ওয়াকিল আহমদ : ঝালকাঠির তারুলি গ্রামের ‘শিকদারবাড়ি’র কথা স্থানীয় লোকজন এককথায় জানে। শিকদারবাড়ির কোনো এক পূর্বপুরুষ বাংলার নবাবের রাজস্ব বিভাগের ‘শিকদার’ অর্থাৎ রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী ছিলেন। বাংলার রাষ্ট্রক্ষমতা ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে গেলে তিনিও সঙ্গের কিছু পদস্থ কর্মচারী বরিশালের ঝালকাঠিতে এসে বসবাস শুরু করেন।
তারুলিতে শিকদারবাড়ির গোড়াপত্তন ঐ সময় থেকে শুরু হয়। ইংরেজ আমলের দু’শো বছর নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে, হয়তো তারুলি গ্রামেও তার ছাপ পড়েছে, কিন্তু শিকদারবাড়ি তার ঐতিহ্য হারায়নি। বিশেষত শিক্ষার আলোটি কখনও নেভেনি। যুগের চাহিদা অনুযায়ী এ পরিবার আরবি-ফারসি, ইংরেজি, বাংলা শিক্ষালাভ করেছে, যার ধারাবাহিকতায় ঐ পরিবারে আধুনিক শিক্ষা আজও বহাল রয়েছে।
ঢাকার বাংলাবাজারস্থ ‘গতিধারা’ নামক একটি প্রকাশনা-সংস্থার স্বত্বাধিকারী সিকদার আবুল বাশার তারুলি গ্রামের এই পরিবারের একজন তরুণ, উৎসাহী, উদ্যোগী ও জ্ঞানানুরাগী সন্তান (জন্ম : ১৯৬৫)। গ্রন্থ-প্রকাশনা সূত্রেই আবুল বাশারের সাথে আমার পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা।
তিনি ২০০১ সালে ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’ নামে আমার গ্রন্থখানি প্রথম প্রকাশ করেন। এরপর থেকে ‘চাকা’ আর থামেনি। আজ অবধি আমার ছোট-বড় প্রায় ২০খানি গ্রন্থ তিনি ঐ সংস্থাা থেকে প্রকাশ করেছেন। এখনও দুইখানি পাণ্ডুলিপি তার প্রেসে প্রকাশনার অপেক্ষায় রয়েছে। গ্রন্থ-প্রকাশনার ক্ষেত্রে তার যত্ন, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি।
শুধু আমার গ্রন্থের ক্ষেত্রে নয়, অন্য অনেক লেখকের গ্রন্থ-প্রকাশনাতেও তিনি একই শ্রম, সতর্কতা ও যত্নের পরিচয় দিয়েছেন। অন্য কথায়, গ্রন্থ-প্রকাশনাকে তিনি একটি শিল্প হিসাবে দেখে থাকেন এবং কাগজ, প্রিন্টিং, প্রচ্ছদ, বাঁধাই ইত্যাদির সমন্বয়ে মানসম্মত ও রুচিসম্পন্ন করে পাঠকের হাতে তুলে ধরার প্রয়াস পান।
আবুল বাশার একজন প্রচ্ছদশিল্পীও বটে। আধুনিক প্রযুক্তি কম্পিউটারকে ব্যবহার করে তিনি মনোরম ও সুশোভন প্রচ্ছদ তৈরি করে থাকেন। এক্ষেত্রে তার অন্তর্লোকে একটি শিল্পীমন কাজ করে থাকে। শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পী রূপে তিনি ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র’ থেকে কয়েকবার পুরস্কারও লাভ করেছেন। আর এখানেই অন্য অনেক প্রকাশকের তুলনায় তিনি স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের দাবি করতে পারেন।
সিকদার আবুল বাশার নবীন-প্রবীণ সকল শ্রেণির লেখকের গ্রন্থ প্রকাশ করে থাকেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাসের মতো সৃজনশীল গ্রন্থ থেকে শুরু করে উচ্চমননশীল গবেষণাগ্রন্থ, ইতিহাস ও আলোচনা-পুস্তক, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি সব ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ করে লেখকদের উৎসাহিত করেন।
তবে গ্রন্থ-নির্বাচনে তিনি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য- লোকজ সংস্কৃতির প্রতি অধিক প্রীতি ও অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। পাঠককে ইতিহাস সচেতন করে তোলার মনোভাব থেকে তিনি পূর্বপ্রকাশিত, কিন্তু বর্তমানে দুর্লভ বিভিন্ন জেলার ইতিহাসগ্রন্থগুলি পুনর্মূদ্রণ করে প্রকাশ করেছেন। এর জন্য তিনি ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা ভাবেন নি, কারণ গ্রন্থগুলি জনপ্রিয় উপন্যাস-গল্পের মতো বিক্রয় হবে না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
গতিধারার প্রকাশনা-তালিকায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু আঞ্চলিক ইতিহাসগ্রন্থ স্থান পেয়েছে। এখানেও ব্যবসায়িক স্বার্থ অপেক্ষা তিনি স্বাধীনতা-প্রীতি ও নৈতিক দায়িত্বকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
সিকদার আবুল বাশার স্বয়ং লেখকের ভূমিকাও পালন করে চলেছেন। ইতোমধ্যে তার রচিত ও সংকলিত কয়েকখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঝালকাঠি জেলার ইতিহাস’ (২০০৮) মন কাড়ার মতো দৃষ্টিনন্দন একখানি মৌলিক গ্রন্থ। তিনি ঝানু গবেষকের মতো জটিল যুক্তি-তর্কের মধ্যে প্রবেশ না করে প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত অবলম্বনে জেলার ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
আধুনিক যুগের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিত্ব এবং লোকসংস্কৃতি-লোকনাট্য অধ্যায়গুলি রচনায় তিনি মাঠপর্যায়ের গবেষকের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। একাডেমিক গবেষকের কাছে তথ্যগুলি মৌলিক উৎস হিসাবে কাজ করবে।
সিকদার আবুল বাশারকে আমি সত্যবাদী, স্পষ্টবাদী ও প্রতিবাদী ব্যক্তি হিসাবে জানি। স্পষ্টবাদিতা ও প্রতিবাদীচেতনার জন্য অনেক সময় তিনি নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন। তোষামোদপ্রিয়তাকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন।
ব্যবসায়িক স্বার্থেও তিনি কোথাও আপোষ করেন না। তার তীক্ষ্ন ও অনুসন্ধানী দুটি চোখ প্রমাণ করে, তিনি নীরবকর্মী হয়ে থাকতে চান না, নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন, আর সুশ্রী জীবন গড়ারস্বপ্ন দেখেন।
লেখক: ফোকলোরবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/মাহফুজ সাদি/সৈকত