সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:৩২:০৭

মনের সম্পর্ক

মনের সম্পর্ক

পাঠকই লেখক ডেস্ক : প্রায় মাঝরাত।মাহিন তার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবছে রুমে কিভাবে ঢুকবে? একটু আগে বন্ধুরা সব চলে গেছে তাদের বউদের নিয়ে।আজ দুপুরে তার বিয়ে হয়েছে।অনেকটা নাটকিয়ীতার মধ্য দিয়ে।রুমের ভেতর বউ বসে আছে। এতোদিন একাই ছিল এই ছোট্ট কবুতরের খুপরিটাতে।ভেতর থেকে কাশির শব্দ আসছে।মাহিনের মনে হল একগ্লাস পানি নিয়ে যাওয়া দরকার। সে পানি নিয়ে সংকোচে ভেতরে ঢুকতেই মনে মনে ধাক্কা খেল।

নতুন বউ ঘর অন্ধকার করে কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছে।সে সুইচবোর্ডের দিকে হাত বাড়াতেই রিনরিনে কন্ঠে মেয়েটা আর্তনাদ করে বলল “প্লিজ লাইট জ্বালাবেন না! আমার শরীরে কাপড় নেই” মাহিনের মনে হল পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।মনে মনে বলল “আজকালকার মেয়েরা এতোটা ফাস্ট!” মেয়েটা যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল “আমার জ্বর খুব।জ্বরে আমি গায়ে তেমন কিছু রাখতে পারিনা,শরীর জ্বালা করে” তারপর একটু দম নিয়ে আবার বলল “তাই বিয়ের ভারী শাড়িটা খুলে ফেলেছি।আর আপনারা আমার ব্যাগ আপনার খালার বাসায় ফেলে এসেছেন” মাহিন লজ্জায় পরে গেল।তাড়াহুড়ার মাঝে কারোই একথা মাথায় ছিলনা।তাছাড়া সে তো জানতোই না আজ তার বিয়ে।সে একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল “আপনার কিছু লাগবে?” মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল “একটা থার্মোমিটার আর জ্বরের ওষুধ পেলে ভালো হত” মাহিন দ্রুততার সাথে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

মাঝরাতের শহরটা অনেক ফাঁকা।আশেপাশের সব দোকানপাট বন্ধ।মাহিনের জানা নাই কোথায় পাবে।তাও সে দ্রুত হাঁটতে লাগলো।মেয়েটা অদ্ভুত বটে।জ্বরের ঘোরেই কি এমন কাপড় খুলে ফেলেছে? এটা কেমন কাজ? খালার উপর রাগ হচ্ছে খুব।বিয়ে এখনি করাটা জরুরী কিছু ছিল না।হুটহাট এমন করে কিছু করার দরকার কি ছিল? বিয়েটা সে করতে চাইনি।পারত পক্ষে বিয়ে না করার পক্ষেই ছিল সে।কিন্তু এক খালায় আছে যার কথা সে ফেলতে পারেনা।কিন্তু চেনা নাই,জানা নাই হুট করে একটা মেয়েকে কি বিয়ে করা যায় নাকি? মাহিনের হঠাৎ খুব বিরক্ত লাগতে লাগলো।কেউ তার বিয়ের রাতে এমন ভবঘুরের মত রাস্তায় ঘুরে?মেয়েটা নিশ্চয় ভাউতাবাজি করছে।জ্বর টর কিচ্ছু না,হুদায় নাটক।সে চাইছে মাহিন তাকে স্পর্শ না করুক।মুখে বলতে পারছেনা।তাই এমন একটা ভণিতা করছে।মাহিন বিরক্ত মনে পাঞ্জাবীর পকেটে সিগারেট খুঁজতে লাগলো।না পেয়ে তিক্ত মনে ফুটপাতের উপর বসে পরল।

(২)
তিথির খুব মাথা ধরেছে।মনে হচ্ছে বমি হবে।কিন্তু এমন অবস্থায় সে বিছানা থেকে উঠবে কি করে? মানুষটা গেল অনেকক্ষণ হয়েছে।এখনো আসেনি।তিথির খুব মায়া হল মানুষটার জন্যে।তার বাসর রাতেই নববধূর জন্য হন্যে হয়ে ওষুধের দোকান খুঁজতে হচ্ছে।তিথির নিজের উপর খুব রাগ হল।আর বাবার উপরও।সে বিয়ে করতে চাইনি।বিয়েটা কি এতোই জরুরী?বিয়ে না করলে কি সে থাকতে পারতো না? বাংলায় অনার্স করেছে সে।চাইলেই যেকোনো স্কুলে চাকরী পেতে পারত।কিন্তু জীবনটা পাল্টে গেছে একটি অঘটনে।ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিথি।এই এক অঘটন তার জীবন বদলে দিয়েছে।তাই বাবার কথা ফেলতে পারেনি তিথি।কেন? তার সাথেই বা কেন এমন হল?জীবনের সব ভুলে ভালোই ত ছিল।জন্মের পর থেকেই লেগেছিল যা সব আবার তা বাড়িয়ে দিয়ে গেল।তিথির মনে হল কে যেন দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।আবছা আলোয় ছায়াটা কাছে আসছে ধীরে খুব ধীরে।তিথি একটি মিষ্টি ঘ্রাণ পেল,আলতো ঠোঁট মেলে ডাকল “মা!”।
-বল তিথি।
-মা! কেন করলে এমন তুমি? কেন?
-আমাকে ক্ষমা করে দে তিথি।
-তুমি চলে যাও,আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
-সত্যি চলে যাবো?
-হ্যাঁ! চলে যাও! তোমাকে দেখে আমার শরীর আরও বেশি জ্বালাতন করছে ।
তিথির মনে হল ছায়া গভীর হচ্ছে কাছে আসছে।তার মাথা ধরে গেছে।ঠিক সেই মুহূর্তে একটি উষ্ণ স্পর্শ তার হাতে পড়লো। সে চিৎকার করে বলল “মা তুমি যাও!” কথা শেষ হতেই সে গড়গড় করে বমি করে ফেলল।

(৩)
মাহিন ভাবেনি এমনটা হবে।মেয়েটি আসলেই অসুস্থ! বুকের উপর কাথাটা চেপে ধরে গড়গড় করে বমি করে যাচ্ছে।এর আগে কি যেন বলছিল।বমি হলে পিঠে হাত চেপে ঘষলে বমি বন্ধ হয়।মাহিন ভেবে পাচ্ছে না সে কাজটা কিভাবে করবে? কিন্তু মেয়েটির অবস্থা খুব খারাপ।মাহিন আবছা আলোয় মেয়েটির পিঠ থেকে এলো চুল আর কাঁথাটা সরিয়ে তপ্ত খোলা পিঠে হাত ঘষতে লাগলো।এক ধরনের অস্বস্তি মাহিনের ভেতরটা তছনছ করে দিচ্ছে।সাথে মিশ্রিত অপরাধবোধ।এক পর্যায়ে মেয়েটি তার হাতের উপর নেতিয়ে পড়ল।মাহিন কি করবে বুঝতে পারছে না।মেঝেতে থকথকে বমি।এদিকে মেয়েটার অবস্থা চূড়ান্ত খারাপ।এই রাতভোরে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল।কাউকে কল করে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।তাকে হাসপাতালেই নিতে হবে।কিন্তু এর আগে তাকে কিছুটা ধাতস্ত করতে হবে।

মাহিন আলতো করে মেয়েটির মুখ থেকে চুল সরিয়ে ডাকল “শুনছেন!” কিছুক্ষন চুপ থেকে সে আবার ডাকল “এই যে! শুনছেন?” এবার মেয়েটি একটু নড়ে উঠলো।তারপর ধীরে বলল “পানি”।মাহিন তাকে আধশোয়া করে বসিয়ে পানি আনল।বমির কারণে আবছা আলোয় হাঁটা মুশকিল।সে মেয়েটির হাতে পানিটা দিয়ে বলল “আমি কি লাইটটা অন করবো?”
-জি?
-বলছিলাম লাইটটা অন করবো কিনা! মেঝে পরিষ্কার করতে হবে আর আপনার মাথায় একটু পানি দিলে বোধয় ভাল হত।
-আমি নিজে করে নেব।প্লিজ আপনি কিছু করবেন না।
-দেখুন! আপনার অবস্থা তেমন ভাল না।আমি করছি।
-হুম।
-কিছু মনে করবেন না! আমার এখনো আপনার নাম জানা হয়নি।
-তিথি।
-আমি মাহিন।
মাহিন লাইট অন করে দেখল মেয়েটি কাঁথা আর চাদর দুটো একসাথে করে জড়িয়ে বিছানার একপাশে জুবুথুবু হয়ে শুয়ে আছে।মাহিন ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার করল।তারপর তিথিকে বলল “আমি পানি এনেছি।মাথায় দিলে ভাল লাগবে” তিথি নিস্তেজ গলায় কাঁথার ভেতর থেকে বলল “এখানেই?” মাহিন বলল “আপনার যা অবস্থা তাতে এখানেই তো হওয়া উচিৎ” তিথি তার মাথা বের করলো।মাহিন লাইটের আলোয় প্রথম তিথিকে দেখল,আর তার কাজল কালো চোখে তার দৃষ্টি আটকে গেল।

(৪)
দূর থেকে আযানের সুর ভেসে আসছে।তিথির কাছে সব যেন কেমন স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে।এমনটাও কি কখনো হতে পারে? সে বুঝতে পারছে না,সে আদৌ বেঁচে আছে কিনা।নাকি স্বপ্ন দেখছে।বমি করে অনেকটাই হালকা মনে হচ্ছে।অনেকটা স্থির।তার কাছে মানুষটাকে খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে।কিভাবে যেন তাকাচ্ছে বারবার! কিছু কি জিগ্যেস করবে? নিজের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। এভাবে তার সেবা করছে।এখনো কি ভালো মানুষেরা আছে পৃথিবীতে? তিথির ভাবনায় বাঁধা দিয়ে মাহিন বলল “কিছু মনে না করলে একটি কথা বলতে পারি?” তিথি মাথায় গামছা পেঁচিয়ে বলল “বলুন কি বলবেন”

-আপনি এমন অবস্থায় বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন?
-একই প্রশ্নটা আমিও করতে চাইছিলাম।তবে মিথ্যে বলব না,পারিবারিক কিছু কারণেই আমি রাজি হয়েছি।
-মানে? জোর করে বিয়ে দিয়েছে আপনার পরিবার? পছন্দ ছিল?
-নাহ! তেমন কিছু না,আমার মা ছয় বছর আগে আমাকে এবং বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে।এরপর বাবা আবার বিয়ে করেছেন।বুঝতেই তো পারছেন এমন অবস্থায় একটা মেয়ের কি হয়!
-ওহ! তাই জ্বরের ঘোরে এমন আবোল তাবোল বকছিলেন মাকে নিয়ে।
-তাই! বুঝতেই পারিনি। তবে মা যাবার পর বাবার পরিবর্তনটা আমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে।অপরাধ মায়ের ছিল,আমার না।তার পরও কম অপমান সইতে হয়নি।
তিথি বিছানার চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে আবার বলল “আমার কাপড়ের ব্যাগটা আনার কি ব্যবস্থা করা যায়? খুব অস্বস্তি লাগছে এভাবে থাকতে” মিহির তৎক্ষণাৎ তিথির পাশ থেকে সড়ে গেল।তারপর বলল “আমি একটু পর খালাকে কল দিয়ে বলছি,ততক্ষণ আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন।এরপর আমরা ডাক্তারের কাছে যাব” কথা শেষ করে মাহিন যেতে যেতে সেই অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে লাগলো তিথির দিকে।তিথি কিছুই বুঝতে পারছে না।কি দেখছে এমনভাবে?

(৫)
সকালটা সুন্দর।শীতের শেষ প্রায়,তবুও এখনো বাতাসে শীতের আমেজ পরিপূর্ণ।মাহিন সিগারেট বেড় করে হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তার সামনে তিথির চোখগুলো ভেসে উঠল। অদ্ভুত সুন্দর চোখগুলো।তাকালেই শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।কেন এমন হচ্ছে! তার তো মেয়েদের প্রতি তেমন আকর্ষণ নেই।ঠিক সে সময় তিথি এসে তার পাশে দাঁড়াল।এখন তাকে অনেকটা ফ্রেশ মনে হচ্ছে।মাহিন তার দিকে তাকিয়ে বলল “ভেতরে বসলেই পারতেন! বাইরে প্রচুর ঠাণ্ডা” তিথি শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে বলল “ভেতরে ভালো লাগছে না! তাছাড়া আপনার সাথে কথা ছিল” মাহিন অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল “আমার সাথে! কি কথা?” তিথি একটু গম্ভীর হয়ে বলল “আপনি তখনও বলেননি,কেন আপনি বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন” মাহিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “আমার বাবা মা মারা যাবার পর থেকে খালার কাছেই মানুষ হয়েছি।খালা কখনো আমাকে তাদের কমতি অনুভব হতে দেইনি।তবে খালু আমাকে তেমন পছন্দ করেননা” সে একটু থেমে আবার বলল “চাকরী পাবার পর আলাদা থাকা শুরু করেছি ঠিক,কিন্তু দিনে একবার আমাকে খালার কাছে দেখা দিয়ে আসতে হয়।খালায় আমার সব,তাই তার কথা ফেলতে পারি না আমি”
-বিয়ের আগে হয়তো ছবিও দেখেননি।দেখলে আমাকে বিয়ে করতেন না।আমি জানি।
-কেন? করতাম না কেন?
-হাসালেন! আমি দেখতে কালো।আর এই কারণে কম প্রস্তাব হারায়নি আমার বাবা।
-আমি আপনার কথায় একমন হতে পারছিনা।

তিথি কিছু বলল না। তার চোখ থেকে নীরবে অশ্রু ঝরছে।মাহিন তার দিকে তাকিয়ে সিগারেটের শেষ অংশটুকু ছুঁড়ে ফেলে দিল।তারপর তিথিকে বলল “আপনি এখন কি চাইছেন?” তিথি চোখের পানি মুছে বলল “জানিনা কিছুই” তারপর আবার বলল “বাবা বোঝা সামলাতে না পেরে আপনার ঘাড়ে চেপেছে,আপনি না পারলে ছেড়ে দিন।আপত্তি করব না আমি।আমার জীবনে সম্পর্কগুলো আমায় তুচ্ছ করে” তার কথা শেষ হতেই নার্স এসে মাহিনকে বলল “ এখানে রোগী কে?” মাহিন তিথির দিকে তাকিয়ে বলল “আমার স্ত্রী” মাহিনের কথায় তিথি হঠাৎ চমকে উঠলো।তার ভেতর এক ধরণের ভাললাগা ছড়িয়ে পরল।মাহিন আলতো হেসে তাকে বলল “আপনার চোখগুলো অনেক সুন্দর।তাকালে আর চোখ ফেরাতে মন চায়না!” চোখে পানি রেখেই তিথি মিষ্টি করে হাসল।মাহিন বলল “যা তুচ্ছ করে তাকে পেছনে নতুন সম্পর্ক তৈরিতে তো বাঁধা নেই! তবে মনের সম্পর্ক দিয়েই শুরু হোক নতুন পথচলা’’ কথা শেষ করে মাহিন তিথির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।তিথি অবাক দৃষ্টি মেলে সে হাত পরম ভরসায় নিজের হাতে তুলে নিল।


লেখিকা-তাহমিনা জিনিয়া এলি
বি:দ্র:  সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে