বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬, ০৯:৩২:২৭

রসগোল্লার রস ও মালিকানার লড়াই

রসগোল্লার রস ও মালিকানার লড়াই

আবু এন এম ওয়াহিদ: দু’হাজার পনেরো সালের শেষের দিকে ঢাকার কোনো এক সংবাদপত্রে পড়েছিলাম এক অভিনব বিতর্কের খবর। উপমহাদেশের বিখ্যাত মিষ্টিদ্রব্য রসগোল্লা প্র ম কোথায় বানানো হয়েছিল তা নিয়ে রীতিমত জমে উঠেছিল সে বিতর্ক। পশ্চিম বঙ্গের দাবি, নবীন চন্দ্র দাশ ১৮৬৮ সালে তার কলকাতার বাগবাজারের দোকানে রসগোল্লার উদ্ভাবন করেন, আর তাই তাঁকে বলা হয় 'Columbus of Roshogolla'। নবীন চন্দ্রর দাশ-এর ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ-এর (কেসি দাশ) মিষ্টির দোকান এখনো কলকাতায় চালু আছে। পশ্চিম বঙ্গের বক্তব্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে উড়িষ্যা বলছে, তারও অনেক আগে এই সুস্বাদু নরম সাদা বলটি আবিষ্কৃত হয়েছে পুরীর জগনড়বাথ মন্দিরে। সময়টা নির্দিষ্ট করে কেউ  জানে না, কারো মতে ৩ শ’, কারো মতে ৯ শ’, আবার কারো মতে ১৫ শ’ বছর আগে। এতো সব মুখরোচক খবর দেখার পর এ নিয়ে বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে একদিন দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু সে আলোচনায় আমরা
রসগোল্লার ইতিহাসচর্চা করিনি, কথা বলেছিলাম আমাদের সামাজিক ইতিহাসে রসগোল্লার অবস্থান, গুরুত্ব, ও তার তাৎপর্য নিয়ে। এভাবে রসগোল্লার রসালো


বিতর্ক পড়লাম, এ নিয়ে কিছুটা ভাবলাম, কথাও বললাম, তথাপি এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লেখার কোনো তাগিদ আমি অনুভব করিনি। তারও পাঁচ-ছ’মাস পরে, আবার দেখলাম রসগোল্লা এসে গোল বাঁধিয়েছে সেই পত্রিকার পাতায়। এবার সে বিতর্ক আর নিছক বিতর্ক নয়, শুরু হয়েছে পুরোদমে আইনী লড়াই। পশ্চিম বঙ্গ এবং উড়িষ্যার দুই মূখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে মমতা ব্যানার্জী এবং নবীন পাটনায়ক এ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। উড়িষ্যার রাজ্য-সরকার চেনড়বাই আদালতে রসগোল্লার জন্য জিআই (Geographical Indicator) পিটিশন দাখিল করেছে। তারপর মমতা ব্যানার্জী একই ধরণের দরখাস্ত জমা দিতে তার অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। মমতা মামলায় জিতলে, আসছে রাজ্য নির্বাচনে পশ্চিম বঙ্গের গৌরব ধরে রাখার জন্য তিনি
রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পাবেন বলে অনেকে মনে করছেন। আবার তিনি হেরে গেলেও মামলাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে অন্যভাবে কাজে লাগাতে পারবেন। অর্থাৎ তিনি পশ্চিম বঙ্গের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী লড়াকু নেত্রী হিসেবে নিজেকে জাহির করার অজুহাতখানা পেয়ে যাবেন। উড়িষ্যার মামলা-বিবেচনায় রাজনীতি আছে কিনা সে ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিৎ নই, আর মামলায় হার-জিত যারই হোক, রসগোল্লার জন্মরহস্যের চূড়ান্ত ফায়সালা এখন আসবে ভারতীয় আদালত থেকে। এ খবরটিও আমার নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে বটে, কিন্তু খবরের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে এ নিয়ে এর চেয়ে বেশি জানতেও ইচ্ছে হয়নি আমার। এর পর মাত্র সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতে জানলাম রসগোল্লার রস ভারত বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। রসগোল্লার মালিকানা নিয়ে বিবিসি রেডিও তাদের জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান ''The News Hour''-এ একটি বিশদ রিপোর্ট প্রচার করেছে। রিপোর্টটি আরো লাখো মানুষের সাথে আমিও শুনেছি। এ কাজের জন্য তাদের সাংবাদিক স্বয়ং ভারতে গিয়েছেন, সশরীরে পুরী এবং কলকাতা সফর করেছেন, সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন, অনেক তথ্য-উপাত্তে চোখ বুলিয়েছেন।


তারপর সংবাদভাষ্যটি তৈরি করে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ভারত থেকেই ডেস্পাচ করেছেন। ভারতের রসগোল্লা বিতর্কে বিবিসির উৎসাহ দেখে আমি এক দিকে অবাক হলাম এবং আরেক দিকে রসগোল্লা বিষয়ে দু’-কলম লিখতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম, যদিও আজকালকার ডিজিট্যাল যুগে লেখালেখিতে কলম লাগে না, কালিরও দরকার পড়ে না। লিখতে যখন বসলাম তখন দেখি রসগোল্লা সম্বন্ধে এ কথা সে কথা নানান কথা এলোমেলোভাবে আমার মনের মাঝে এসে ভীড় করছে। এই রসালো মিষ্টি খাবারটা যেখানেই আবিষ্কার হোক না কেন যুগ যুগ ধরে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও ধর্মীয় জীবনে একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। কারো কোনো সুসংবাদ থাকলে, অর্থাৎ পরীক্ষা পাশ করলে, চাকরি পেলে,
নির্বাচনে অথবা খেলায় জিতলে, ঘরে নতুন মুখ এলে; বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়- স্বজনদের বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যেতে হয়। আর মিষ্টির প্রধান আকর্ষণ রসগোল্লা।
বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে খালি হাতে আসেন না, ফলমূলের সাথে দৈ-মিষ্টিও হাতে থাকে। দাওয়াত-জিয়াফতে মেহমানদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দোয়া-দুরুদের শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। সিলেট অঞ্চলে এক সময় এ রেওয়াজও চালু ছিল যে, প্রতিবছর রোজার সময় মেয়ের বাড়িতে অন্তত একদিন ইফতারি দেওয়া হতো এবং এতে মিষ্টি অবশ্যই থাকতো। আবার মেয়ে যখন সন্তান সম্ভবা হতো তখনও নানা জাতীয় খাবার পাঠানো হতো। তাতেও হালুয়া-রুটি, পিঠা-পুলির সঙ্গে কখনো কখনো মিষ্টিও থাকতো। আর মিষ্টির রাজা যে রসগোল্লা সেটা কে না জানে। সঠিক জানি না, হয়তো বা এসব সামাজিকতা এখনো চালু আছে। বাংলাদেশে রসগোল্লার সবচেয়ে বড় ব্যবহার হয় বিয়ে-উৎসবে। বড়লোক কিংবা স্বচ্ছল হলে তো কথাই নেই, এমন কী মধ্য এবং নিন্ম মধ্যবিত্তের বাড়িতেও মিষ্টি ছাড়া বিয়ে-শাদীর কথা চিন্তাই করা যায় না। আমার ছোটবেলায়


এমন কথা অহরহ শুনেছি, কেউ না কেউ কোনো ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েকে দেখে বলছেন, ‘‘তুমি জল্দি জল্দি বড় হও, আমরা তোমার বিয়ের মিঠাই খাব’’। আর মিঠাই মানে ছানার মিঠাই, মিঠাই মানে রসগোল্লা। সে যুগে বিয়ের কথা পাকাপাকির শেষ পর্যায়ে এসে কনে পক্ষের দু’টো দাবি নিয়ে প্রায়ই কঠিন দর কষাকষি হতো। প্র মত, বরপক্ষ কত টাকা দেন-মোহরে রাজি হবে এবং দ্বিতীয়ত, বিয়ের দিন কত মণ মিষ্টি নিয়ে আসবে? তার মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে রসগোল্লার পরিমাণটা নির্দিষ্ট করা থাকতো। এতে ব্যত্যয় হলে রীতিমত ফাটাফাটি অবস্থা। আমার এক চাচার কাছে শুনেছি, আমার জন্মের আগে আমার এক ফুপুর বিয়েতে মিষ্টি কম আনার কারণে নাকি বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সিলেট অঞ্চলে বিয়ের মিঠাই তালিকায় রসগোল্লা ছাড়াও আরো দুই পদ থাকতো, জিলেপি এবং নিমকি। মিষ্টির ফর্দে রসগোল্লা ও জিলেপির সাথে নিমকি কী করে যুক্ত হল, সে নিয়ে অনেক ভেবেছি, কোনো হদিস পাইনি।
আপনাদের কারো জানা থাকলে অনুগ্রহ করে আমার সাথে শেয়ার করবেন। ছোটবেলা দেখেছি, বিয়ের দিন আমাদের বাড়িতে একটা রেওয়াজ ছিল, হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে গ্রামের সবাইকে লাইন ধরে বসিয়ে বরপক্ষের আনা মিষ্টির তিনপদই খাওয়ানো হতো। বিয়ে এবং মিঠাই খাওয়ার কথা উঠলোই যখন তখন আমার বালকবেলার একটা মজার স্মৃতির কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমি তখন ক্লাস ফোরে কি ফাইভে পড়ি। আমার মেজো ফুপুর বিয়ে হচ্ছে। সেটা ছিল ফুপুর দ্বিতীয় বিয়ে এবং ফুপার যেমন বয়স ছিল বেশি তেমনি তিনি ছিলেন খুব স্বচ্ছল এবং দিল-দরাজ একজন ব্যবসায়ী। বিয়ের দিন মিষ্টি এনেছিলেন বেহিসাব। ওই দিন সকাল থেকেই আমরা ছেলেমেয়েরা সব সেজেগুজে হৈহৈ রৈরৈ করে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছি, পুকুরপাড়ে যাচ্ছি, আসছি, আর খুশির বন্যায় ভাসছি, ভাবছি বর পক্ষ আসছে না কেন। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হয় হয়, তখন জানা গেল বাস থেকে নেমে লাইন ধরে
বরযাত্রীরা আমাদের বাড়ির দিকে আসছেন। যখন বাড়িতে এসে উঠছেন তখন গেট ধরা হয়েছে, দীঘির পাড়ে পটকা ফুটছে, সবার নজর ওইসব দিকে, কিন্তু


আমার চোখ অন্য দিকে। আমি মিষ্টির হাঁড়িগুলোর গতিপথ অনুসরণ করছি। মেজোচাচা ভারবাহী লোকগুলোকে পথ দেখিয়ে ভেতরবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন - পশ্চিমের ঘরের দক্ষিণের কোঠায়। তার পাশের রুমেই দাদী তাঁর বিছানায় শুয়ে বসে দোয়া-দুরুদ পড়তেন। সে দিন আমার একটাই মতলব ছিল, চুরি করে পেট ভরে আসুদা হয়ে রসগোল্লা খাওয়া। এ কাজে একা সাহস না করে যতদূর মনে পড়ে, সঙ্গে জুটালাম, সমবয়সী ফুপাতো ভাই ও বন্ধু মামুন ভাইয়াকে। দু’তিনবার ঘোরাঘুরির পর পয়লা মওকাতেই দুজন কায়দা করে ঢুকে পড়লাম মিঠাইর ঘরে। ওই ঘরের ঠিক পেছনে ছিল বড় বড় ঝাঁকড়া দু’টো আমগাছ। গাছগুলোর জন্য দিনের বেলায়ও বাইরে থেকে ওই রুমের ভেতর আলো ঢোকার খুব একটা সুযোগ ছিল
না। তার ওপর ঘরের দরজা জানালা সব ছিল নিশ্চিদ্রভাবে বন্ধ। ভেতরে ঢুকে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার কোনো কিছু দেখার কোনো উপায় নেই। হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে যা বুঝলাম বেড়ার আশেপাশে, পালঙ্কের নিচে চারদিকে খালি মাটির ভা-, মিঠাইর পাতিল আর পাতিল। আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কাগজের লেবেল ফুটো করে হাত ঢুকিয়ে খুঁজছি রসগোল্লা, কিন্তু পাচ্ছি জিলেপি আর নিমকি। ওগুলোও একটু আধটু খেতে পারতাম, তবু খাইনি, কারণ আমার সাধ, পেট ভরে রসগোল্লা খাওয়ার। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে যখন পালঙ্কের নিচে গিয়ে রসগোল্লার নাগাল পেলাম ততক্ষণে ধরা খেয়ে গেছি। সম্ভবতঃ মেজো চাচাই অমাদের কানে ধরে অন্ধকার ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। রসগোল্লার রস আঙ্গুলে লেগেছিল বটে, কিন্তু জিহ্বা টেরও পায়নি, আর পেটে যাওয়ার তো প্রশড়বই আসে না। ভাগ্যিস, বিয়ের দিন ছিল বলে রেহাই পেয়েছিলাম, নইলে আব্বার হাতের মার খেতে হতো।
জীবনে রসগোল্লার প্রতি কোনো দিন আকর্ষণবোধ করে নাই এমন মানুষ বাংলাদেশে আছে কিনা আমার সন্দেহ। শুনেছি পাকিস্তানেও নাকি রসগোল্লা
যথেষ্ট জনপ্রিয়। আর ভারতবর্ষের কথা তো সাম্প্রতিক জরিপেই ধরা পড়েছে। দু’ হাজার দশ সালে 'Outlook নামে সে দেশের এক ম্যাগাজিন সারা


ভারত জুড়ে এক সামাজিক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায় ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি রসগোল্লা। এর পর থেকে রসগোল্লা এখন সে দেশের জাতীয় মিষ্টি হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।
আমাদের দেশে উৎপনড়ব যাবতীয় মিষ্টদ্রব্যকে যদি দু’ভাগে ভাগ করা যায়, তবে তার একভাগে পড়বে হালুয়া, পায়েশ, ফিরনি, সেমাই, বালুশাই, জর্দা, বুিন্দয়া, লাড্ডু ইত্যাদি আর অন্যদিকে পড়বে বাকি সব অর্থাৎ ছানা এবং চিনিজাত মিষ্টি - যেমন রসগোল্লা, চমচম, মালাইচপ, মালাইকারি, স্পঞ্জ-রসগোল্লা, প্রাণহরা, কমলাভোগ, রাজভোগ (বড় রসগোল্লা), নলেন গুড়ের রসগোল্লা, রসমালাই, রসকদম্ব, কালোজাম, গোলাবজামন (পান্তুয়া), ক্ষীরমোহন, ক্ষীরসাগর, ম-া, পেঁড়া, সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। দ্বিতীয় শ্রেণীর সব মিষ্টির মূল ও মৌলিক অবস্থানে আছে মিঠাইর রাজা রসগোল্লা। বাকি সব রসগোল্লারই রকমফের মাত্র। ইংরেজিতে বলা যায় রসগোল্লার উবৎরাধঃরাবং। রসগোল্লার আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এর আগে প্রধানতঃ মিষ্টিদ্রব্য সবই ছিল শুকনো জাতীয়, রসগোল্লাই মিষ্টিজগতে সর্বপ্রম রসের সঞ্চার করে, আর তাই তো রসগোল্লা রসের রাজা, মিঠাইর রাজা। রসগোল্লার আবিষ্কার যার হাতে, যখনই হোক না কেন, নবীন চন্দ্র দাশ-এর সময় অবধি মিষ্টিটা খুব বেশি পচনশীল ছিল, বেশিক্ষণ রাখা যেত না, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর ছিল। অনেকে বলে থাকেন, এ কারণেই নবীন চন্দ্র দাশ তাঁর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় (রেসিপিতে) কিছু পরিবর্তন পরিমার্জন এনেছিলেন। ফলে রসগোল্লার পচন প্রক্রিয়ায় বেশ কিছুটা শ্ল করে দেওয়া সম্ভব হয় এবং রসগোল্লা হয়ে উঠে আরো বেশি স্পঞ্জি। রসগোল্লার মূল উপাদান দুধের ছানা এবং চিনি। রসগোল্লার ছানার জন্য গরু কিংবা মহিশের দুধ যে কোনোটাই ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে হাতেকলে ম দেখা গেছে, গরুর দুধের তৈরি রসগোল্লা মহিশের দুধের চেয়ে বেশি স্পঞ্জি হয়। রসগোল্লা স্পঞ্জি হওয়ার অন্যতম একটা কারণ হল, নবীন দাশের মূল রেসিপিতে ছানার সাথে ময়দা কিংবা সুজি মেশাবার কোনো সুযোগ ছিল


না। আজকাল বাড়তি ওই দুই উপাদান মেশানোর কারণে রসগোল্লা ততটা স্পঞ্জি হয় না, তবে ময়দা-সুজির জন্য রসগোল্লা মোলায়েম হয় এবং এতে একটা ভিনড়ব স্বাদের আমেজ পাওয়া যায়। আমার কাছে স্পঞ্জি রসগোল্লার চেয়ে মোলায়েম রসগোল্লা অধিক ভাল লাগে। বাংলাদেশের বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি নবীন চন্দ্র দাশ-এর রসগোল্লার বড় বড় ভক্ত ছিলেন। তার মাঝে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, এবং আরো অনেকে। এ রকম কথা এক সময় কলকাতায় মশহুর ছিল, রবি ঠাকুর নবীন দাশ-এর রসগোল্লার এত বড় অনুরাগী ও সমজদার ভক্ত ছিলেন যে, যে কোনো রসগোল্লা মুখে দিলেই তিনি বলতে পারতেন সেটা নবীন দাশ-এর, না অন্য দোকানের। সে যুগে রাণী রাসমণী নামে ছিলেন বাংলার
আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তিনি একবার নবীন চন্দ্রের রসগোল্লা খেয়ে বলেছিলেন, ‘‘আবার খাব’’। এতে নবীন চন্দ্র দাশ এতটাই উৎসাহীত হয়েছিলেন যে, তিনি রসগোল্লার একটি নতুন ভ্যারাইটি আবিষ্কার করে তার নাম দিয়েছিলেন, ‘‘আবারখাব’’। নবীন চন্দ্র দাশ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে কেসি দাশ রসগোল্লার টিনজাতকরণ শুরু করেন। তারপরই নবীন চন্দ্র দাশ-এর
রসগোল্লার জনপ্রিয়তা বর্তমানের পাকিস্তান ও বাংলাদেশেসহ গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টি-জগতে কেসি দাশ-এরও উল্লেখযোগ্য অবদান আছে।
তিনিই সবার আগে সফলভাবে রসমালাই বানিয়ে বাজারে চালু করেন। এখানে ভীম নাগের কথাটা না বললে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হবে, কারণ তিনি হলেন সন্দেশের উদ্ভাবক। কলকাতায় এক সময় কেসি দাশ-এর রসমালাই এবং ভীম নাগের সন্দেশের কথা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারীত হতো।
এবার ফিরে আসি রসগোল্লার মালিকানা-লড়াইয়ের কথায়। এ মামলায় উড়িষ্যার বক্তব্য হল, ভারতবর্ষে ইংরেজ, ফরাসী, পর্তূগিজ, ওলন্দাজরাও আসার
অনেক আগে রসগোল্লা প্র ম তৈরি করা হয় পুরীর জগনড়বাথ মন্দিরে, এবং সেটা নীলাদ্রী বিজয়ার দিন দেবী লক্ষীকে তুষ্ট করার জন্য ভোগ হিসেবে দেওয়া হতো। তাদের দাবি রসগোল্লার রেসিপি উড়িষ্যা থেকে পশ্চিম বঙ্গে আসে


বাংলার নবজাগরণের যুগে। সে সময় উড়িয়া ব্রাহ্মণ বাবুর্চিরা দলে দলে চাকরি নিয়ে আসে পশ্চিম বঙ্গে। তাদের কাছ থেকেই বাঙালিরা রসগোল্লা বানানো শিখে। মামলার মেরিট দেখে কলকাতার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উড়িষ্যার ভুয়া দাবি আদালতে টিকবে না। তাদের যুক্তি, পনেরো শ’ কিংবা ন’ শ’, কিংবা তিন শ’ বছর আগে রসগোল্লা বানানোর প্রশড়বই উঠে না, কারণ ছানা ছাড়া রসগোল্লা হয় না, আর অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষের মানুষ কেউই জানতো না কীভাবে ছানা বানাতে হয়। ভারতবাসী অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কেবল ছানা বানাতে
শিখে ওলন্দাজ এবং পর্তূগিজদের কাছ থেকে এবং এটা ঘটে কলকাতাতেই। নবীন দাশের একজন উত্তরপুরুষ - অনিমিখ রায় তাদের দাবির স্বপক্ষে আরো কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলছেন, জগনড়বাথ মন্দিরের প্রাচীন ভোগমেন্যুতে রসগোল্লার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। আর সেটা পাওয়া গেলেও তথ্যটা হবে অবিশ্বাস্য, কারণ রসগোল্লা বানানো হয় ছানা থেকে, আর
ছানার উৎপত্তি, ছিঁড়া বা পচা দুধ থেকে। পচা দুধের উপাদান হতে তৈরি খাবার কখনো দেবতার অর্ঘ্য হতে পারে না। তাই দেখা যায়, রসগোল্লার মালিকানা লড়াইয়ে পশ্চিম বঙ্গের দাবি বেশি যুক্তিসঙ্গত এবং সত্য-নির্ভর। যুক্তির সঙ্গে আবেগকে যুক্ত করে ইদানীং মমতা সমর্থকরা তাদের রাজনীতিকে আরো সুসংহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রসগোল্লার লড়াইকে কেন্দ্র করে তারা বলছে,
‘‘উত্তর-ভারত, কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে নিয়েছে, তারা রাবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমে প্রশড়ব তুলেছে, এবার রসগোল্লা যদি নিতে চায়, তাহলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে নিতে হবে’’।
রসগোল্লা-সংস্কৃতিতে উড়িষ্যা এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে আরেকটা তফাৎ আছে। উড়িষ্যায় রসগোল্লা গরম গরম পরিবেশন করা হয়, একই মিষ্টি বাংলায় খাওয়া হয় ঠা-া করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে কলকাতার সংস্কৃতিই অনুসরণ করা হয়, তবে কদাচিৎ কাউকে আবার গরম রসগোল্লাও খেতে দেখেছি। আরেকটা মজার ব্যাপার ইন্টারনেটে পড়লাম, কলকাতার সামাজিকতায় নাকি ডায়েবেটিক


রোগীদের রসগোল্লা ছাড়া অন্য কোনো মিষ্টি খেতে দেওয়া হয় না, অর্থাৎ সেখানে ধরে নেওয়া হয়, ডায়েবেটিস-এ অন্য মিষ্টি খারাপ হলেও রসগোল্লা ক্ষতিকর নয়। আর তাই তো সুখী অসুখী সব মানুষকেই সমানভাবে রসগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করা চলে। ঢাকায় এমন কথা কখনো শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে আমি অনেক দিন দেশের বাইরে, কে জানে, ইদানীং হলে হতেও
পারে। রসগোল্লা সাধারণতঃ দুই জাতের হয়ে থাকে। একটা ছানা-ভিত্তিক আরেকটা খোয়া অথবা মাওয়া-ভিত্তিক। যে রসগোল্লা উড়িষ্যায় হয় তাকে বলে ‘পাহালা রসগোল্লা’ আর যেটা কলকাতায় পাওয়া যায় তাকে বলে ‘বেঙ্গল রসগোল্লা’। দু’টার মধ্যে স্বাদে-গন্ধে পার্থক্য আছে, কিন্তু রেসিপি পড়ে আমি কোনো তফাৎ ধরতে পারিনি। রসগোল্লা নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের সাথে উড়িষ্যার যে মামলা চলছে, কেউ কেউ মনে করছেন, আদালত ‘পাহালা রসগোল্লা’র জিআই দিয়ে দিতে পারে উড়িষ্যাকে আর পশ্চিম বঙ্গ পেতে পারে ‘বেঙ্গল রসগোল্লা’র জিআই।
এভাবে দুই প্রতিযোগীর জন্য উইন-উইন রায় আসতে পারে আদালত থেকে।
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
১৬ মার্চ ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে