পাঠকই লেখক ডেস্ক: 'নাহিদ' - সুদর্শন আর একেবারেই পাগলাটে একটা ছেলে। সারাদিন কাধে একটা গিটার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভার্সিটির সবাই ওকে গিটার-বয় বলেই ডাকে। নেকা মেয়েগুলা যেন নাহিদ বলতেই অজ্ঞেন। অথচ দুই চক্ষে সহ্য হয়না ছেলেটাকে আমার।
বি.বি.এ -৩য় বর্ষের ছাত্রী আমি। নাহিদ আমার ১ বছরের সিনিয়র। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ও হঠাৎ একদিন আমকে প্রোপস করে বসলো। কোনো উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলাম। পেছন ঘুর ঘুর করে বিরক্ত করার ছেলে ও না। কোথা থেকে যেন আমার নাম্বারটা যোগাড় করেছে। প্রতিদিন রাতে শুধু একটা করে মেসেজ করতো কখনও ফোন করেনি। কোন রিপ্লাই না দিয়ে শুধু ওর মেসেজগুলো পড়তাম প্রতিদিন। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করলো। মনের আড়ালেই কখন ভালো লাগার বীজ বপন করে বসে আছি বুজতেই পারিনি।
পরপর তিনদিন ওর কোনো মেসেজ না পেয়ে কেমন যেন অস্থির লাগছিল। পরদিন ভার্সিটিতে মনে মনে ওকে খুঁজতে থাকলাম। হঠাৎ দেখি সিমির খুব কাছাকাছি বসে ওকে গান শোনাচ্ছে। বুকের ভেতর চেপে থাকা আগুনটা যেন এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। কিছু চিন্তা না করেই সবার সামনে বলে দিলাম ওকে ভালোবাসার কথা। সাথে সাথে একটা মুচকি হাসি দিয়ে পেছন থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে দিল। খানিকটা অবাক হলাম। পরে জানতে পারলাম মেসেজ না করা, আমাকে জেলাস করা, পুরোটাই সাজানো ছিল। আর তার প্রধান হাতিয়ার ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী সিমি। চোখের জলটা থামাতে পারলাম না। সবার সামনেই কেঁদে দিলাম। একটা কান্না মানুষকে এতোটা সুখ দিতে পারে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম।
শুরু হল ভালবাসার আকাশে কষ্ট সুখের সাত রঙ মিশিয়ে একি স্বপ্ন দুটি হৃদয় দিয়ে আঁকা। ও আমাকে সুখ পাখি বলে ডাকে। ওর পাগলামি গুলা যেন একি সাথে আমাকে কাঁদায় আবার হাসায়। অদ্ভুত একটা অনুভূতি।
আমাকে নিয়ে ওর গান। স্বপ্নের ভেলায় চড়ে তারার দেশে যাওয়া। হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা। মাঝ রাতে আমাকে দেখার নাম করে আমার বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে থাকা। ক্লাস ফাকি দিয়ে মুভি দেখতে যাওয়া। একই স্বপ্ন হাজার বার ভেঙ্গে নতুন করে গড়া। সব কিছু মিলিয়ে যেন আমার একটা পৃথিবী সুখের স্বর্গ ও।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। ওর বি.বি.এ শেষ হলো আর আমি ৪র্থ বর্ষে উঠলাম। যে ভয়টা বুকের ভেতর সব সময় কাজ করতো সেটাই হলো। আমার আর নাহিদের সম্পর্কের কথাটা বাসাই জানা জানি হয়ে গেল।
আব্বু আম্মুর ইচ্ছের বাইরে আপু পালিয়ে গিয়ে তার ক্লাসমেট সহেল ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল। ওদের ৪ বছর এর রিলেশন বিয়ের এক বছরের মাথাই ছাড়াছাড়ি। এ ব্যাপারটাই যেন আমার স্বাধীনতার একমাত্র ঘাতক। সাময়িকভাবে আমার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ। ফোনটাও আব্বুর কাছে। এক কথায় বন্দি আমি। আপুর ব্যাপারটার পর আব্বু অনেক অসুস্থ হয়ে পরেছিল এখনও সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আব্বুর ইচ্ছের বাইরে কিছু বলা মানে তাকে মৃত্যুর পথে একধাপ এগিয়ে নেয়া। কিছুই বলতে পারলাম না।
এক সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক করলো আব্বুর ব্যবসায়ী বন্ধু রাজ্জাক আঙ্কেলের ছেলে সুমনের সাথে। নিঃশব্দে কাঁদা ছাড়া কিছুই যেন করার নেই আমার।
এদিকে নাহিদ পাগলের মতো চেষ্টা করছে আমার সাথে যোগাযোগ করার। কোনো উপায় না পেয়ে সিমিকে আমার বাসায় পাঠালো খোঁজ নেবার জন্য। মানুষটা আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। এতো বড় অন্যায় কি করে করবো আমি। কি করে কাঁদাবো এই মানুষটাকে। ঠিক করলাম পালিয়ে যাবো। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অনেক কষ্ট করে বাসা থেকে বেরও হলাম। কিন্তু আপুর চলে যাওয়ার পর আব্বু আম্মুর কষ্ট লজ্জা সব কিছুর ছবিটা চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠলো। পারলাম না। একটা ফোন ফ্যাক্স এর দোকান থেকে কাঁদতে কাঁদতে নাহিদকে সরি বলে অর্ধেক রাস্তা থেকেই আবার বাসায় ফিরে আসলাম। এসে দেখি প্রত্যাশা অনুরূপ বাসার সবাই চুপচাপ বসে আছে। যে আব্বু আমাকে কোনো দিন ধমক দিয়ে কথা বলেনি, সে আব্বু আমার গায়ে হাত তুললো। সারা রাত কাঁদলাম। কান্নাই যেন একমাত্র সঙ্গী এখন। না পারছি আব্বু আম্মুকে কষ্ট দিতে না পারছি নাহিদকে কাঁদাতে।
পরদিন সকালে রাজ্জাক আঙ্কেলের একটা ফোন আমার জীবনটাতে একই সাথে মুক্তি আর পঙ্গুত্ব দান করলো। ডাক্তারের মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না। বিয়েটা ভেঙ্গে গেল। কাঁদবো না মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলবো বুজতে পারলাম না। শুধু স্তব্ধ হয়ে থাকলাম।
নাহিদের সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ আমার নেই। সিমির মাধ্যমে ও সব কিছু জানলো। আর সব জেনে শুনেই ওর আব্বুকে দিয়ে আবারও বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো আমার বাসায়। প্রথম বার ফিরিয়ে দিলেও এবার আর পারলো না। কারণটা সহজ। আব্বু আম্মু স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা লজ্জিত হয়ে নাহিদের এক আকাশ সমান ভালোবাসার কাছে হার মানলো। পাওয়া না পাওয়াই আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের আর সুখের দিন এটা।
পরদিন নাহিদের অনুরোধেই আব্বু আম্মুর অনুমতি নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গেলাম । কথা বলার শক্তিটা যেন হারিয়ে ফেলছি। কাঁপতে কাঁপতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ও কাছে এসে আমার হাত ধরে বললো- আমি শুধু তোমাকে চাই হেনা। আমার আর কিচ্ছু দরকার নেই। বিশ্বাস করো আমার শুধু তোমাকে হলেই চলবে। বলো আমকে আর কখনও ছেড়ে যাবা নাতো ?
উত্তরে কিছুই বলতে পারলাম না। বুক ফেটে কান্না এলো। ওর এই সীমাহীন ভালবাসার কাছে আমি খুবই নগণ্য। কোথাই রাখবো ওর এতোটা ভালবাসা। কি দিয়ে শোধ করবো আমি। সুখের কান্নাটা আর থামাতে পারলাম না। চোখের সামনে থাকা স্বর্গটার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদলাম। ও হাত দিয়ে চোখের জ্বলটুকু মুছে দিল।
ওকে হয়তো বাবা হবার সুখটা কোনো দিনও আমি দিতে পারবো না। তবে আমার শেষ নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত এক বিন্দু কষ্ট পেতে দিবো না ওকে। তাতে আমার মরণ হলেও হাসতে হাসতে মেনে নেবো সেই মরণটাকে। আমি ভালোবাসি নাহিদ। অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে।
লেখক: খুশির রোদ্র।
বি:দ্র: সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি