জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, শুরুতে যেমন ছিল
পাঠকই লেখক ডেস্ক: উনিশ শ’ বাহাত্তর সাল। আমি সিলেট এমসি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকা এসেছি।
উঠেছি মামার বাসায় ধানম-িতে। খুব সহজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেলাম। ভাবছি ভর্তি হব কি হব না,
কারণ সে সময় সারা দেশের তুখোড় ছাত্র-ছাত্রীরা সব এসে ভীড় করত ওই বিভাগে। আমার চিন্তা, ভর্তি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রম শ্রেণী পাওয়া
আমার জন্য অসম্ভব হবে। আপাতত এটা তো হাতে আছে, থাক না, চেষ্টা করে দেখি যদি জাহাঙ্গীরনগরে সুযোগ পাই তাহলে চলে যাব সেখানে।
দু’তিন দিন পর পাসপোর্ট সাইজ ছবি, মার্কশিট, সার্টিফিকেট, টেস্টিমোনিয়্যাল, ইত্যাদির সত্যায়িত
অনুলিপি বগলদাবা করে সকাল বেলা ঢাকা থেকে রওয়ানা দিলাম সাভারের উদ্দেশ্যে। বাসে উঠব
বলে মীরপুর রোডে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় পা-দানিতে
দাঁড়ানো হেলপার বাসের গায়ে থাপড়াতে থাপড়াতে এসে থামল আমার সামনে, মুখে তার দু’টো
শব্দ, ‘‘সাভার নয়ারহাট, সাভার নয়ারহাট, সাভার নয়ারহাট...’’। লাফ দিয়ে উঠলাম বাসে, বসার
জায়গা পেলাম না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম গাবতলী পর্যন্ত। সেখানে গিয়ে বাস থেকে নেমে পায়ে
হেঁটে পুরনো ছোট্ট লোহার পুল (তখন ডান দিকের দু’লেনের বড় পাকা পুলে কাজ চলছে) পেরিয়ে
আমিন বাজার গিয়ে উঠলাম লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা আরেক বাসে। হেলপারের কন্ঠে সেই একই
আওয়াজ, ‘সাভার নয়ারহাট, সাভার নয়ারহাট, সাভার নয়ারহাট...’ তখন ছোট ছোট ওই পুরনো
বাসগুলোকে বলা হত মুড়ির টিন। বাসের সঙ্গে মুড়ির টিনের কী সম্পর্ক তা আজো আমার মাথায়
আসে না। বাসে এবার বসার জায়গা পেলাম ঠিকই - বাঁদিকে উইন্ডো সিটে, কিন্তু কড়া রোদে ঘেমে
ওঠা ভ্যাপসা গরম মুহূর্তেই জানান দিয়ে গেল জুলাই মাস চলছে!
কতক্ষণ পর ভেঁপু বাজিয়ে বাস ছেড়ে দিল। সাথে সাথে খোলা জানালা দিয়ে মুক্ত বাতাস পশ্চিম
দিক থেকে ঢুকে পূব দিকে বেরিয়ে যেতে লাগল। বয়ে যাওয়া শিরশিরে হাওয়া ভালই লাগছিল।
ততক্ষণে আমার ঘামে ভেজা চিটচিটে জামাটা আস্তে আস্তে শুকাতে শুরু করেছে। ডানে বাঁয়ে
তাকিয়ে দেখি মীরপুর হাওর, থৈ থৈ ঘোলা পানিতে বড় বড় ঢেউ খেলছে। মাত্র এক লেনের রাস্তা,
দু’পাশে বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছ। ছোটবেলা হাকালুকি হাওর পেরিয়ে নাওয়ে করে মায়ের সাথে
নানার বাড়ি নাইওর যেতাম, নাও চলত ডুবু ডুবু হিজল গাছের গা ঘেঁষে ঘেঁষে। আজ হাওরের
মাঝখান দিয়ে নৌকো নয় - গাড়ি চড়ে যাচ্ছি! বাহ! কী মজা! না জানি সামনে আরো কত কিছু
২
দেখব! রাজধানী শহর ঢাকার এত কাছে এত বড় হাওর - আমার ধারণা ছিল না! দেখলাম, হাওরে
ছোট ছোট ডিঙ্গি থেকে জেলেরা মাছ ধরছে, পাল তুলে বড় বড় মালবাহী নৌকো এদিক ওদিক
ছুটছে, কোনোটায় বালু, কোনোটায় ইটপাথর, কোনোটায় গরু। নাইওরি নাও-ও আছে দু’একখানা।
ছৈওয়ালা নৌকোর প্রবেশপথ শাড়ী দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। ওমা! একটুখানি অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে
না ভাবতে দেখি হাওর শেষ হয়ে গেল! আরেকটু পরেই চলে এলাম হেমায়েতপুর। বাস থামল।
এদিক ওদিকের ডোবা-নালা থেকে পচা পাটের গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে; অতি চেনা সে’ গন্ধ -
সে যে আমার কী ভাল লাগে - বলে বোঝাবার নয়! ওই গন্ধ আমাকে পাগল করে দেয়! ইচ্ছে
হচ্ছিল বাস থেকে নেমে বটগাছের তলায় চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, পচা পাটের গন্ধ
শুঁকি, কিন্তু সে কি আর সম্ভব? সামনে যেতে হবে আরেকটু, তারপর দূর, অনেক দূরের পথ পাড়ি
দিতে হবে আমাকে। আমার যে স্বপড়ব আছে! অনেক বড় স্বপড়ব! আকাশ ছোঁয়া স্বপড়ব!
পচা পাটের গন্ধ পেছনে ফেলে বাস চলতে লাগল, জোড়-পুল, ঝাউতলা, সাভার থানা, সাভার
বাজার, সিঅ্যান্ডবি, ডেইরি ফার্ম পেরিয়ে এসে নামলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটে। ওই গেটে
তখন দোকানপাট কিছুই ছিল না। কাঁঠাল বাগানের পাশ দিয়ে লাল ইট বিছানো রাস্তা ধরে কোয়ার্টার
মাইল হেঁটে এসে পৌঁছলাম অর্থনীতি বিভাগে। বিভাগের কেরানি রাখাল বাবুর কাছ থেকে ভর্তি
ফরম নিয়ে ফিলআপ করে নাম দস্তখত লিখে ছবি এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে গেলাম
এক নম্বর হলের (বর্তমানে যার নাম আল-বেরুনী হল) ক্যান্টিনে, দু’টো আলুর চপ কিনে খেলাম,
খিদের মাঝে খুব মজা লাগল! সিলেট থেকে এসেছি গেঁয়ো বাঙাল, আলুর চপ আগে কখনো
খাইনি। পরক্ষণেই ভাবলাম, সেদ্ধ আলুকে ভাল করে চট্কিয়ে ভেতরে সেদ্ধ ডিম আর পেঁয়াজ
ভাজার স্ট্যাফিং দিয়ে এক মাথা মোটা আরেক মাথা চোখা করে সাইজ করে তারপর গায়ে রুটির
গুঁড়ো মেখে ডীপ ফ্রাই করেছে। আলু ভর্তা একটু কায়দা করে সার্ভ করা - এই যা! এ আবার নতুন
কী?
ক্যান্টিন থেকে ফেরার পথে ফুল বাগানের ওপর দিয়ে কাচের জানালার ভেতর দেখি বিশাল ডাইনিং
রুম। ফরমাইকাটপ টেবিলের ওপরে প্রতিটা চেয়ারের সামনে একটা করে খাবার প্লেট উল্টানো,
প্লেটের মাথায় একটা করে গ্লাস - পানি ভরা না খালি বোঝার উপায় নেই! তারপর দু’কদম হেঁটে
ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে কতক্ষণ ক্যাম্পাসের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। প্রম দিনেই
জাহাঙ্গীরনগরের পানি, পাখি, লতাপাতা, আর খোলা হাওয়া আমাকে যাদু করে ফেলল! আমি হয়ে
গেলাম আমার আল্মা মেইটার-এর চির প্রেমিক, খাঁটি প্রেমিক, সে প্রেমের বন্ধন আজো আছে,
অটুট, একেবারে যাকে বলে ষোল আনা! শুধু কি জাহাঙ্গীরনগর? তার মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ
সবকিছুই আমার এখনো ভাল লাগে, যেমন লেগেছিল প্রম দিন। তাদের সবার প্রেমে আমি
দেওয়ানা! যেখানেই থাকি, যতদূরই থাকি, লাল-সবুজের জাহাঙ্গীরনগরের কথা সব সময়ই আমার
মনে পড়ে, আর নস্টালজিয়া আমাকে যখন তখন পেয়ে বসে!
৩
এভাবে প্র ম দিনের মায়াময় অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম ঢাকায়, মামার বাসায়। কয়েক দিন পর
আবার গেলাম জাবি ক্যাম্পাসে লিখিত পরীক্ষা দিতে। ঐ দিন একটা সামান্য বিষয় আমাকে এক
ধাঁধায় ফেলে দিল। মাত্র কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয়-চর্তু শ্রেণী কর্মচারি ইউনিয়নের
নির্বাচন হয়ে গেছে। ওই নির্বাচন উপলক্ষ্যে প্রার্থীরা দেয়ালে দেয়ালে পৌস্টারিং করেছে। ছোট ছোট
সাদা কাগজের ওপর লেখা ও আঁকা পৌস্টার। নাম ও পদ-পদবির সাথে কারো পৌস্টারে হাঁস,
কারো পৌস্টারে ছাতা, কারো পৌস্টারে দোয়াতকলম, ইত্যাদির ছবি আঁকা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি
হাতে লেখা, হাতে আঁকা, কিন্তু ছাপা, ঘন কালো ছাপার কালির ছাপ। এ কী করে সম্ভব! আমি
অনেক ভেবেও এর কোনো হদিস পাইনি! সাইক্লোস্টাইল বলে যে একটা টেকনলোজি ছিল, সেটা
তখন আমার জানা ছিল না। কপিয়িং মেশিনের ঠেলায় নিশ্চয়ই আজ আবার সাইক্লোস্টাইল কল
হারিয়ে গেছে। সেদিনের লিখিত পরীক্ষায় প্রশড়ব কী ছিল, তা আজ অনেক ভেবেও মনে করতে পারছি
না। মনে পড়ল ওয়াশিংটন ডিসিতে বন্ধু নুরুল আলম চৌধুরীর কথা। তাকে ফোন করলাম। সে
মনে করিয়ে দিল, ‘‘বিজ্ঞান এবং মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আলাদা প্রশেড়ব পরীক্ষা
হয়েছিল’’। আমি ছিলাম মানবিক বিভাগে। অর্থনীতি এবং সাধারণ জ্ঞানের ওপর অনেকগুলো ছোট
ছোট প্রশড়ব ছিল এবং একটা রচনাও লিখতে হয়েছিল। একটা মাত্র ছোট প্রশড়ব আজ আমার মনে
পড়ে। ‘‘ডযড় রং ঃযব ভরহধহপব সরহরংঃবৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয? উত্তরটা আমার জানা ছিল,
‘তাজউদ্দিন আহমেদ’।
লিখিত পরীক্ষার পর আরেক দিন গেলাম মৌখিক পরীক্ষা দিতে। ভাইবা বোর্ডে তিন-চারজন স্যার
ছিলেন, তাঁর মধ্যে একজনের কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। তিনি আমাকে লিনিয়ার ইকুয়েশনের
স্লৌপ ও ইন্টারসেপ্ট সনাক্ত করতে বলেছিলেন। স্যারের নাম ইকবাল আহমেদ। তিনি চমৎকার
রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। আমার সঠিক উত্তর শুনে স্যার যেমন খুশি হয়েছিলেন তেমনি একটু
অবাকও হয়েছিলেন! কারণ আইএ ক্লাসে তখন লিনিয়ার ইকুয়েশন পড়ানো হত না। আমি যখন
বললাম, অর্থনীতি পড়ার জন্যই আমি ইন্টারমেডিয়েটে ইলেক্টিভ ম্যাথ নিয়েছি, তখন তিনি অবাক
হলেন না, কিন্তু আরো খুশি হলেন এবং আমিও তাঁর ইতিবাচক সঙ্কেতটা বুঝে গেলাম।
এরপর আরেক দিন গেলাম রেজাল্ট দেখতে এবং ভর্তি হতে। ওই দিন যাওয়ার সময় মামা বলে
দিলেন, ফেরার পথে সাভার থেকে বাসার জন্য ফ্রেশ রসগোল্লা নিতে। আমি ওই দিন গেলাম,
রেজাল্ট দেখলাম, ভর্তি হলাম, এবং খুশি মনে ঢাকায় ফিরেও এলাম, কিন্তু রসগোল্লা কিনতে সাভার
বাজার নামা হল না, বেমালুম ভুলে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল, ভাবছি বাসায় ফিরে মামামামীে
ক কী বলব! সারা পথ এ চিন্তা করেই এলাম। বাস মীরপুর সড়ক ধরে ধানম-ি ২ নম্বর রোড
পার হয়েছে। আরেকটু সামনে যাওয়ার পর হাতের বাঁদিকে তাকিয়ে সমস্যাটার উপস্থিত একটা
সমাধান বের করে ফেললাম। দেখতে পেলাম ‘মরণ চান্দ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সান্স মিষ্টানড়ব ভান্ডার’ (ঢাকা
৪
কলেজের মুখোমুখী পেট্রল পাম্প-এর লাগা দক্ষিণ পাশেই ছিল, ওটা এখন আর ওখানে নেই)। বাস
থেকে নেমে মিষ্টির দোকানে ঢুকছি আর ভাবছি, আজ ‘মরণ চান্দ’ আমাকে বাঁচিয়ে দিল! এক সের
(তখনো দেশে ম্যাট্রিক সিস্টেম চালু হয়নি) রসগোল্লা কিনলাম। দোকানি মাটির পাতিলের মুখ বন্ধ
করল ‘মরণ চান্দ’এর মার্কা মারা লাল-সাদা কাগজের লেভেল দিয়ে। দোকান থেকে বেরিয়ে,
খবরের কাগজ কিনে, ছিঁড়ে, সাইজ করে, ‘মরণ চান্দ’এর মার্কা মারা লেভেল ফেলে দিয়ে, পত্রিকার
কাগজ বসিয়ে, আবার দড়ি দিয়ে পাতিলটাকে ভাল করে পেঁচালাম। তারপর রিক্সায় উঠে বাসায়
চলে এলাম। বিকেলের চা-নাস্তার সময় রসগোল্লার ভা- খোলা হল। মামা মিষ্টি মুখে দিয়েই মামীকে
বললেন, ‘‘খেয়ে দেখ সাভারের রসগোল্লা কত তাজা, কত মজা! ‘মরণ চান্দ’-এর মিষ্টি তো আমরা
হামেশাই খাই, এটা খেলেই ডিফারেন্সটা বুঝতে পারবে!’’ আমার হাসি পেল, কিন্তু অনেক কষ্ট করে
ঠোঁট দু’খানা সোজা করেই রাখলাম।
ক্লাস কখন শুরু হয়েছিল সে কথা আজ মনে নেই। শুরুর আগে একবার মা-বাবার কাছে বাড়িতে
ফিরে গেলাম কিনা তাও স্মরণে আসছে না, তবে যে দিন গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে ক্যাম্পাসে এলাম
সেদিনকার কথা পরিষ্কার মনে আছে। তখন হল ছিল কুল্লে একটা - ১ নম্বর হল ও তার পূবপাশে
লেকের উল্টো দিকে ছিল এক তালা তিন ব্লকের এক্সটেনশন। আমি বাক্স-পেঁটরা নিচে রেখে দেখা
করলাম হাউস টিউটারের সাথে - হয়ত রহিম স্যার অথবা কবির স্যার (দু’জনই তখন পরিসংখ্যান
বিভাগের তরুণ শিক্ষক)। যতদূর মনে পড়ে, আমাকে প্র মে বরাদ্দ দেওয়া হল ‘বি’ ব্লকের ৪১৬
নম্বর রুম। মালামাল নিয়ে চার তালায় উঠে এসে দেখি রুমের দরজায় ঝুলছে বিশাল এক তালা।
আবার দৌড়ে গেলাম স্যারের কাছে, এবার আমাকে বললেন, ‘‘তুমি যে রুম খালি পাও ঢুকে
যাও’’। আমি পাশের রুম ৪১৫ নম্বর খালি পেয়ে ঢুকে পড়লাম। ঠিক ওই সময় এসে হাজির হল
আব্দুর রব। তার সাথে কথাবার্তা বলে আমরা দু’জনে দখল করে নিলাম ওই রুম। সে দখলদারী
বজায় ছিল একাধারে ছ’বছর। প্রম দিনই আব্দুর রব শিখিয়ে দিল কীভাবে দুই তালা দিয়ে
ইন্টারলক করতে হয়। ইন্টারলক-এ যেমন এক তালা আরেক তালাকে ছাড়ে না, তেমনি দীর্ঘ
ছ’বছর আব্দুর রব-ও আমাকে ছাড়েনি, আমিও তাকে ছাড়িনি। আজ আমরা দু’জন যত দূরেই থাকি
না কেন, আমাদের মনের দূরত্ব শূন্যই বলব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্র ম শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় ১৯৭০ সালে। ওই বছর চার বিভাগে অর্থাৎ অর্থনীতি,
ভূগোল, গণিত, ও পরিসংখ্যান-এ ছাত্র ভর্তি করা হয়। সংখ্যা ছিল ২০০-এর মত, কেবল ছাত্র;
প্রম ব্যাচে কোনো ছাত্রী ছিল না। দ্বিতীয় ব্যাচে আমরা ভর্তি হ’লাম আরো প্রায় ৩৫০ জন। এ
নিয়ে মোট শিক্ষার্থী ৫৫০ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা তখন বড়জোর ৫০ কি ৬০। আমাদের সময় নতুন
বিভাগ খোলা হল আরো তিনটা - বাংলা, পদার্থবিদ্যা, ও রসায়নশাস্ত্র। তার মধ্যে ছাত্রী ছিল খুব
বেশি হলে ২০ কী ২৫ জন। ক্লাসরুমের সব ক’টাই ছিল ১ নম্বর হল সংলগড়ব পুরনো ক্যাম্পাসে।
পাশে ছোট ছোট এক তালা দু’টো ঘর কেমেষ্ট্রি এবং ফিজিক্সের জন্য। মেয়েরা থাকত শিক্ষকদের
৫
‘বি’ টাইপ একটা কী দু’টো বাসায়। বিশমাইলে ছিল তৃতীয়-চর্তু শ্রেণী কর্মচারিদের থাকার জায়গা,
প্রান্তিক গেটের সোজা পশ্চিম বরাবর রাস্তার দু’পাশে ছিল শিক্ষক ও অফিসারদের থাকার ‘সি’ টাইপ
কোয়ার্টার এবং প্রান্তিক গেট থেকে পুরনো ক্যাম্পাসে আসার পথে হাতের বাঁদিকে কাঁঠাল গাছ
পরিবেষ্টিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় সমবায় সমিতির অফিস, আরেকটু সামনে গেলে রাস্তার একই দিকে
ছিল সিনিয়র প্রফেসারদের জন্য ১০/১২টা ‘বি’ টাইপ কোয়ার্টার। পরে কোনো এক সময়ে ওই ‘বি’
টাইপ কোয়ার্টারগুলোকে ‘এ’তে উনড়বীত করা হয়। ১ নম্বর হলের এক্সটেনশনের পূব বরাবর একটা
ঘরে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। তার পাশে ছোট্ট একটা রুমে ছিল পৌস্ট আপিস। তার দক্ষিণে একটা
এক তালা ঘরে ছিল ইঞ্জিনিয়ারদের অফিস কমপ্লেক্স, তার দক্ষিণে এ রকমই আরেকটা ঘরে ছিল
রেজিস্ট্রার এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার সহ সকল প্রশাসনিক কার্যালয়। উপাচার্যের বাসা এবং মূল
আপিস ছিল ঢাকায় - ধানম-ি ২ নম্বর সড়কে। ক্যাম্পাসে তাঁর আরেকটা কার্যালয় ছিল ক্লাসরুম
ভবনের ঈশান কোণে। ‘বি’ টাইপ বাড়িগুলোর পূব পাশে ছিল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং মেথর
পট্টি। ছাত্রদের কমনরুম, টিভি রুম, এবং নামাজের ঘর ছিল হলের ডাইনিংরুমের উপর তালায়। ১
নম্বর হলের এক্সটেনশনের উত্তর দিকে ছিল পরপর দু’টো ঘর, প্রমটাতে ছিল জাকসু কর্মকর্তাদের
আপিস, এবং লেখাধুলার সাজ সরঞ্জামসহ ফিজিক্যাল ডাইরেক্টোরেট। তার পরের ঘরে ছিল
ডাক্তারের আপিস, কিøনিক, এবং একটা ছোট্ট ফার্মেসী।
এর সামনে উত্তর দিকে ছিল খুব সুন্দর একটা তিন কোণা ফুলের বাগান। সে সময় ক্যাম্পাসের
মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় এবং সাজানো ফুলের বাগান। ক্লাসরুম ভবনের একটা রুমে ছিল
শিক্ষক ও অফিসারদের ক্লাব। হল ক্যান্টিনের পশ্চিম পাশে ছিল একটা ছোট্ট ঘর, ওখানে ছিল বাসুর
কনভেনিয়েন্স স্টোর এবং তার উল্টো দিকে ছিল একটা লন্ড্রি। বাসুর দোকানের দু’দিকে সব সময়
দু’টো জিনিস ঝুলত। একদিকে কলার ছড়ি আরেক দিকে জ্বলন্ত দড়ি। পানি সাপ্লাইর জন্য একটা
গভীর নলকূপ, আর তার অপারেটার থাকত ওই দূরে দক্ষিণ ক্যাম্পাসে বটগাছের তলে। ব্যাস,
তখন ফিজিক্যাল ফেসিলিটি এর বেশি আর কিছুই ছিল না। আমরা যখন ভর্তি হই তখন দুই নম্বর
হলের (এখনকার মীর মোশাররফ হোসেন হল) কাজ চলছে। আল-বেরুনী হল সংলগড়ব খেলার মাঠটা
শুরু থেকেই ছিল। যে সব স্থাপনার কথা বললাম, তাদেরকে যুক্ত করেছিল লাল ইট বিছানো রাস্তা।
রাস্তার দু’পাশে লাগানো হয়েছিল অ্যাকেইশিয়া গাছ ও কিছু শাল গাছ। তবে বিশমাইল থেকে মীর
মোশাররফ হোসেন হল পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ক্যাম্পাসের মূল রাস্তা ছিল এর ব্যতিμম। এর
একটা বড় অংশ ছিল অসম্পূর্ণ এবং কাঁচা। দক্ষিণ দিকের অংশ, অর্থাৎ মীর মোশাররফ হোসেন
হলের নিকটবর্তী প্রায় আধা মাইল ছিল মাটির পথ। সে অংশে তখনো ইটপাথর কিছুই পড়েনি। শুধু
কি তাই? ওই কাঁচা রাস্তার দু’পাশে ছিল লম্বা ঘাস, আগাছা, এবং কাঁটাযুক্ত নানাজাতের জংলি
গাছপালায় ভরা। দিনের বেলায়ও সে পথ পার হতে রীতিমত গা ছমছম করত! রাতের বেলা শিয়াল
ডাকত ওখান থেকেই।
৬
উনিশ শ’ সত্তরের গোড়ার দিকে জাবি’র পরিবহন ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। লোক যাতায়াতের জন্য
গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ি ছিল মাত্র চারখানা - উপাচার্যের প্রাইভেট কার, তাঁর আপিসে একখানা
বিস্কুট রঙের পুরনো মাইμোবাস (সিনিয়র প্রফেসারদের জন্য), এবং দু’খানা বাস। বাসের মধ্যে
যতদূর মনে পড়ে, একখানাকে কনভার্ট করা হয়েছিল ট্রাকের ইঞ্জিনের সঙ্গে বডি যোগ করে। এটা
ছিল নীল এবং হালকা হলুদ রঙের। আরেকখানা ছিল গাঢ় সবুজ এবং বেশ লম্বা। নামটা কে
দিয়েছিল জানি না, তবে সবুজ বাসের নিক নেইম ছিল ‘বোয়িং’। বোয়িং’-এর দু’সাইডে সাদা রঙে
বড় বড় হরফে লেখা ছিল ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’। দিনে তিন-চার বার রাজধানীর রাজপথে
চলার মাধ্যমে এই বোয়িং ঢাকা সহ সারা দেশে জানান দেয় জাবির অস্তিত্ব। দেশব্যাপী নতুন এই
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ছড়ানোতে ‘বোয়িং’-এর চেয়ে কার্যকর ভূমিকা আর কেউ রাখতে পেরেছিল
বলে আমার মনে হয় না। দুই বাসের জন্য চার-পাঁচ জন কন্ডাক্টার-হেলপার ছিল। তার মধ্যে
দু’জনের নাম মনে আছে, আজিজ এবং চুনড়বু। আজিজ ছিল ছ’ফুট উঁচা মোটা তাজা এবং খুব রসিক
স্বভাবের লোক। ঢাকা থেকে আসার পথে সাভার থানা স্টপ ছাড়ার পরপরই সে বলতে থাকত
‘সাভাইরা বাজার, সাভাইরা বাজার..’। আজিজের মুখে ‘সাভাইরা বাজার, ‘সাভাইরা বাজার..’
শুনতে কেন জানি আমার খুব মজা লাগত! বাস কখন চলবে, কখন আস্তে যাবে, এবং কখন থামবে
তা বোঝাবার জন্য মোর্স টেলিগ্রাফির মত বাসের ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টারের মধ্যে একটা সাঙ্কেতিক
ভাষা ছিল। সেটা বুঝতে আমার বেশ কিছুদিন লেগেছিল। বাসের গায়ে যখন ধপাধপ অনেকগুলো
থাপ্পড় মারবে তখন চলবে, যখন থাপ্পড়ের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাবে তখন আস্তে যাবে, আর একটা
থাপ্পড় মারার মানে বাস থামবে।
আমাদের হল-জীবনে খাওয়া-দাওয়াটাও ছিল বেশ মজাদার। সকাল বেলা হাতমুখ ধুয়ে ক্যান্টিনে
যেতাম নাস্তা খেতে। নাস্তার মেন্যু হররোজ একই - স্ট্যান্ডার্ড অর্ডার ছিল - দু’খানা পরোটা, তার
সাথে চায়ের পিরিচে এক পিরিচ আলু-পটল ভাজি, অথবা বুটের ডাল। ডিমের অমলেট অথবা পৌচ
ও পাওয়া যেত, কিন্তু দামের কারণে সেটা আমরা হামেশা খেতে পারতাম না। স্বাদে নতুনত্ব আনার
জন্য বড়জোর সপ্তাহে একদিন ডিম কপালে জুটত। গরিবদের সাধ্য না থাকলেও বুদ্ধি ছিল,
আমাদেরই কোনো এক বন্ধু এক সময় নাস্তার টেবিলে নতুন এক আইটেম আবিষ্কার করে বসল।
পরোটার সাথে ভাজি অথবা বুটের ডালের একটা নিতে হত দু’ চামচ করে। সে একদিন বলল,
‘‘আমাকে এক চামচ ভাজি আর এক চামচ ডাল মিশিয়ে দে’’। আস্তে আস্তে ক্যান্টিনে ‘ডাল-ভাজির’
মিশেল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। পরবর্তী পর্যায়ে এই মিশেলের নাম হয়ে গেল ‘মিকচার’।
এভাবে পরোটার সাথে দু’-এর পরিবর্তে ক্যান্টিনে পাওয়া যেত তিন পদ - ডাল, ভাজি, ও মিকচার।
নাস্তার সময় চা কেনাবেচা হত কিনা মনে করতে পারছি না, তবে অন্য সময় চা শুধু পাওয়াই যেত
না, সে চা ছিল খুব মজাদার! অনেকক্ষণ জ্বাল দেওয়া লিকারে ঘন দুধ এবং চিনিতে তৈরি হত অপূর্ব
স্বাদের চা! এ লেখা আগে লিখলে সেদিনকার ক্যান্টিনে ডিম, পরোটা, ডাল, ভাজি, চা’র দাম কেমন
৭
ছিল তা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারতাম। এখন স্মরণশক্তিকে দোষ দিয়ে আর লাভ কী? বয়স তো
কম হল না। তবু যতদূর মনে করতে পারছি, নাস্তা খেতে আমাদের এক টাকার বেশি লাগত না।
দুপুরে এবং সন্ধ্যার পরে হল ক্যাফেটেরিয়ায় সার্ভ করা হত ভাত। দুপুরের মেন্যুতে সাধারণত
থাকত মাছ এবং রাত্রে গোশ্ত। পাতলা ডাল ছিল দিনেরও সাথী, রাতেরও সাথী। কদাচিৎ ব্যতিμম
ছাড়া ঘুরেফিরে মাছ খেতাম আমরা তিন প্রকারের - নলা মাছ, ইলিশ, আর কৈ। গরমকালে প্রম
দু’টো, শীতকালে কৈ। নলা মাছ আমার একদম ভাল লাগত না। তারপর কাঁটার কারণে এ মাছে
আমার কোনো আগ্রহই ছিল না। ইলিশটা আমার খুব প্রিয় ছিল। ইলিশের ডিম থাকলে, ডিমের বাটি
আলাদা বানানো হত, এবং আমি ডিমই পছন্দ করতাম, তবে দেরিতে গেলে আর ডিম পাওয়া যেত
না। এখানে বলতে দ্বিধা নেই, জীবনে একবার এ অমৃতেও আমার অরুচি ধরেছিল এবং সেটা
হয়েছিল এই এক নম্বর হলের ডাইনিং রুমেই। উপর্যুপরি ইলিশ খেতে খেতে একেবারে ত্যক্ত বিরক্ত
হয়ে উঠেছিলাম। ইলিশের ওপর ভীষণ অরুচি এসে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে
বেরুনোর পর অনেক দিন আমি ইলিশ খেতেই পারতাম না। ইলিশের গন্ধ নাকে লাগলেই রীতিমত
বমি আসত। অবশ্য দু’তিন বছরের মধ্যেই আমি সে সিনড্রোম থেকে বেরিয়ে আসি। আবার হয়ে
যাই একজন ইলিশ ভক্ত, ইলিশ পাগল, ও ইলিশ রসিক মানুষ। ইলিশ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে
ভুলে গেছি, - যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, ইলিশের মাথা কিংবা লেজের প্রতি আমার আকর্ষণ
কোনো কালেই ছিল না, এখনো নেই। এখানে কৈ মাছের কথাও আরেকটু বলা দরকার। শীতকালে
কৈ কেনা হত ভোর বেলা অন্ধকার থাকতে নয়ারহাট মাছের আড়ত থেকে। টুকরিতে করে কৈ এনে
যখন গোন া হত তখন জীবিত তাগড়া তাগড়া জিয়ল মাছের লাফালাফি দেখতে আমার খুব ভাল
লাগত। অবশ্য মাঝে মাঝে সাভার বাজার থেকেও কৈ কেনা হত। ওইসব বড় দেশি কৈ আজকাল
পাওয়া যায় কিনা জানতে বড় ইচ্ছে করে।
রাতের খাবারে থাকত হয় গরু, না হয় খাসী, নতুবা মুরগি। যে দিন গরুর গোশত রানড়বা হত, সেদিন
হিন্দু ছাত্রদের জন্য থাকত ডিমের তরকারি। প্রতিটা বাটি সাজানো হত দেড়টা ডিম আর ঝোল
দিয়ে। বাটিতে দেড়টা ডিম সাজাবার জন্য সেদ্ধ ডিমকে মাঝখান দিয়ে কাটতে হত। ছোট বেলা
বাড়িতে মা-চাচীকে বটি দিয়ে ডিম কাটতে দেখেছি। হলে এসে দেখলাম এক অভিনব পদ্ধতি। এক
টুকরো সুতোর দুই মাথায় দু’টো বাঁশের কাঠি বেঁধে বয়-বেয়ারারা বানাত সুতোর করাত এবং এ
করাত দিয়ে টেনে টেনে আস্ত সেদ্ধ ডিমকে দু’ভাগ করা হত। বটি দিয়ে ডিম কাটলে বটির গায়ে
ডিমের কুসুম লেগে যে অপচয় হত, সুতোর করাত দিয়ে সে অপচয় তারা রোধ করত। যেদিন মুরগি
রানড়বা হত সেদিন ঘিলা, কলিজা, এবং কল্লা দিয়ে বানানো হত ‘কলিজি বাটি’। ডাইনিং হলে ‘কলিজি
বাটি’, ইলিশের ডিমের মতই সব সময় থাকত ‘হাই ডিমান্ড আইটেম’। প্র ম আধা ঘন্টায়ই শেষ
হয়ে যেত। তরকারি শেষ হওয়ার পর রাত ১১/১২টার পরে কেউ খেতে এলে তাকে দেওয়া হত
ডালের সাথে দু’টো ডিমের ওমলেট।
৮
লিখতে গিয়ে আজ ডাইনিং হলের দু’টো মজার ঘটনার কথা মনে পড়ছে। প্র মটা এ রকমঃ রাতের
খাবার খেতে এসেছি একসাথে আমি, আমার রুমমেট আব্দুর রব, এবং আমাদের আরেক বন্ধু
আব্দুল আউয়াল। সে রাতে অপ্রত্যাশিতভাবে সার্ভ করা হয়েছে ইলিশ মাছ। ওবেলা আমি ডিমের
কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি - নিয়েছি ইলিশের পেটি, আব্দুর রব-ও এ রকম একটা কিছু
নিয়েছে, কিন্তু আউয়াল যখন এসে বসল তখন তার সামনে দেখি ডিমের বাটি। আমি বললাম,
আউয়াল, তুই তো মাছের ডিম খাস না, আজ কী মনে করে ডিম নিলি? আউয়াল জবাব দিল, ‘‘ঠিক
করতে পারছিলাম না - মাথা খাব, না লেজ খাব, না পেটি খাব, না পিঠ খাব, তাই ভাবলাম
পুরোটাই খাই’’। আশা করি আউয়ালের কথার গূঢ় অর্থ বুঝতে আপনাদের কারো অসুবিধা হচ্ছে না,
সে সব সময় এভাবেই কথা বলত।
দ্বিতীয় ঘটনা একটু ভিনড়ব ধরণের। আমাদেরই এক বন্ধুর রুমে এসে উঠেছেন পাবনা থেকে তার এক
গেস্ট - হতে পারেন আত্মীয়, হতে পারেন তার বন্ধু। ছিলেন অন্তত মাস খানেক। কয়েক দিন
যাবার পর শুনি তিনি নাকি এক সিটিং’এ শুধু ডাল দিয়ে দশ-বারো জনের ভাত খেয়ে ফেলেন।
খেতে বসলে তাঁর পাক্কা দু’ঘন্টা সময় লাগত। প্রম প্র ম আমি এমন আজগুবি কথা বিশ্বাস
করিনি। পরে যখন দেখলাম সবাই একই কথা বলাবলি করছে তখন আর অবিশ্বাস করি কী করে।
দু’এক দিনের মধ্যে আমি হাতেনাতে তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম। সেদিন আমি ঢাকা থেকে এসে
দুপুরের খাবার খেতে ডাইনিং হলে গিয়েছি দেরিতে। তখন বিকেল সাড়ে তিন কি চারটা বাজে।
দেখি গোটা হল খালি, আমাদের মে’মান একাই খাচ্ছেন। ইচ্ছে করে আমি তাঁর পাশে গিয়ে
বসলাম। আমি খাওয়া শেষ করে উঠে যাব, তখনও তিনি খাচ্ছেন, আমি তাঁকে শুধু জিজ্ঞেস
করলাম, এই পাতলা ডাল আপনি খেতে পারেন? তিনি আমাকে বললেন, ‘‘ডাল নয়, ডাল নয়, এ
তো অমৃত!’’
খাওয়ার ব্যাপারে আরো দু’টো কথা না বললেই নয়। শীতের সকালে আশপাশ গ্রামের লোকজন
কলসি ভরে তাজা খেজুরের রস নিয়ে আসত ক্যাম্পাসে। নাস্তার পরে ছ’কড়া ন’কড়া দামে আমরা
খেজুরের রস কিনে খেতাম। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে বারো মাস আরেকটা জিনিস পাওয়া যেত। সেটা
হল সাভারের বড় বড় তাজা রসগোল্লা। যে ছেলেটা বালতিতে করে রসগোল্লা নিয়ে করিডোরে
ঘোরাঘুরি করত তার নাম ছিল বিপদ। একটা রসগোল্লার দাম ছিল এক টাকা এবং তারের চিমটি
দিয়ে ধরে একটুকরো কাগজে সে রসগোল্লা সার্ভ করত। বিপদ সব সময় আমাদের মিষ্টি মুখ করাত
আবার কখনো কখনো ‘বিপদেরও’ কারণ হয়ে উঠত। সে যদি টের পেত, বাইরের মে’মান নিয়ে
কেউ কোথাও বসে গল্প করছে, তা হলে সে এমনভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত যে, বাধ্য হয়ে
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিষ্টি কিনতে হত।
৯
ক্যাম্পাসের ভেতরে বিভিনড়ব সময়ে ঝুপড়ি ঘরে ছোট ছোট খাবার দোকান গজিয়েছে, আবার কিছুদিন
পর লালবাতিও জ্বালিয়েছে। ওদের মধ্যে একটার কথা মনে আছে, যেখানে আমরা রাতে খুব সস্তায়
চাপাতি এবং গরুর গোশ্ত ভুনা খেতাম, কিন্তু দোকানটা বেশি দিন টিকেনি। আরেকটা দোকান ছিল
রেজিস্ট্রার অফিসের পূবপাশের দেয়াল ঘেঁষে একচালা টিনের ঘরে। সেটা চলেছিল অনেক দিন।
ওখানে পাওয়া যেত চা এবং ডালপুরি। ডেপুটি রেজিস্ট্রার এলআর মল্লিকের আপিসে গিয়ে বসলেই
এক কাপ চা আর দু’টো ডালপুরি পাওনা হয়ে যেত। তিনি আমাকে খুব ¯েড়বহ করতেন আর আমি
ওই সুযোগটা নিতাম। ও’দিকে গেলেই কারণে অকারণে তাঁর আপিসে ঢুঁ মারতাম ডালপুরির
লোভে। সে ডালপুরির স্বাদ আজো আমার জিবে লেগে আছে! ওই এরিয়াতেই ছোট্ট একচালা টিনের
ঘরে রাস্তার পশ্চিমপাশে একটা পানের দোকানও ছিল। তার পণ্য সামগ্রীর মাঝে তিনটা জিনিসের
কথাই আমার মনে পড়ে - পানের খিলি, সিগারেট, ও কলা, কিন্তু আমার আকর্ষণ ছিল অন্য
জায়গায়। দোকানি ছেলেটার একটা ট্র্যানজিস্টারও ছিল, সারা দিন চলত। আমাদের বৈকালিক
হাঁটাহাঁটির সময় ট্র্যানজিস্টারে ভাল গান কিংবা খবর হলে আমরা তার দোকানের সামনে কিছুক্ষণ
জিরিয়ে নিতাম।
এখন কেমন জানি না, তবে সে সময়ে জাবির লেখাপড়াটাও ছিল একটু অন্য ধরণের। প্রতি বছরের
শেষে সে বছরের পরীক্ষাগুলোর সমাপনি হয়ে যেত (এ রকমই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেশন
জটের কারণে বাস্তবে তা হয়নি। আমাদের চার বছরের প্রোগ্রাম শেষ করতে লেগেছিল পাক্কা ছ’
বছর)। তৎকালীন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত তিন বছর শেষে একসাথে সম্মান পরীক্ষা দিতে হত
না। আরেকটা ব্যাপার ছিল, আমাদের প্রতিটা কোর্সে ৪০ শতাংশ নম্বর ছিল ক্লাস টিউটোরিয়লের
ওপর। এবং এ ৪০ শতাংশ পুরোপুরিই ছিল কোর্স শিক্ষকের হাতে। এতে করে নম্বর তোলা এবং
ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া তুলনামূলকভাবে একটু সহজ ছিল, অবশ্য কারো কারো জন্য বোধগম্য কারণে
কঠিনও ছিল। আরেকটা বিষয় ছিল, ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার সুযোগ পুরোবেলা থাকলেও, দিনের
শিক্ষা কার্যμম ছিল মাত্র আধাবেলার। ক্লাস শুরু হত সকাল আটটায় এবং শেষ হয়ে যেত বেলা
একটায়। সকালে ঢাকা থেকে প্রম বাস আসত আটটায়, দ্বিতীয়টা আসত ন’টায়। দুপুরে প্র ম বাস
ক্যাম্পাস ছেড়ে ঢাকা যেত একটায়, পরেরটা যেত দু’টায়। প্রতিদিন বেলা একটা বাজতে না
বাজতেই আমাদের ছুটি! আমরা হলে এসে নাওয়া-খাওয়া সেরে দরজা জানালা খুলে দিতাম লম্বা
ঘুম। দরজা-জানালা খোলা থাকায় দখিনা হাওয়া এমনভাবে খেলে যেত যে গরমে কোনো কষ্টই হত
না। আর বেলা দু’টোর পর গোটা ক্যাম্পাস হয়ে যেত বিরাণ মুলুক। অবশ্য বিজ্ঞান অনুষদের
ব্যাপারটা ছিল আলাদা - বিকেলেও তাদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, পরীক্ষা, ইত্যাদি চলত, তবে
লাইব্রেরি খোলা থাকত সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত।
আমরা এমন একটা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি যখন কম্পিউটার ছিল না, ইন্টারনেট
ছিল না, ডিজিট্যাল ক্যামেরা ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, এসএমএস ছিল না, এমন কী
১০
কপিয়িং মেশিনটা পর্যন্ত ছিল না। আমাদের লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বই-জার্নাল তো ছিলই না।
আমি ঢাকার পথে পথে পায়ে হেঁটে ঘামে ভিজে বিভিনড়ব লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে
বিভিনড়ব বই থেকে প্রয়োজনীয় অংশ হাতে লিখে নোট করে নিয়ে আসতাম। এতে করে আমার
অনেক সময় নষ্ট হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চিনেছিলাম ঢাকা শহরের নতুন নতুন অনেক রাস্তা এবং
জানাশোনাও হয়েছিল অনেক জাতের অনেক মানুষের সাথে। এমনি এক লাইব্রেরির পাঠাগারে
একজন মনের মানুষও পেয়েছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পেতে পেতেও আর পাওয়া হল না। যে
সব লাইব্রেরিতে ছিল আমার অবাধ যাতায়াত তার মধ্যে বলতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
বিআইডিএস, আমেরিকার কালচার্যাল সেন্টার, ভারতীয় হাই কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক, বিসিক, ও
ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরি।
ছাত্র থাকাকালীন সময়ে প্রস্তুতি থাকুক বা না থাকুক, পরীক্ষা এলেই কেন যেন একটা অজানা আতঙ্ক
আমাদের তাড়া করে বেড়াত। একদিন এমন হয়েছিল, ¯ড়বাতক সম্মান প্র ম বর্ষে মানি অ্যান্ড ব্যাঙ্কিং
ক্লাসের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা পেছাতে না পেরে আমরা সবাই ঠিক করেছিলাম পরীক্ষার দিন কেউ
ক্লাসে যাব না। করেছিলামও ঠিক তাই। এ ব্যাপারে একমত হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পরীক্ষা
বয়কটে সফল হয়ে আমরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘোরাঘুরি করছিলাম, আর দূর থেকে দেখছিলাম
স্যার কী করেন। ক্লাসরুমে কাউকে না পেয়ে তিনি করিডোরে এসে আমাদের খোঁজাখুঁজি
করছিলেন। স্যার ছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ইকবাল আহমেদ। ওই সময় স্যারের চেহারায় রাগের
চেয়ে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল ঢের বেশি। সেদিনকার কথা মনে পড়লে আজও আমার ভীষণ খারাপ
লাগে, মৃদু অপরাধবোধ আমাকে চেপে ধরে, কষ্ট দেয়! ওই দিনকার আনন্দ, অনুভূতি, ও
পাপবোধমাখা স্মৃতি আমার গোটা শিক্ষক জীবনে জমা হয়ে আছে একটা অমূল্য সম্বল হিসেবে!
যখনই ছেলেমেয়েরা আমার কাছে পরীক্ষা পেছানোর আবদার নিয়ে আসে, হউক যৌক্তিক, কী
অযৌক্তিক, আমার রাগ হয় না, বিরক্তিও আসে না, অসুবিধা তো না-ই। আমি সহজেই রাজি হয়ে
যাই। এত সহজে দাবি আদায়! ছাত্র-ছাত্রীরা ভাবতেই পারে না। মাঝে মাঝে আবদারকারীরাই
অবাক হয়ে যায়! বুঝতে পারে না এখানে আমার এত দূর্বলতা কেন। আমিও ‘গোপন কথাটা
রেখেছি গোপনে’। জীবন তো প্রায় পুরোটাই পার করে দিলাম। ক্লাসে কোনো দিন খুলে বলিনি
জাহাঙ্গীরনগরে সে দিনকার একযোগে ক্লাস ও পরীক্ষা কামাইর কাহিনিটা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়কার টেলিফোন সার্ভিসের কথা শুনলে এখন অনেকের হাসি
পাবে। গোটা ক্যাম্পাসে হাতে গোনা কয়েকটা টেলিফোন সেট ছিল। তারমধ্যে হলের প্রভোস্ট
আপিসে ছিল একটা, যেটা আমরা বিকেল বেলা ব্যবহার করতে পারতাম। ওই ফোন কী রকম ছিল
শুনবেন? এর কোনো ডায়াল ছিল না, এর কোনো নাম্বার ছিল না। সেটের সাথে লাগানো ছিল
গাড়ির উইন্ডোগ্লাস উঠা-নামা করার মত হ্যান্ডল। কল করতে গেলে হ্যান্ডসেট হাতে নিয়ে জোরসে
হ্যান্ডল ঘোরাতে হত চার-পাঁচ বার। তারপর আমাদের এক্সচেঞ্জ থেকে ক্ষীণ কন্ঠ ভেসে আসত,
১১
‘‘কাকে চাই?’’ ক্যাস্পাসের ভেতরে হলে নাম বলতে হত, আর বাইরে হলে নাম্বার দিতে হত।
তারপর ভাগ্য ভাল থাকলে লাইন পেতাম, না থাকলে নাই।
আমাদের কাছে জাবি জীবনের একটা বিশেষ উপজীব্য বিষয় ছিল বৈকালিক ভ্রমণ। আমরা দু’তিন
বন্ধু মিলে আড্ডায় আড্ডায় অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে বেড়াতাম। এ কাজে ক্যাম্পাসের ভেতর এবং
বাইরের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। ভেতরে বনে জঙ্গলে এলোপাথাড়ি সবদিকেই ছিল আমাদের
চলাচল। হাঁটতাম, বাইরেও - রাস্তার ওপারে ডেইরি ফার্মে, উত্তর দিকে বিশমাইলের পর
রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প ছাড়িয়ে জাতীয় স্মৃতি সৌধ পর্যন্ত। পূব দিকে লাল মাটির সিঅ্যান্ডবির কাঁচা
রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে বাসাইদ/দোসাইদ বাজার পর্যন্ত যেতাম। দক্ষিণ দিকে মিলিটারি খামার
পর্যন্ত ছিল আমাদের সীমানা। পশ্চিম দিকে যেতাম ক্যাম্পাস লাগোয়া গ্রামে, (ওই গ্রামের নামটা
এখন মনে করতে পারছি না)।
এখন আছে কিনা জানি না, তবে ১৯৭০-এর দশকে ক্যাম্পাসে ঢোঁড়া সাপের উপদ্রব ছিল খুব
বেশি। আমাদের বৈকালিক পদযাত্রায় সাপ মারা ছিল এক বিশেষ উত্তেজক কর্মযজ্ঞ। বিশেষ করে
গরমকালে চলতে ফিরতে যত্রতত্র ঢোঁড়ার সাথে আমাদের মোলাকাত হত। দেখলেই আমরা রাস্তা
থেকে ইট তুলে সাপের মাথাটা থেঁতলে শিল নোড়ায় মরিচ পিষার মত করে ফেলতাম। সাপের বাকি
ধড় রাস্তায়ই পড়ে থাকত, বৃষ্টি হলে পচে গলে যেত, খরা হলে শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে থাকত। যেগুলো
রাস্তা থেকে ছুড়ে ফেলে দিতাম, সেগুলো চিল ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে গাছের মগডালে বসে মজা করে
খেত।
গ্রীস্মকালে বৃক্ষরোপণ পক্ষের আগে বা পরে ক্যাম্পাসে আরেকটা কাজ হত। কিছু কিছু জায়গায়
আগাছা এত বাড় বাড়ত যে, একজন মানুষ ঢুকলে ঘাড়ের উপর ছাড়া নিচ দিক দেখা যেত না। সেই
জঙ্গল তখন হয়ে উঠত শিয়াল, নেউল, আর সাপের অভয়ারণ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর
জুন-জুলাই মাসে আগাছা কেটে সাফ করার জন্য ঠিকা কাজ দিয়ে দিতেন। ঠিকাদাররা গ্রাম থেকে
একসাথে দু’/তিন ডজন দিনমজুর নিয়ে আসত। তারা যখন সকালে লাইন ধরে কাজে আসত -