পাঠকই লেখক ডেস্ক: কয়েকদিন আগের কথা। হলের ডাইনিং বন্ধ। রাতে মিতালীতে খাচ্ছি। কম টাকায় ভালো খাবারের জন্যে ম্যাক্সিমাম স্টুডেন্ট এখানেই আসে। খেতে খেতে খেয়াল করলাম একজন বয়স্ক মতো লোক ম্যানেজারের সঙ্গে কিছু বলছে নিচু স্বরে। হাতে ভিক্ষার ব্যাগ। মাথায় টুপি। নামাজ পড়েন নিয়মিত, কপালে সেজদার দাগ
দেখে বুঝলাম। কথা শেষ করে ম্যানেজার উচু গলায় ডাকলেন এক ওয়েটারকে।
'মজিদ! চাচা মিয়ারে সবজি দিয়া ডাল ভাত খাওয়ায় দাও!'
চাচা মিয়া লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন! বোধ হয় চেয়ে খাচ্ছেন, এতে তার লজ্জা লাগছে। হয়তো আজ হাত পেতে কিছুই যোগাড় হয়নি! নতুবা এতো কম হয়েছে যে চাচীসহ রাতের খাবারটা হবে না!
ম্যানেজার অস্বাভাবিক নরম কন্ঠে বললেন, চাচা আপনি ভেতরের টেবিলটায় গিয়ে বসেন। আমি বেশ অবাক হলাম। ফ্রি খেতে চাওয়া কাস্টমারদের প্রতি বিরক্তি আসাটাই স্বাভাবিক!
আমি খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে গেলাম। ফিরে আসার সময় দেখলাম চাচা মিয়া বেশ আয়েশ করে খাচ্ছেন। পাতলা ডাল, পুইশাক, আলুভর্তা আর ভাত! মনটা একটু খারাপ ছিলো। ওনার খাওয়ার স্টাইল
দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। কি জানি মনে হলো ওনার সামনেরচেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম।
- ভালো আছেন, কাকু?
- উনি তাকালেন, হাসলেন, মাথা নাড়লেন, কিন্তু কথা বললেন না! খাবার সময় কথা বলা নিষেধ, তাই হয়তো।
- কাকু, কালোভূনা (গরুর মাংসের ভূনা) খাইবেন?
- এক মুহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন আমি কি বলছি! তারপর আবার হাসলেন। এবার হাসিটা দ্বিগুণ। বললেন আইচ্ছা বাজান।
আমি ওয়েটার মামাকে অর্ডার দিয়ে বিল দিতে উঠে এলাম। আমার বিল এলো ছত্রিশ টাকা আর কালোভূনার বিল ষাট টাকা। একশো টাকার নোট দিলাম। ম্যানেজার আমাকে অবাক করে দিয়ে চল্লিশ টাকা ফেরত দিলেন!
আমি বললাম, আমি তো চার টাকা ফেরত পাই! উনি বললেন, আপ্নে আমার দোকানের অতিথিরে খাওয়ালেন, তাই আপ্নে আইজ আমার অতিথি। শুধু কালোভূনার বিলটা রাখলাম স্যার! উনি হাত মেলানোর জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
আমি বেশ আগ্রহ করে হাত মেলালাম। হাতটা বড়ই উষ্ণ ছিলো। ভালো মানুষের হাত যে! চানখার পুল মোড়ে রিকশার জন্যে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর দেখি চাচা মিয়া মিতালী থেকে বেরুলেন। হাতের পলিব্যাগে মোড়ানো একটু খানি কালোভূনা!
আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমাকে চিনতে পেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। হাতের পোটলার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে লজ্জা পেয়ে গেলেন। বললেন, বাজান পুরাটুক খাইতে পারিনাই! খিদা শেষ হয়া গেছিলো। তাই আপনের কাকির জন্যি নিয়া যাই। খাবার অপচয় ঠিক না! বইতে পড়েছি! বলে আর দাড়ালেন না! সালাম দিয়ে চলে গেলেন!
রিকশায় উঠে বসেই মনে হলো ভালোবাসা আর ভালো মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় যে মানুষের খিদে কমে যায়, তা আজ জানলাম! সেই ভালোবাসা কারো কাছে যাতে প্রকাশ পেয়ে না যায়,
তার জন্যে কতো বাহানাই না আমাকে দিয়ে গেলেন!
বাসায় গিয়ে নিশ্চয়ই রাশভারি কন্ঠে বলবেন,’বউ, খায়া লও। ভালো খাবার আনছি।’ ওনার স্ত্রী বলবেন- আপনি খাবেন না? উনি বলবেন- নাহ! আমি খেয়ে এসেছি পেট ভরে। তুমি খাও। আর শোন প্লেটটা ঠিকমতো ধুয়ে রাখবা। রাতে খাইতে উঠলে যেন ময়লা না দেখি।
ওনার স্ত্রী খুশি খুশি কন্ঠে বলবেন- জ্বি আচ্ছা!
উনি রাগী কন্ঠে বলবেন- হাসি কম, আগে খেয়ে আসো! বলেই অন্য দিকে তাকাবেন। স্ত্রীর প্রতি আদর
লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। ওনার স্ত্রী নিঃশব্দে হাসবেন, উনি যে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন সেটা বুঝতে দেবেন না!
এরকম কতো কতো ভালোবাসার গল্প যে ঘটছে আশেপাশে, লিখলে হয়তো উপাখ্যান হয়ে যাবে। সবচেয়ে মধুর ভালোবাসার গল্পটা বোধহয় কখনো লেখাই হবে না। কি দরকার লেখার! কিছু কথা লুকোনো থাকাই ভালো।
লেখক: ফয়সাল হায়দার
বি:দ্র: সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি