সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫৫:৩৪

কাঁদছেন কেন জানতে পারি?

কাঁদছেন কেন জানতে পারি?

পাঠকই লেখক ডেস্ক: তড়িঘড়ি করে বাস স্ট্যান্ডে প্রবেশ করে ফাহাদ। অলরেডি ৫ মিনিট লেট। বাসটা বুঝি ছেড়েই দিল। নাহ! লেট হয়নি। বরং বাসই লেট। এখনও বাসস্ট্যান্ডে বাস এসে পৌঁছায়নি। মানুষের ভীড় ঠেলে বাস স্ট্যান্ডের এককোণার চেয়ারে বসে সে। চোখ যায় পাশে বসে থাকা রমনীর দিকে। কথাবার্তা এমনেতেই একটু বেশিই বলে সে। তবুও অপরিচিত একজন মেয়ে; আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে নাকি বুঝতে পারছে না।

আড়চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে। চশমা পরা। চোখ জোড়া দেখে মনে হচ্ছে একটু আগে বৃষ্টি বয়ে গেছে তার দুচোখ জুড়ে। এখনও তার আভা রয়ে গেছে। হাতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পেল ইয়া বড় একটা ব্যাগ।

চট করে একটা আইডিয়া নিয়ে নিল মেয়েটা সম্পর্কে। ফাহাদ আবার মানুষের বাহ্যিক অবস্থা দেখে ভালো ধারণা নিতে পারে। এই মেয়ে নিশ্চয়ই বাসা থেকে পালিয়েছে। প্রেমিকের জন্য। শেষ মুহূর্তে হয়তো বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে তাই দু চোখ বেয়ে অশ্রুধারা। নয়তো প্রেমিক ধোকা দিয়েছে । তাই এখন ব্যর্থ মনে বাসায় ফেরত। যে কোনো একটা হবেই। - ফাহাদ মনে মনে ভাবে।

'জিজ্ঞেস করবো নাকি মেয়েটাকে? নাহ! থাক, কি দরকার'- মনের ভিতর একটা দোটানা ভাব। ফাহাদের আবার সব কিছুতেই আগ্রহ একটু বেশি। একটু বেশি চটপটে আর কথা বলা টাইপ ছেলে। তবে শেষ পর্যন্ত কথা বলা থেকে বিরত থাকে সে।

তবে ফাহাদ যে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে তা ঠিকই আঁচ করতে পারে মেয়েটা। চোখদুটা ঘুড়িয়ে ফাহাদের দিকে পড়তেই বিব্রত হয়ে পড়ে ফাহাদ। মাথাটা আস্তে ঘুড়িয়ে নেয় সে।

ফাহাদ প্রাইভেট একটি ফার্মে চাকরি করছে ১ বছর হবে। চট্রগ্রাম যাচ্ছে ছুটি নিয়ে। অনেকদিন মাকে দেখতে যাওয়া হয় না। মা আবার অনেক করে ধরেছে বিয়ে এবার তাকে করতেই হবে।

বাস কখন আসে কোনো ঠিক নেই। সময়টা পার করা দরকার। এই মুহূর্তে ওই মেয়েটার সাথে কথা বলাই সময় কাটানোর একমাত্র ভালো উপায় মনে হচ্ছে। আসলে মেয়েটার প্রতি একটা কৌতুহল কাজ করছে ফাহাদের। বাসা থেকে পালানোর কাহিনী শুনতে মন চাচ্ছে। কিন্তু কথা কিভাবে শুরু করা যায় তা বুঝতে পারছে না। নাম কিংবা কোথায় যাবেন এটা বলে শুরু করা যেতে পারে।

মেয়েটার দিকে মাথা ঘুরাতেই সে হাওয়া। কই গেল? আশেপাশের মানুষজনও কম মনে হচ্ছে। একটু পরে ফাহাদের চোখ পরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দিকে। বাস অবশেষে আসলো।

সবাই যে যার টিকেট অনুযায়ী বাসের সিটে বসছে। সকাল যেন তার কাঙ্ক্ষিত সিটটাই পেল। তার পাশের সিটটি সেই মেয়ের। ভ্রমনটা মন্দ হবে না- ফাহাদ ভাবে।

- আমি ফাহাদ। আপনার নামটা?

মেয়েটা একটু বিরক্ত হল বুঝাই যাচ্ছে। তবুও সারাটা পথ উনার সাথেই যেতে হবে কথা না বলাটা খারাপ দেখায়।

- আলো।

- ও! মিষ্টি নাম। তা কোথায় যাচ্ছেন?

- চট্রগ্রাম।

- আমিও চট্রগ্রামে। মায়ের বাড়িতে। আপনি?

- আমি চট্রগ্রাম ভার্সিটিতে ৪র্থ বর্ষে পড়ি।

- ও

(ফাহাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণাটা বোধহয় ভুল। মেয়ে বাসা থেকে পালায়ে আসে নাই। কিন্তু তার চোখের পানির রহস্যটা জানার আগ্রহ মোটেও কমলো না। আর কন্ঠও কাঁদো কাঁদো)

বাস ছেড়ে দিয়েছে। আপাতত ফাহাদ আলো দুজনই চুপচাপ। ফাহাদ ভালো করে আলোর দিকে তাকালো। মেয়েটা আবার কাঁদছে। কোন এক বইতে সে পড়েছে মেয়েরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়। অনেক চেষ্টা করেও নাকি কান্না তারা লুকিয়ে রাখতে পারে না।

- আপনার কি শরীর খারাপ? কাঁদছেন কেন জানতে পারি?

- আমার ইচ্ছা তাই। আপনার কোনো সমস্যা?

মেয়েটার এমন কথায় একটু হতবাক হয়ে পড়লো ফাহাদ। কিন্তু বুঝতে বাকি রইলো না এটা অধিক শোকের বহিঃপ্রকাশ। যে করেই হোক কারণটা জানতে হবে। আর এতোটা পথ বাসে চুপ করে বসে থাকবে অমন ধৈর্য্য ফাহাদের নেই।

- চুইংগাম খাবেন? আমার পকেটে ২টা আছে। ভাংতি দিতে পারছিলো না ,তাই দুইটা কিনতে হয়েছিল।
আলো একটু কটমটভাবে তাকালো। কিছু বলা লাগলো না। চোখের ভাষাতেই ফাহাদ বুঝে নিল জবাব।

- দেখেন.. কি সুন্দর সাদা বক। আর ওই যে ওটা মাছরাঙা। সুন্দর না?

আলো একটুও তাকালো না। পারলে এখনই সিট চেন্জ করে সে। এমন বিরক্তকর লোক পাশে থাকলে ভ্রমণটাই নষ্ট। তবে আজকের ভ্রমণ কোনো ভ্রমণ না। সে জানে সারা রাস্তা জুড়ে তার কান্নাই আসবে। হোস্টেলে কখন যাবে এটাই আশা। আর কখনওই বাসায় যাবে না বলে ঠিক করেছে সে।

ফাহাদ কোনোভাবেই মেয়েটাকে কথা বলাতে পারছে না। এদিকে তার জানার আগ্রহটাও বেড়েই চলেছে। মহা বিপদে পরে গেল।

- গান শুনবেন? ........ হেডফোনটা এগিয়ে দেয় ফাহাদ।

- প্লিজ বিরক্ত কইরেন না তো। সমস্যা কি আপনার? আপনি কি পাগল? কখন থেকে কথা বলেই যাচ্ছেন। আপনার যা ইচ্ছা করুন, আমার সাথে দয়া করে কথা বলবেন না।

আলো মেয়েটা আবার কাঁদা শুরু করেছে। এবার একটু ভয়ই পেয়ে গেল ফাহাদ। বাসের মানুষ কি না কি ভেবে বসে?

মাথাটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে নেয় সে। কোনো ক্রমেই যেন আলোর দিকে চোখ না পরে। একা মনে চুইংগাম চিবাচ্ছে আর গান শুনছে।

বাসের চাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে আর কিছু না । অধিকাংশ যাত্রীই ঘুমে। হেডফোন ভেদ করে মাঝে মাঝে আলোর কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবুও আলোর দিকে আর মুখ ফেরাবে না বলে ঠিক করেছে সে।

লোকটা একদমই চুপ হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি আলো। এমন মানুষগুলো খুবই বিরক্তকর হয়। তার ধারণা ছিল একটু পর আবারও বকবক শুরু করবে। কিন্তু ফাহাদ ছেলেটা ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে।
হঠাৎ হাতের স্পর্শে ঘুরে তাকায় ফাহাদ। আলোর হাতের ছোঁয়া।

- চুইংগাম আছে? আমার বমি পাচ্ছে। থাকলে দেন।

ফাহাদ এগিয়ে দেয়। কিন্তু কোনো কথা বলে না।

- আসলে আমি সরি, অমন ব্যবহারের জন্য।

- ইটস ওকে।

আর কোনো কথা নাই। আলো বুঝতে পারে ফাহাদ নামের ছেলেটা অনেক কিছুই মনে করেছে। ব্যবহারটা হয়তো একটু বেশিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

- কি গান শুনেন? আমাকে দেয়া যাবে?

হেডফোনটা এগিয়ে দেয় ফাহাদ। মেয়েটার হঠাৎ এমন কথাবার্তায় অবাক না হয়ে পারছে না। সেটাও বুঝতে বাকি নেই যে মেয়েটাও তার মতো কথা না বলে থাকতে পারে না। কোনো এক কারণে মেয়েটার মন অনেক বেশি খারাপ।

- আমার মনটা অনেক বেশি খারাপ। আপনার সাথে অমন ব্যবহারের জন্য দুঃখিত।

- কি জন্য খারাপ জানতে পারি?

দুজনই চুপ। আলো কিছু একটা চিন্তা করছে।

- আপনাকে বলা যায়। আপনি আমার পরিচিত কেউ নন। আসলে মানুষ তার কথা কাউকে না বলা পর্যন্ত অস্বস্তিতে ভোগে। আমার মনে হচ্ছে আপনাকে বললে হয়তো হাল্কা লাগবে।

- জ্বী, আপনি যদি চান আমাকে বলতে পারেন। আবার কারও কোনো কথা নেই। হঠাৎ আলোর কন্ঠ....

- আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?

পাগল নাকি মেয়েটা। কথা নেই বার্তা নেই কি বলছে এসব? ফাহাদ মনে করে তার ধারণাটাই বোধহয় ঠিক। হয়তো মেয়েটিকে কোনো ছেলে ছ্যাকা দিয়েছে।

- আমি আর আমার বাবার বাড়িতে ফিরে যাবো না। এই জগতে আমার আপন বলতে কেউ নেই আর। আমার থাকার জায়গাও নেই। হোস্টেলের চার্জ দেয়াও এখন আমার জন্য অনেক কষ্টের। (হু হু করে কেঁদে উঠে মেয়েটা)

- কি হয়েছে জানতে পারি? আমাকে খুলে বলতে পারেন চাইলে।

- আমার বাবা আর মায়ের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। আমি তাদের একমাত্র সন্তান। আমার মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু বাবা আমাকে দেখতে পারেন নাই কখনোই। তাদের মধ্যে ঝগড়ার কারণে মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই বাসার বাইরে থেকে পড়িয়েছেন।

আর মাও কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলেন নাই সমাজের ভয়ে। এক মাস আগে আমার মা আমাকে একা করে চলে গেছেন ওপাড়ে। কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিতে ভুলে গেছেন। আর বাবাও এই বয়সে এসে বিবাহ করেন আরেক মহিলাকে। আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন আমার পড়ার খরচ তিনি বহন করতে পারবেন না, তার অতো টাকা নেই।

অথচ ওই মহিলাকে নতুন একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। আমার মায়ের শেষ স্মৃতি গয়না গুলোও পড়িয়েছেন ওই মহিলাকে। আমি কি জন্য ওই বাসায় আর যাবো? ওই বাসার সাথে সম্পর্ক চিরদিনের জন্য ছিন্ন। আমি আমার হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছি কিন্তু জানি না খরচ কিভাবে দিবো! যে মানুষটি সারা জীবন আমাকে এবং মাকে কষ্ট দিয়েছে আমি আর কখনোই তার কাছে যাবো না। আমি তার কেউ নই। আমাকে শুধু আগাছাই মনে করে। তার জীবনে আমার কোনো প্রয়োজনই নেই।

আলো মেয়েটার দুচোখ বেয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ফাহাদের চোখও কখন ভিজে গিয়েছে টের পায়নি সে। মনের অজান্তে কখন আলোর ওই দুই নয়নে ফাহাদের হাত চলে গিয়েছে জানা নেই। মেয়েটার অশ্রু মুছে দিতে একটুও সংকোচ বোধ কাজ করলো না ফাহাদের। কিছু মানুষ হয়তো কষ্টের জন্যই পৃথিবীতে আসে।

ফাহাদের সাথে আলোর বিয়ে হয়েছে আজ ২ বছর হবে। আলো তার মায়ের অভাব কখনোই বোধ করেনি এই ২ বছরে। আপন মেয়ের মতোই ভালোবাসেন ফাহাদের মা। আর বাবা তো মেয়ে মেয়ে করতেই অস্থির। হয়তোবা এটাই ভালোবাসা। যে ভালোবাসার জন্য এতোটা পথ কষ্ট করে আসতে হয়েছে আলোর। মানুষের জীবনে খুব বেশি কিছুর দরকার নেই। কিন্তু যেটা খুব বেশি দরকার তারই নাম ভালোবাসা।

লেখক: কাজী ওয়ালীউল হাসান  
বি:দ্র:  সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/বিএসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে