সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:২৩:০৬

ক্ষতিটা কার হলো শুনি?

ক্ষতিটা কার হলো শুনি?

পাঠকই লেখক ডেস্ক: আপনি আপনার বাবাকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। দেখেশুনে বুঝলাম উনার হার্ট অ্যাটাক। দ্রুত টারশিয়ারি হাসপাতালে না পাঠালে তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু রেফার করার আগে যদি অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রিল আর স্ট্যাটিন এর লোডিং ডোজ খাইয়ে দিই তবে বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। তবু আমি সেটা করবোনা কারণ পথিমধ্যে রোগী মারা গেলে আপনি এসে আমার কলার চেপে বলবেন ওই ঔষধগুলা দিয়ে আমি আপনার বাবাকে মেরে ফেলেছি। ক্ষতিটা কার হলো শুনি?
 
আপনার স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে মধ্যরাতে। আমাকে এসে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন সাহায্য করার জন্যে। আমি গিয়ে দেখলাম চাইলেই নরম্যালি বাচ্চা ডেলিভারি করাতে পারব কিন্তু আমি করবোনা। মাঝরাতে বারো মাইল দূরের হাসপাতালে পাঠাবো কারণ যদি সামান্য কিছু এদিক ওদিক হয়ে যায় আপনি আপনার গোষ্ঠীসহ আমার টুটি চেপে ধরবেন। ক্ষতিটা কার হলো শুনি?
 
আপনার জ্বর হয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। ফার্মেসি থেকে মাতবরি করে এন্টিবায়োটিক কিনে খেয়েছেন কাজ হয়নি। আমার কাছে এসে বললেন 'ডাক্তার... সাতদিনের জ্বর, এন্টিবায়োটিক খেলাম কিছুই তো হল না।' আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘এন্টিবায়োটিক’ মানে কি? আপনি আমতা আমতা করে বললেন 'ওই যে জ্বর হলে খায় আরকি' আমি আপনাকে মনে মনে আবাল টাইটেল দিয়ে চিকিৎসা শুরু করলাম। আবালদের চিকিৎসার নিয়ম ভিন্ন। ঠিকমত পরীক্ষা করে হয়তো বিশটাকার ডক্সিসাইক্লিন ক্যাপসুল দিলেই আপনার রোগ ভাল হয়ে যেত কিন্তু আমি তা করব না। কারণ টেস্ট করতে দিলে তো বলবেন ‘সামান্য(!) জ্বরের জন্যে রক্ত পরীক্ষা করতে দিল। জ্বর কি রক্তে হয় নাকি? জ্বর তো হয় চামড়ায়। খালি কমিশন খাওয়ার ধান্দা’ তাই আমি আপনাকে চিকিৎসা শুরু করব ‘টেজোসিন’ দিয়ে। মশা মারতে হাইড্রোজেন বোমা দাগার মত। দ্রষ্টব্যঃ একেকটা টেজোসিন ইনজেকশনের দাম কয়েক হাজার টাকা, হয়তো ঠিক পথে চিকিৎসা দিলে বিশ টাকায় কর্ম সাধন হত। ক্ষতিটা কার হলো শুনি?
 
আপনি সরকারী হাসপাতালে যাবেন না, কারণ কি? ওখানে ডাক্তাররা ভাল করে দেখে না। লম্বা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আপনি আসবেন প্রাইভেট চেম্বারে। আর চায়ের দোকানে বসে বড় বড় বুলি ঝাড়বেন 'আহারে দ্যাশে চিকিৎসা বলতে কিচ্ছু নাই, আম্রিকায় কত ভাল চিকিৎসা দেয় ডাক্তাররা।' এখন কথা হল আম্রিকায় একজন জিপি আট ঘণ্টার অফিস আওয়ারে যেখানে রোগী দেখে পনেরো থেকে বিশজন সেখানে বাংলাদেশের একটা সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে রোগী দেখতে হয় একশ থেকে দেড়শজন। এরপরেও আপনি আশা করেন আপনাকে কোলে বসিয়ে আপনার ঘর-গৃহস্থালির খোঁজ খবর নিবে ডাক্তার। না নিলেই ডাক্তার লোক খারাপ। আবার প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখলে বলবেন 'হায় হায় দ্যাখ শালা কত ট্যাকা কামায়া ফেলল! কসাই একটা।' যান প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ; হাসপাতালে প্রতিটা রোগীকে পনেরো মিনিট করে দেখব। সে হিসাবে এক ঘণ্টায় চারজন। আট ঘণ্টায় বত্রিশজন। স্যরি ভুল বললাম... মাঝে এক ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক আছে। তাহলে থাকল সাত ঘণ্টায় আটাশজন। আপনি আবার কালকে কাউয়া ডাকা ভোরে এসে লাইনে দাঁড়াইয়েন। নান অফ মাই বিজনেস; আই অ্যাম জাস্ট ডুয়িং একজ্যাক্টলি হোয়াট ইউ ওয়ান্টেড। এখন ক্ষতিটা কার হলো শুনি?
 
আপনার হয়েছে টাইফয়েড, হাসপাতালের সরকারী সাপ্লাই আছে প্যারাসিটামল আর কৃমির বড়ি। আমি সেইটা দিয়েই আপনারে বিদায় করব। কারণ বাইরে থেকে সঠিক ঔষধটা কিনতে বললে তো বলবেন কোম্পানির কমিশন খেয়ে লিখেছি। যান এখন জ্বরে কো কো করে কাটান আরও কয়েকটা দিন। আমার কি?
 
আরও বলবো? সারাদিন বলতে পারব এরকম। দিনশেষে ভুক্তভোগী আপনি হবেন, আমি না। ডাক্তার ফেরেশতা না, মানুষ। ফেরেশতার চেয়ে আল্লাহ্‌র কাছে মানুষের মূল্য বেশি। নিজে মানুষ হন, ডাক্তারদেরকে মানুষ ভাবতে শিখুন। মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে সেটা মনে রাখুন। আপনার বাবাকে মেরে ফেলে আমার লাভ নেই, আপনার অনাগত সন্তানের ক্ষতি করে আমার লাভ নেই। তাঁদের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। বরং তাদের বাঁচাতে পারলেই আমার ভাল লাগে, আমি শান্তি পাই, আমার হাড়ভাঙা খাটুনি সার্থক হয়, জীবনটা অর্থবহ মনে হয়। আপনার আপনজনের মৃত্যুতে আমিও কাঁদি, সে কান্না আমার চোখে জলের স্রোত হয়ে নামে না, ঝর্না হয়ে রয়ে যায় অন্তরালে। সাদা আপন প্রাণের ভিতরটাতে এমন হাজারো কান্নার আনাগোনা নিয়ে তবু আমি আজরাইলের সাথে যুদ্ধে নামি আবার নতুন করে...! যদি একটিও প্রাণ বাঁচাতে পারি - এই আশায়।
 
লেখক- ডাঃ সাইফুল ইসলাম
বি:দ্র:  সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে