।শেকল লাগা.........।'

পাগলটাকে এখন পাগলাগারদে রাখা হয়েছে।তাকে আর ইস্টিসনে দেখা যায় না। দেখা যায়না ব্যাগ নিয়ে জেসির জন্য অপেক্ষা করতে। দেখা যায় না হঠাৎ উচ্চস্বরে হাসে উঠতে। সে এখন পাগলাগারদে। পাগলাগারদের চার দেয়ালে মাথা ঠোকায়। জেসির সাথে পালিয়ে যাওয়ার নানা ফন্দী আঁটে মনে মনে। আর তার জেসি এখন দুই সন্তানের জননী।

সেদিন কার কাছে যেন শুনলাম পাগলটার বাঁচার আর আশা নেই। একদম মৃত প্রায় অবস্তা। শুধু শ্বাস চলে।

এভাবেই নাম না জানা আরও অনেকের ভালোবাসার স্বপ্নের ইতি ঘটে।তারা তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে একটাবারের জন্যও কাছে পায়না।বলে উঠতে পারে না তাকে নিয়ে সাজানো নিজেদের মনের কথাগুলি।

 

লেখা : Sakib Radh

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে