পাঠকই লেখক : শনিবার আমি তানিসাদের বাসায় গেলাম। তানিসাকে দেখে মনটা একদম ভাল হয়ে গেল। আমাকে দেখেই, ভাইয়া এসেছে, ভাইয়া এসেছে বলে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল মেয়েটা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও আন্টিকে একটু চিন্তিত মনে হল। যাই হোক, আমি কিছু না বলে তানিসাকে নিয়ে তার পড়ার রুমে চলে গেলাম পড়ানোর জন্য।
এভাবে আরো কয়েকদিন চলে গেল।
একদিন, তানিসা খুব দুষ্টুমি করছিল। কিছুতেই থামাতে পারছিলাম না। পড়াতেও মন ছিল না ওর। দুষ্টুমির এক পর্যায়ে দেখলাম, তানিসা হাসতে হাসতে হঠাৎ করে তার চেয়ার থেকে পড়ে গেল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি হন্তদন্ত হয়ে তাকে কোলে নিলাম। তারপর, আন্টিকে ডেকে তাকে বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দিলাম। আন্টির চেহারা দেখে বুঝতেই পারছিলাম, কোন সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে আন্টি খুব চিন্তিত কয়েকদিন থেকেই।
আমি আন্টি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তানিসার কী হয়েছে আন্টি?? আর আপনাকে কয়েকদিন থাকেই খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে! সিরিয়াস কিছু??
আমি দেখলাম, আমার কথা শুনে আন্টি আরো বিমর্ষ হয়ে গেল। ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখলাম, আন্টি কাঁদছেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাই, আবার বললাম,
-আন্টি! কী হয়েছে আমাকে বলবেন প্লিজ ?
এবার আন্টি আমাকে অনেকগুলো কথা বললেন। আমি সত্যিই সেগুলো শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। কথাগুলো বলেই আন্টি হু হু করে কেঁদে দিলেন। আমিও আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। চোখ ফেটে কান্না এল আমার্। বুকটা নিমিষেই কষ্টে ভরে গেল। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমার বুকে বিশাল একটা পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। আর আমি নিশ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছি। কিন্তু পারছিনা। এতটাই কষ্ট হচ্ছিল আমার।
আন্টির কথার মর্মার্থ খুব ছোট করে বললে এরূপ দাড়াবে,"তানিসার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। কিছুদিন আগেই টেষ্টে এটা ধরা পরেছে। কিন্তু তানিসা এটা জানেনা। ডাক্তার বলেছে সময় অনেক বেশি হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের আর করার কিছুই নেই। যেকোনদিন তানিসা এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে পারে। তার জন্য আর কোন চিকিৎসাই অবশিষ্ট নেই।"
আমি কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এরমধ্যে আন্টি আরো কিছু কথা বললেন যেগুলো শুনে তানিসার প্রতি আমার ভালবাসা আরো অনেকগুনে বেড়ে গেল। আন্টি আর আঙ্কেল তানিসার স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারন ডাক্তার বলেছেন,এ মুহুর্তে তানিসার মাথায় যেন অতিরিক্ত কোন চাপ না পড়ে। আর এই কারনে উনারা আমাকেও টিউশনিটা বাদ দেওয়ার কথা বলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তানিসা এতে কিছুতেই রাজি হয়নি। সে নাকি খুব কান্না কাটি করে বলেছিল,স্কুল-প্রাইভেট বাদ দিলে দিক, কিন্তু আমাকে যেন বাদ দেওয়া না হয়। সে নাকি সেদিন কান্না করে বলেছে,"ভাইয়াকে ছাড়া আমার কিছু ভাল লাগে না। পড়ার জন্য না হলেও ভাইয়া যেন প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসে।"
আমি এরপর থেকে প্রতিদিনই তানিসাদের বাসায় যেতাম। সবসময় হাসিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম মেয়েটাকে। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের ব্যাবধানেই তানিসার চেহারা অনেক বদলে গেল। অনেক শুকিয়ে গেল সে। আগের মত আর হাসিখুশি ভরা মুখখানা নিয়ে আমার সাথে দুস্টুমিও করতো না। যখন তখন অসুস্থ হয়ে পড়তো। ব্যাপারগুলো খুব কাছ থেকে দেখতাম আমি, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। প্রতিদিন মেসে এসে নিজের রুমে বসে একা একা কাঁদতাম আমি।
কয়েকদিন যেতে না যেতেই তানিসা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ল। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতো না সে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,এই অসুস্থতার মধ্যেও সে সবসময় আমাকে খুঁজতো। একদিন আন্টি আমার হাত ধরে কান্নাকাটি করে খুব কাকুতি করে আমাকে উনাদের বাসায় থেকে যেতে বললেন। সেদিন তানিসার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।
ডাক্তার এসে দেখলেন কিন্তু কিছুই বললেন না। কিছু ওষুধের নাম সহ একটা প্রেস্ক্রিপশন আংকেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। সেদিন সারাটা সময় আমি তানিসার সাথেই কাটিয়েছিলাম। অনেক মজার মজার গল্প বলে ওকে একটু হাসানোর খুব চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মেয়েটা হাসার চেষ্টা করেও হাসতে পারছিল না। বুঝতে পারছিলাম খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। কিন্তু আমিও নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। মেয়েটার হাসিমাখা মুখখানা যে অনেকদিন দেখিনি।
সন্ধ্যার দিকে তানিসা ঘুমিয়ে পড়ল। আমরাও রাতে কিছুক্ষন গল্প করে যার যার রুমে চলে গেলাম। আমাকে গেস্ট রুমে থাকার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না আমার। হঠাৎ পাশের রুম থেকে আন্টির চিতকার শুনতে পেলাম। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। ছুটে গেলাম তানিসার সেই রুমে।
গিয়ে দেখলাম,আন্টি তানিসাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। আঙ্কেল নিশ্বব্দে দাড়িয়ে আছেন আন্টির পাশে। আঙ্কেলের হাত তানিসার ছোট্ট হাতটি ধরে রেখেছেন শক্ত করে। যেন কিছুতেই না ছুটে যায়। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। আন্টি চুপটি করে আছেন, সেরূপ আঙ্কেলও। শুধু দুজনের চোখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে পানি পড়ছে।
আমি আসতে আসতে কাছে এগিয়ে গেলাম। পরম মমতায় "আপু" বলে ডাক দিলাম। দেখলাম,তানিসা একটু নড়েচড়ে উঠল। তারপর,আন্টির কোল থেকে মুখটা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে "ভাইয়া" বলে ডাক দিল। তারপর,তার ছোট্ট হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল প্রশস্ত করে। আমিও আমার হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে তানিসা বলল,"ভাইয়া আমি কি মরে যাবো?? আম্মু আব্বু আমাকে কিছুই বলতে চাচ্ছে না। তুমি বলনা, ভাইয়া ! তোমরা সবাই কাদছো কেন?"
আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না যে এই মুহুর্তে আমি কী বলবো। চুপ করে শুধু অশ্রু বিষর্জন করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। হঠাত খেয়াল করলাম,তানিসার যেই হাতটা আমার আঙ্গুলটা ধরে ছিল সেটা আঙ্গুলটা ছেড়ে দিল। তারপর আস্তে করে সমস্ত শরীরটা আন্টির কোলে এলিয়ে দিল। আন্টি সশব্দে চিৎকার করে উঠলেন সাথে আঙ্কেলও। আমি তানিসার মুখপানে শুধু চেয়েছিলাম।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমারও চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে!
লেখক: jeffy mahin
বি:দ্র: সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি