ভেনিসের গল্প
আবু এন এম ওয়াহিদ: আল্ভা পাভারিটো ইতালীর ভেনিসে অবস্থিত এক প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান এবং
একটা সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জার্নালের সম্পাদক। জার্নাল সম্পাদনা সূত্রে তাঁর সাথে আমার পরিচয় ঈ-
মেইল মারফত; কখনো দেখা হয়নি, এমন কি কথাও হয়নি। ঈ-মেইলে যোগাযোগ হয় মাঝে মাঝে, তবু
আমাদের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ট যে, আমরা দু’জন পরষ্পরকে প্রম নামেই সম্বোধন করে থাকি। বেশ কিছু
দিন নীরবতার পর, দু’ হাজার ন’ সালের গোড়ার দিকে হঠাৎ আল্ভার এক ঈ-মেইল বার্তা পেলাম।
লিখেছেন, তিনি তাঁর বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য একটা ওয়ার্কশপ করতে চান এবং ওয়ার্কশপ
আয়োজনের পুরো দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিতে পারলে খুব খুশি হবেন। শিগগির আমার মতামত জানতে
চেয়েছেন। ওয়ার্কশপটা হবে একদিনব্যাপী এবং আন্তর্জাতিক মানের। আর বিষয়বস্তু হবে “উনড়বয়ন অর্থনীতির
বিভিনড়ব দিক”। আমি সহ ছ’জন অর্থনীতিবিদ লিখিত গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করব এবং তাদের ওপর
প্রশেড়বাত্তর ও আলোচনা চলবে সারাদিন ধরে। আমাদের সবার বিমান ভাড়া, ভেনিসে দু’দিনের হোটেল, এবং
একটা সোশাল ডিনার বাবত যাবতীয় খরচ তিনিই দেবেন।
আল্ভার ঈ-মেইল পেয়ে এবং আমার ওপর তাঁর আস্থা দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হলাম! এ ধরণের
আয়োজন আমি আগে কখনো করিনি, তবু সাহসের সাথে দেরি না করেই কাজে লেগে গেলাম। প্রমে
প্রবন্ধের নির্দিষ্ট টপিক ঠিক করে বিভিনড়ব দেশে ছড়িয়ে থাকা আমার পরিচিত দশ বারো জন উনড়বয়ন বিশেষজ্ঞকে
দাওয়াত করলাম। তারপর সপ্তাহ দু’এক ঈ-মেইল চালাচালির পর, উপস্থাপকদের তালিকা চূড়ান্ত হল এভাবে
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউনিভার্সিটি অফ সিয়াট্লের মীনাক্ষী ঋষি এবং আমি; বাংলাদেশ থেকে ঢাকা
ইউনিভার্সিটির আইবিএ-ডিরেক্টার জিয়াউল হক মামুন এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন;
নিউজিল্যান্ডের ওকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রাশমী অরোরা; এবং সব শেষে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি
টেকনোলজি-মারার, ওয়ান মনসুর ওয়ান মাহ্মুদ।
সিদ্ধান্ত হল ওয়ার্কশপ হবে জুনের ২৫ তারিখ। জানাজানির জন্য আল্ভা ওয়ার্কশপের একটা রঙিন ফ্লায়ার
তৈরি করে তাঁর ইউনিভার্সিটি ওয়েব সাইটে পোস্ট করলেন এবং অনেকগুলো হার্ডকপি সারা ক্যাম্পাসে
সাকুর্ েলট করে দিলেন। আমরা প্রবন্ধ উপস্থাপকরা একদিন আগে গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাই। আমি ন্যাশভিল
থেকে ডেট্রোয়েট-অ্যামস্টার্ড্যাম হয়ে ভেনিস যাই। আমার কিছুক্ষণ আগে ড. মামুন ঢাকা থেকে হংকং এবং
রোম হয়ে ভেনিস আসেন। ঘন্টা দুয়েক পর অন্যরা বিভিনড়ব দিক থেকে এসে এমিরেটস-এর সরাসরি দুবাই-
ভেনিস ফ্লাইট ধরেন। সকল অংশগ্রহণকারী একত্র হওয়ার পর হোটেলের পথে রওয়ানা দেওয়ার আগেই
আমি আল্ভাকে ফোন করলাম। এয়ারপোর্টে এসে আমাদেরকে রিসিভ করতে পরেননি বলে তিনি দুঃখ
প্রকাশ করলেন এবং বলে দিলেন কিভাবে হোটেলে যেতে হবে। আরো বললেন, পরদিন সকাল আটটায়
এসে আমাদের সাথে দেখা করবেন এবং তারপর নিয়ে যাবেন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
২
আল্ভার কথামত আমরা সাত জন (মীনাক্ষীর সাথে আসা তাঁর স্বামীকে নিয়ে) একসাথে রওয়ানা দিলাম
আমাদের জন্য নির্ধারিত স্যান মার্কো স্কোয়ারের এক ঐতিহ্যবাহী হোটেলের উদ্দেশ্যে। ভেনিসের মার্কোপলো
এয়ারপোর্ট টার্মিন্যাল ছেড়ে আনুমানিক কোয়ার্টার মাইল পথ হেঁটে গিয়ে উঠলাম ওয়াটার ট্যাক্সিতে। রোদ
ঝলমল দুপুরে, খোলা বাতাস আর সাগরের গর্জন আমাদের মাঝে বইয়ে দিল উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা, ও আনন্দের
বন্যা - ফলে সহজেই দূর হয়ে গেল দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের সব ক্লান্তি। বড় বড় ঢেউয়ের বাড়ি খেয়ে পানিতে
ওয়াটার ট্যাক্সির নাচন আমাদের মনকেও দোলা দিচ্ছিল বারবার। মাথার ওপর গাঙচিলের ওড়াউড়ি আর
কিচিরমিচির ডাক শুনে মনে হচ্ছিল আমরা ভর বরষায় বাংলাদেশের কোনো হাওর পাড়ি দিচ্ছি। হাওয়ায়
ওড়ানো পাল আর দাঁড়ের বদলে ইঞ্জিন - তফাৎটা শুধু এটুকুই। এভাবে হৈ হুল্লোড় করে, মনে হল চল্লিশ
মিনিটের পথ মাত্র দশ মিনিটে পেরিয়ে এলাম। তখন বেলা প্রায় তিনটা। কড়া রোদের মধ্যে এসে নামলাম
ঐতিহাসিক স্যান মার্কো স্কোয়ারে। শান বাঁধানো বিরাট উন্মুক্ত চত্তর। আশপাশ তাকিয়ে দেখি বিল্ডিংগুলো
সব পুরনো, এতই পুরনো যেন হাজার বছর আগের বানানো ইমারত, কিন্তু হলে কী হবে, একটু গভীর দৃষ্টি
ফেললে দালানকোঠার অবয়বে খান্দানি খান্দানি একটা ভাব স্পষ্ট ফুটে ওঠে। ঠিকানা দেখে সবাই মিলে
হেঁটে হেঁটে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিরাট এক বাণিজ্যিক ভবনের পেছনে, ছোট্ট খালের ওপারে গিয়ে বের
করলাম লুকিয়ে থাকা হোটেল।
হোটেলটা ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা গোটা ইউরোপ মহাদেশের পুরনো হোটেলদের
অন্যতম, কারো কারো মতে, সবচেয়ে পুরাতন! অতি প্রাচীন কালে ইউরোপীয়ান কাওবয়রা ঘোড়া নিয়ে
ওপথে চলাচল করত, এবং ওই হোটেলে রাত কাটাত। অনেক নামি দামি কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, ও মিউজিক
কম্পোজার বিভিনড়ব সময়ে এ হোটেলের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। ইংল্যন্ডের প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন
সময়ে স্যার উইনস্টন চার্চিলও এ হোটেলে একবার রাত কাটিয়েছেন। আমরা হোটেলে চেক ইন করে গোসল
সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে দল বেঁধে সবাই বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। আমি ভেনিসে আগে আরেকবার গিয়েছি
ফ্যামিলি ভ্যাকেশনে, তবে স্যান মার্কো স্কোয়ার দেখিনি। বাকি সবার এটাই প্রম ভেনিস সফর। সারা
বিকেল ঘোরাঘুরি করে খাওয়া দাওয়া সেরে সন্ধ্যার দিকে হোটেলে ফিরে গেলাম। ক্লান্তি আর অবসাদে রাতে
ঘুম হলো খুব ভালো। সকালে উঠে তৈরি হয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে নাস্তা খেয়ে আটটার আগেই আমরা
সবাই আল্ভার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলাম। ঘড়িতে আটটা বাজার সাথে সাথে ওয়াটার ট্যাক্সি নিয়ে তিনি এসে
হাজির। ভাটির টানে পানি নিচে থাকায়, আগের দিন আমরা ওয়াটার ট্যাক্সি থেকে দূরে নেমে হেঁটে এসেছি।
কিন্তু সেদিন সকালে জোয়ার ছিলো বলে ওয়াটার ট্যাক্সি এসে থামল একেবারে হোটেলের লবির খালের
দিকের পেছন দরজায়। স্যান মার্কো স্কোয়ারে চাকাওয়ালা কোনো যান চলাচল করে না। যাতায়াতের বাহন,
জলে তিনখানা, আর স্থলে মাত্র একখানা। খালে, অর্থাৎ পানিতে বৈঠা বাওয়া কাঠের গন্ডোলা, ওয়াটার
ট্যাক্সি, অথবা ওয়াটার বাস ছাড়া গত্যন্তর নেই, আর ডাঙায় একমাত্র ভরসা আপন পদযুগল। স্যান মার্কোতে
ঢাকার মত রিক্সা চললে ভ্রমণটা হতে পারত অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ, চমকপ্রদ, ও আনন্দদায়ক!
৩
ওয়াটার ট্যাক্সি করে আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা হোটেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে পৌঁছলাম।
গ্র্যান্ড ক্যানেলের পচা পানির গন্ধ, দমকা হাওয়া, ঝিরঝির বৃষ্টি, ছোট ছোট ঢেউ, আর নাগরিক জীবনের
ব্যস্ততা, পানির ওপর ট্যাক্সি চড়াকে করেছিলো বিশেষভাবে উপভোগ্য। ক্যাম্পাসে গিয়ে কেউ কেউ ঘুরতে
বেরোলেন এদিক ওদিক, আর অন্যরা আল্ভার সাথে কফি শপে গিয়ে চা-কফি খেলেন। আধা ঘন্টার মধ্যে
সবাই আবার একত্র হ’লাম। তারপর শুরু হল ওয়ার্কশপ। চলল সারাদিন দু’সেশন জুড়ে। মাঝখানে এক
ঘন্টার লাঞ্চ বিরতি। লাঞ্চে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন ছিল দেদার। মাছ, গোশ্ত, সবজি, সালাদ,
ফলফলাদি, ডিম, রুটি, নুডুল্স, ম্যাকারনি, ল্যাজানিয়া, সোডা, তার ওপর হরেক রকম মিষ্টি জাতীয়
খাবারের ছড়াছড়ি। ‘‘ওয়ার্কশপের প্রত্যেকটা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপনা ছিল চমৎকার!’’ এটা
আমার কথা নয় - বলেছেন আল্ভা। প্রশড়ব এবং আলোচনা হয়েছিলো বিস্তর। ওয়ার্কশপ শেষে ওয়াটার ট্যাক্সি
করে আল্ভা আমাদেরকে ফের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন “তোমরা
এখন বিশ্রাম নাও, আমি সন্ধ্যা সাতটায় এসে তোমাদেরকে ডিনারে নিয়ে যাব”।
সন্ধ্যায় ঠিক সময়মত তিনি এসে হাজির। হোটেল থেকে বেরিয়ে সরু গলিপথে হাঁটা। আল্ভা আগে আগে
আর আমরা লাইন ধরে তাঁর পেছনে আর্মি কলামের মত চলছি মার্চ করে। একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে খাল
পেরিয়ে প্রায় অধা মাইল পথ হেঁটে এসে উঠলাম ভেনিসের স্যান মার্কো স্কোয়ারের এক অতি পুরনো
ঐতিহ্যবাহী রেস্টুর্যান্টে। ভেতরে ঢুকেই, রেস্টুর্যান্ট, তার সাজসজ্জা, এবং পরিবেশ দেখে সহজেই আঁচ
করতে পেরেছিলাম যে, এর রূপ-মাধুর্য ও আভিজাত্য যেন গা গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে
পড়ছে! ঘরটা বেশি বড় নয়, মাঝখানে একটা মাঝারি আকারের হলঘর আছে। এটাই রেস্টুর্যান্টের মূল
কামরা। তার তিন পাশে আরও রয়েছে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা কোঠা। আমাদের বসার ব্যবস্থা হলো মূল
কামরায় সুন্দর করে সাজানো একটা লম্বা টেবিলে। বসার সাথে সাথে ম্যেনু নিয়ে এলেন এক তরুণ ওয়েটার
- নাম রফিক - প্রবাসী বাংলাদেশি। রফিক আমাদের দেখেই হতবাক! মনে করেছেন, পথ ভুলে আমরা
এসে পড়েছি তার অভিজাত খাবার দোকানে, কারণ সচরাচর আমাদের মত বাদামি চামড়ার লোকজন
ওখানে খেতে যায় না, যেতে চাইলেও পারে না, দামের কারণে। রফিক প্রমেই বলল, “আপনারা যে
এখানে খেতে এসেছেন, জানেন দাম কত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কত?” রফিকের কাটা কাটা উত্তর,
“মাথা পিছু কমছে কম এক শ’ ইউরো তো পড়বেই”। আমি আল্ভাকে দেখিয়ে বললাম, “চিন্তার কোনো
কারণ নেই, উনি আমাদের নিয়ে এসেছেন’’। আল্ভার সাথে আমাদেরকে দেখে, রফিকের বিস্ময় বেড়ে
গেলো দ্বিগুণ। এবার মোলায়েম সুরে রফিক জিজ্ঞেস করল “আপনি উনাকে চেনেন কী করে?” আমি
বললাম, “উনি আমার বন্ধু”। “তা কী করে হয়?” রফিকের আশ্চর্যবোধক প্রশড়ব! পুরো ঘটনা খুলে বলার
পর, রফিক বুঝতে পারল, কেন ও কিভাবে আমরা তার রেস্টুরেন্টে হাজির হয়েছিলাম ওই রাতে। তারপর
রফিকের আবদার , “যাবার আগে আপনার সাথে আমার একটু প্রাইভেট কথা আছে”।
শুরু হল ডিনার - কোর্সের পর কোর্স - প্রধানতঃ সি ফুড - ওয়েস্টার, মাছ, মাছের ডিম, কোনোটা স্টিম্ড্,
কোনোটা আধা রানড়বা করা, কোনোটা রানড়ব্া করা। এত দামি দামি খাবার, কিন্তু খেতে পারছি না কিছুই, সি
ফুডের কাঁচা কাঁচা গন্ধে আমার বমি বমি লাগছিল! অন্যদের অবস্থাও দেখলাম তথৈবচ। খাব কি, বাচ্চাদের
মত ছুরি-কাঁটা নিয়ে খালি ঠুংঠাং নাড়াচাড়াই করছি, খেলছি। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি
৪
করছি। আমাদের মত বাঙালদের অস্বস্তি দেখে রফিক মূল অর্ডারের বাইরে গিয়ে নিয়ে আসল এক বাস্কেট
পটেটো চিপ্স্। সবাই পেট ভরালাম সস্তা পদের আলু খেয়ে। শেষে অবশ্য ডেজার্টটা খুব ভাল লেগেছিল!
সে রাতে আমাদের খাওয়া খাওয়া অভিনয় চলেছিল ঘন্টা দেড়েক ধরে। এর ফাঁকে ফাঁকে রফিকের সাথে
আমার কথাও হল বিস্তর। তার কাছ থেকে আল্ভার না জানা অনেক কথা জানতে পারলাম। রফিক বলল,
“এ রেস্টুর্যান্টের মালিক আল্ভার বাবা। আল্ভা তাঁর বাবার একমাত্র ছেলে। আল্ভা পি.এইচ.ডি. -
অর্থনীতিতে, তার বাবাও পি.এইচ.ডি.- পরিসংখ্যানে। আল্ভার বাবা একজন অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী,
ভেনিসের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। আপনারা যে হোটেলে উঠেছেন, তার মালিকও আল্ভার বাবা”। রফিক
আরো জানাল, “ভেনিসের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আলভার বাবার ছোট বড় অনেক হোটেল এবং
অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। তাছাড়া ভেনিস স্টক মর্কেটে রয়েছে তাঁর বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগ। বড়লোক বাবার
ছেলে আল্ভার জীবন অনেকটাই ছনড়বছাড়া! মাত্র ক’দিন হল, আল্ভার স্ত্রী তাঁকে ফেলে চলে গেছেন।
আল্ভার জীবন বড়ই নিঃসঙ্গ, একাকী, দুঃখেরও; সবকিছু থেকেও যেন তাঁর কিছুই নেই! যতক্ষণ জেগে
থাকেন, একটার পর একটা সিগারেট খেতেই থাকেন। তাঁর চেহারা দেখলে মনে হবে আগুনে পোড়া,
কাপড়চোপড়, বেশভুষায় অবিশ্বাস্য রকমে সাদাসিধে। বাংলাদেশের প্রতি আল্ভার ভীষণ টান। তিনি
বাংলাদেশে কয়েকটা পরিবার চালান, নিয়মিত টাকা পাঠান। বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক তাঁর কাছে
বিভিনড়ব ধরণের ছবি পাঠায় ও চিঠি লিখে। বাংলা চিঠিগুলো আমিই পড়ে দেই”। সবশেষে রফিক নিজের
কথাটা পাড়ল, সে সদ্য বিয়ে করেছে। ভেনিসে বউ আনতে চায়। আল্ভাকে যেন অনুরোধ করি বেতন
বাড়াবার জন্য।
ডিনার আর রফিকের কথা শেষ হলে আল্ভার সাথে আড্ডা চলল কিছুক্ষণ। আল্ভার কথায় জানতে
পারলাম, গেল শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রতি রাতে ওই রেস্টুর্যান্টের মূল কামরায় আড্ডা বসত ভেনিস তথা
ইতালীর বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, ও চিত্র শিল্পীদের। সফররত বিদেশি শিল্পী সাহিত্যিকরাও এখানে প্রায়ই
এসে ভীড় জমাতেন, আড্ডা বসাতেন। এ রেস্টুর্যান্টের ডিনার টেবিলে বসে, গল্পের ছলে, শিল্পীরা আঁকতেন
কালজয়ী স্কেচ্ এবং কবিরা এখানে বসেই লিখতেন অমর কাব্য গাঁথা। ওই সময়কার কিছু কিছু বাঁধাই করা
স্কেচ্ এখনো ঝুলছে রেস্টুর্যান্টের দেয়ালে। রেস্টুর্যান্টের মূল কামরার দেয়ালে দুটো বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখে
যতটা না অভিভূত ও মুগ্ধ হয়েছি, তার চেয়ে অবাক হয়েছি ঢের বেশি! প্রম চিত্রটার বর্ণনা এরূপ - একজন
মধ্য বয়সী নারী শাড়ি পরে, একখানা ঝাড়– হাতে নিয়ে খালি পায়ে অনেক কষ্টে হাঁটছেন অ্যাবড়ো থ্যাবড়ো
পাথর আর কঙ্করের ওপর দিয়ে। সম্ভবত তিনি একজন ঝাড়–দারনি। তাঁর মুখাবয়ব পাতলা কাপড়ের আবরণে
ঢাকা। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ছবিটা একটু ভিনড়ব - একজন অল্পবয়সী নারী- তিনিও শাড়ি পরা,
ঘোমটা মাথায়। নামাজ শেষে জায়নামাজের ওপর বসে কেবলামুখী হয়ে দু’হাত তুলে মোনাজাত করছেন।
তাঁরও কোনো পরিচয় ঠাহর করা গেলো না, চেহারাটা লুকিয়ে ছিল পাতলা কাপড়ের আবরণে। ইটালীর
ভেনিস শহরের স্যান মার্কো স্কোয়ারের অতি অভিজাত এ রেস্টুর্যান্টে, কী করে এলো ছবি দু’খানা? কে-ই
বা তাদের ¯্রষ্টা? কী-ই বা তাদের মর্মবাণী? কিছুই বুঝতে পারলাম না! রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল, আধা
রানড়বা, আধা কাঁচা সি-ফুড খেয়ে আমাদের প্রায় সবারই পেট বিগড়ে বিগড়ে অবস্থা, তাই আল্ভাকেও
জিজ্ঞেস করা হলো না আর্ট দু’খানার কথা। আল্ভার সাথে রেস্টুর্যান্টে গিয়েছিলাম যে পরিমাণ পেটের
৫
খিদে নিয়ে, ফিরে এলাম তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মনের খিদে লয়ে। এ খিদে মেটাতে গেলে আবার যেতে
হবে ভেনিসের সে-ই রেস্টুর্যান্টের মূল কামরায়, আল্ভাকে সাথে করে!
(পুনশ্চ: ওয়ার্কশপ সেরে বাড়ি ফিরে আসার পর, লেনদেন সংদক্লান্ত ব্যাপারে আল্ভার সাথে আমার
যোগাযোগ হয়েছে আরো কয়েক দফা। তারপর দেখতে দেখতে গড়িয়ে গেছে চার বছরেরও বেশি! আল্ভার
কোনো খবর নেই, তাঁর সাথে যোগাযোগও নেই! দু’ হাজার চৌদ্দ সালের জানুয়ারি মাসে, সেইন্ট লুশায়
আরেক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে লাঞ্চ টেবিলে পরিচয় হল এক সুন্দরী তরুণীর সাথে। তিনি এসেছেন
ভেনিস থেকে, পড়ান সে-ই বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আমরা দু’ হাজার ন’ সালে গিয়েছিলাম ওয়ার্কশপ
করতে। কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্ভাকে চেনেন কিনা। বললেন, ‘‘হ্যাঁ’’। আল্ভা কেমন
আছেন? জানতে চাইলে, মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম তরুণীর চেহারাটা বদলে গেল! তাঁর বুকের কথা মুখে
আনার আগেই আমি বুঝে গেলাম, আল্ভা আর নেই! What a sad coincidence and what a
sad surprise! আপনাদের জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে বটে। আমার এ লেখায়, আল্ভার একান্ত
ব্যক্তিগত কিছু কথা উঠে আসায়, ভেনিসের বিশ্ববিদ্যালয়, স্যান মার্কো স্কোয়ারের হোটেল, রেস্টুর্যান্ট, এবং
আল্ভার আসল নাম আমি ইচ্ছে করে গোপন রেখেছি, কাজটা কি ঠিক করলাম?)
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
৯ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস
�