আবু এন. এম. ওয়াহিদ: চীনের প্রতি আমার আগ্রহ আর কৌতূহলের শেষ নেই; সে একেবারে ছোটবেলা থেকেই। যখন বুদ্ধি সুদ্ধি হয়নি, মাথায় স্মৃতিশক্তি কেবল দানা বাঁধতে শুরু করেছে, তখনই চীনের সাথে আমার প্রম পরিচয়। ‘পরিচয়’ বলাটা বোধ করি একটু বেশি হয়ে যায়, বরং বলা উচিত আবছা আবছা জানাজানি। পাঠশালায় বড়জোর দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বাংলা পাঠ্যবইয়ে একটা প্রবন্ধ ছিল, ‘ভিন দেশের ছেলেমেয়ে’ - সম্ভবতঃ এ শিরোনামে। পড়েছিলাম বিভিনড়ব দেশের শিশুদের নিয়ে বেশকিছু আজগুবি কথা! তার মাঝে মাত্র দু’টো বাদে বাকি সবই আজ স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্র ম যে কথাটা মনে পড়ে সেটা কোন দেশে কখন হয়েছিল তাও বলতে পারব না, তবে সেদেশের মানুষদের পায়ের পাতা ছোট রাখার জন্য অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের পায়ে লোহার জুতা পরানো হতো। অন্য যেদেশের কথা এখনো মগজে গাাঁ আছে সেদেশের
ছেলেমেয়েরা ছিল আরো অদ্ভুত! তারা ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পিঠ দিয়ে বসত। এই উল্টো দেশটা আর কোনোটাই নয়, প্রাচীরঘেরা প্রাচীন সভ্যতার দেশ - চীন। যদি বলেন, কবে ঘটেছিল এমন ঘটনা? কেন চীনা ছেলেমেয়েরা এভাবে বসতো? কবে এসে উল্টো চীন সোজা হল? এসবের কোনো হদিস আমার জানা নেই। যখন আরেকটু বড় হলাম তখন চীনের কথা আবার শুনলাম, তবে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে। এবার কোনো স্কুলশিক্ষক অথবা মক্তবে কোনো ওস্তাদের কাছে জানলাম নবী (সঃ)-এর বিখ্যাত হাদিসের কথা। তিনি বলে গেছেন, ‘‘জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সুদূর চীন দেশেও যাও’’। এরপর থেকে অচেনা ওই দেশটাতে যাওয়ার বাসনা আমার মাঝে সুপ্তভাবে বাসা বাঁধে, কিন্তু
২
সুপ্তাবস্থা থেকে সে বাসনা জেগে উঠতে উঠতে কেটে গেছে কয়েক যুগ, আর জাগলেই বা কী, আজও আমার চীন দেখা হয়নি! মওকা যে আসেনি তা নয়, এসেছে, এবং একবার নয় বরং দু’বার, কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনায় হাতছাড়া হয়ে গেছে সব সুযোগ। কীভাবে? সে কেচ্ছাই আজ আপনাদের বলতে বসেছি, তবে আসছি একটু পরে। তারপর μমান্বয়ে বয়স ও জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনা জিনিস দেখেছি, অল্পবিস্তর ব্যবহারও করেছি, চীনামাটির প্লেটে ভাত খেয়েছি, প্লেট ভেঙ্গে মা’র হাতের মারও খেয়েছি। ট্রেনজিস্টারে চীন-ভারত যুদ্ধের কথা শুনেছি, বাড়িতে এ নিয়ে আলোচনা হতো তাও মনে আছে। যখন জানলাম চীনের দেয়াল পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের অন্যতম একটি তখন থেকে ওটা দেখার জন্য মনের মাঝে একটা আশার আলো জেগে আছে আজ অবধি, বুড়ো বয়সে এসে যখন পড়লাম ঐতিহাসিক ওই প্রাচীর গড়তে চীনাদের লেগেছিল সুদীর্ঘ দু’হাজার বছরেরও বেশি তখন জাতি হিসেবে তাদের ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল বহুগুণ। পরে আরো থোড়া থোড়া চীনের কথা জানতে শুরু করেছি খবরের কাগজ ও বই পড়ে। বড় হয়ে ঢাকায় এসে চীনা মানুষ দেখেছি, চায়নিজ রেস্তোরাঁয় খেয়েছি, চীনপন্থী কমিউনিষ্ট নেতা-কর্মীদের সংস্পর্শে এসেছি, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরেছি, তর্ক-বিতর্ক করেছি। কমিউনিজমের লালবই পড়ে পড়ে এক সময় মাও সেতুং-এর ভক্তও বনে
গিয়েছিলাম, তবে সে ভক্তি আজ আর নেই। কলেজের দোরগোড়া পেরিয়ে যখন ইউনিভার্সিটিতে এসে ভর্তি হলাম তখন তরুণ মনে চীনের ছোঁয়া লাগল অন্যভাবে, ভিনড়ব প্রসঙ্গে। যে সময়টার কথা বলছি তখন ঊনিশ শ’ সত্তরের মাঝামাঝি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। আল-বেরুণী হলের ‘বি’ ব্লকের চারতলায় ৪১৫ নম্বর রুমে থাকি। আমার ঠিক উল্টোদিকের (রুম নম্বরটা মনে নেই) বাসিন্দা ছিল
৩
বন্ধু মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন। সে নিয়মিত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’ কিনতো। তার পড়া হলে আমাকে পড়তে দিত। আমি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওই সময়ে মৈত্রেয়ী দেবীর একটা ধারাবাহিক লেখা পড়তাম। লেখাটার শিরোনাম ছিল, ‘অচেনা চীন’। তিনি চীন সফর করে এসে ভ্রমণ কাহিনি হিসেবে লেখাটা লিখছিলেন। তাঁর এ লেখা পরে বই আকারেও বেরিয়েছিল। চীন সম্বন্ধে মৈত্রেয়ী দেবীর এ-কথা সে-কথা অনেক কথাই সে সময় পড়েছিলাম, কিন্তু আজ আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মত কিছুই আমার মনে নেই, কেবল একটা কথা আমার স্মরণশক্তি এখনো ধরে রাখতে পেরেছে। তাঁর একদিনের দিনপঞ্জি তিনি এভাবে বর্ণনা করেছিলেন, - সে দিন তিনি বেইজিং-এ, দেখতে গিয়েছিলেন কাচের বাক্সে রক্ষিত মাও সেতুং-এর মৃতদেহ। চীনের এ প্রয়াত ও অবিসংবাদিত নেতার লাশ দেখতে গিয়ে তিনি তাঁর কিছু অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও উপলব্ধির বয়ান যেভাবে দিয়েছিলেন তাতে আমার কাছে মনে হয়েছিল যে, তিনি যতটা না নিথর-নিস্তেজ মাও সেতুং-কে দেখেছিলেন তার চেয়ে গভীরভাবে অবলোকন করেছিলেন মাও-এর লাশকে ঘিরে হাজার হাজার চৈনিক ও বিদেশি পর্যটকদের কার্যকলাপ। লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর মতে, অগণিত দর্শক-পর্যটকরা ওই দিন মৃত মাও সেতুং-কে জীবিত মাও-এর চেয়ে অনেক বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা করে তাঁকে এক উপাস্য দেবতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটা তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যও করেছিলেন যা আমার মনকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। অন্য ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও তিনি ইসলাম ধর্মের একটা ইতিবাচক দিক অত্যন্ত সঠিক ও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইতিহাসের শুরু থেকে অনুসারীরা আপন আপন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের মৃত্যুর পর তাদেরকে পূজনীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, তবে ইতিহাসের এ-ধারা প্রতিহত করতে সবচেয়ে সফল হয়েছিলেন প্রফেট হজরত মোহাম্মদ (সঃ)।
৪
তারপর দিন যায়, বছর যায়, আমিও জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দিলাম। অবশেষে কানাডা-আমেরিকা-কানাডা হয়ে লেখাপড়া শেষ করে আমার থিতু হল মার্কিন মুল্লুকে। ঊনিশ শ’ বিরানব্বই সাল থেকে আছি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য টেনেসির রাজধানী লোকসঙ্গীতের শহর ন্যাসভিলে। অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান পড়াতে লাগলাম টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এখানে এসে নিতান্তই ভাগ্যগুণে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ও দাওয়াতি বক্তৃতা উপলক্ষে বিভিনড়ব দেশে যাওয়ার সুযোগ পাই। সেসব দেশে যাওয়া-আসা, থাকা ও দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে মাঝে মাঝে লেখালেখি করি। আপনাদের সঙ্গে শেয়ারও করি, কিন্তু এসব সফরসূচিতে চীনের নাম আর ওঠে না।
দু’হাজার ছয় সালে চীন যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হল। একদিন কলেজের ডিন আমাকে ডেকে বললেন, গ্রীষ্মের ছুটিতে তিয়ানজিন টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে (টিটিইউ) তিন সপ্তাহের একটা শর্টকোর্স পড়াবার জন্য তিনি আমাকে চীন পাঠাতে চান, আমি রাজি কিনা। এ রকম একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম অনেক দিন ধরেই, তাই চিন্তাভাবনা না করেই ডিনের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলতে আর দেরি করলাম না। কলেজ আমার যাওয়া-আসার খরচ দেবে, এবং হোস্ট ইনস্টিটিউশন বিনামূল্যে ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থা করবে, তার ওপর হাতখরচ বাবত একটা ভাল স্টাইপেন্ডও দেবে। পড়াতে হবে তিন Principles of Macroeconomics এর একটা সেকশন।
তিয়ানজিনের ডিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিন-তারিখ ঠিক করলাম - সম্ভবতঃ জুন মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। আরো ঠিক করলাম কি বই ব্যবহার করব, কোন কোন টপিক পড়াব, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তারপর পাসপোর্টে চীনের ভিসা লাগালাম। টিকেট কিনলাম কোরিয়ান এয়ার থেকে। আইটিনারিতে
৫
যাত্রাপথ দাঁড়াল ন্যাসভিল, এলএ, সওল, বেইজিং। বন্দরনগরী তিয়ানজিন বেইজিং থেকে মাত্র আশি মাইল দূরে। তিয়ানজিনের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপককে দায়িত্ব দেওয়া হল বেইজিং এয়ারপোর্ট-এ এসে আমাকে রিসিভ করার জন্য। বেইজিং যাচ্ছি জেনে আমার এক কোরিয়ান বন্ধু দাওয়াত করলেন যাওয়ার পথে যেন তার কলেজে একটা পাবলিক টক দিয়ে যাই। এ উপলক্ষ্যে তিনি আমার জন্য সওলে একরাত থাকার ব্যবস্থা করলেন। যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল ততই আমি একদিন একদিন করে দিন গুনছি, আর আমার মাঝে উত্তেজনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ উত্তেজনার তুলনা চলে কেবলমাত্র ছোটবেলা মায়ের সাথে নাওয়ে করে নানাবাড়ি যাওয়ার এবং ঈদের আগের দিনগুলোর সাথে। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে হাজির। গরমের এক নির্জন দুপুরে এ উত্তেজনার অবসান হল। আমি গাট্টিবোঁচকা নিয়ে কোরিয়া ও চীন দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা ছ’টার দিকে ন্যাসভিল থেকে এলএ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের টম ব্র্যাডলি ইন্টারন্যাশন্যাল টার্মিন্যালে গিয়ে হাজির হলাম। লম্বা লে- ওভার। কোরিয়ান এয়ারের সওল ফ্লাইট ছাড়বে আঞ্চলিক সময় রাত বারোটায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে বোর্ডিং শুরু হবে হবে, এমন সময় হঠাৎ টের পেলাম আমার শরীর মহাশয় বিগড়ে বসছেন! হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, মুখ শুকিয়ে আসছে, ঘন ঘন ঢোক গিলছি। ভীষণ নারভাস লাগছে। অবস্থা দেখে আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। আমার হাতের ব্যাগে ছোট্ট রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ছিল। বের করে মেপে দেখি প্রেশার-কাউন্ট ১৫০/১০০। ভয়ে ও ঠা-ায় আমার শরীর কাঁপছে, কথা বলতে পারছি না।সেলফোন অন করে বাড়িতে ফোন করলাম। ন্যাসভিলে তখন রাত দেড়টা। ভাগ্যিস আমার ছেলে ও গিনিড়ব তখনো জেগে ছিলেন। স্ত্রীকে বলতে না বলতে তিনি হেসে উঠলেন। তারপর যখন বুঝলেন বিষয়টা সিরিয়াস তখন বললেন, ‘‘চীন দেখার দরকার নেই বাড়ি ফিরে এসো’’।
৬
আস্তে আস্তে শরীর একটু স্বাভাবিক হলে কোরিয়ান এয়ার কর্তৃপক্ষকে জানালাম যে আমি যাচ্ছি না। তারা পনেরো-বিশ মিনিট সময় নিল আমার চেকইন লাগেজ এয়ারμাফ্ট থেকে বের করে আনতে। রাত বারোটা পার হয়ে গেছে, ন্যাসভিলে কোনো ফিরতি ফ্লাইট নেই। শাট্ল সার্ভিস নিয়ে চলে গেলাম নিকটবর্তী এক হোটেলে। পরদিন ফের ওয়ানওয়ে টিকেট কেটে বেজার মুখে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার চীন যাওয়া হল না, চীন দেখা হল না। এমন ভাগ্যবিড়ম্বনার কবলে আগে আর পড়িনি। যেতে না পারায় কলেজে, সওলে এবং তিয়ানজিনে বেশ সমস্যা হল, তবে সামাল দিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তিন বছর পর দু’ হাজার নয় সালে আবার এলো চীন যাবার আরেক সুযোগ।
সেবার আমন্ত্রণ এল খোদ টিটিইউ’র অর্থনীতি বিভাগের ডিন বাও জিয়ানবোর কাছ থেকে। তিনি আমাকে এক সপ্তাহের জন্য যেতে বলেছেন। পরিসংখ্যানে দু’টো ওয়ার্কশপ এবং একটা পাবলিক টক দেওয়ার জন্য। সে’ বছর আমার দু’টো দাওয়াতি লেকচার ছিল তাইওয়ানে। সফরসূচি বানালাম কাছাকাছি সময়ে যাতে এক ট্রিপে তাইওয়ান ও বেইজিং সেরে আসতে পারি। প্রম যাব তাইওয়ান তারপর তাইপেই থেকে সরাসরি বেইজিং। দিন যত কাছে আসতে লাগল, আমার ভাগ্যকাশে দেখতে পেলাম আবার কালোমেঘ ঘন হতে শুরু করেছে। চারদিকে মহামারির আকারে দেখা দিল সোওয়াইন ফ্লু (N1H1 ভাইরাস) যার কোনো চিকিৎসা নেই, প্রতিষেধকও বের হয়নি। তবু ভয়ে ভয়ে ভিসা, টিকেট, ইত্যাদি করে ফেললাম। এবারকার গতিপথ ন্যাসভিল-শিকাগো-টোকিও(নারিতা)-তাইপেই-বেইজিং। যাওয়ার দিনটা ছিল শনিবার। তার আগের দিন আমার বড় মেয়ের কলেজ গ্র্যাজুয়েশন সেরে একই দিনে তাকে ভেন্ডারবিল্টের ডর্মরুম থেকে বাড়িতে নিয়ে
৭
এলাম। তার আগের রাত আমার স্ত্রীকে নিয়ে সারারাত ছিলাম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে - কারণ স্টমাক ফ্লু। শুμবার রাতেই বাক্সপেটরা সব গুছিয়ে রেখেছি। শেষরাতের দিকে বুঝতে পারলাম শরীরটা কেমন কেমন লাগছে, পেটে অস্বস্তি। বুঝলাম গিনিড়বর পর এবার আমাকে ধরবে। তবু এ সবকিছু অবজ্ঞা করেই আমি সফরের প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ঘন্টাখানেকের পরে আলো ফোটার আগেই আমার এক বন্ধু রবার্ট দরজায় বেল দিল, আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। আমিও আল্লাহ ভরসা করে বেরিয়ে পড়লাম। ন্যাসভিল এয়ারপোর্টে গিয়েই বাথরুম যেতে হল, তারপরই নিশ্চিৎ হলাম আমি উদরাময়ে আক্রান্ত হয়েছি। সেখান থেকে ড্রাগস্টোরে ফোন করে ফার্মাসিস্ট-এর সঙ্গে কথা বললাম, তার উপদেশ- যেতে পারব, তবে পথে ইমোডিয়াম স্ট্রং ডোজ খেয়ে খেয়ে যেতে হবে। শিকাগো গিয়ে আবার টয়লেট! এক বোতল পানি কিনে তার সাথে চিনি ও লবন মিশিয়ে ওরসেলাইন বানিয়ে নিলাম। শিকাগো-নারিতা লম্বা ফ্লাইট, প্লেনে কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করল না। শুধু ওরসেলাইন খেয়ে আর ঘুমিয়ে নারিতা পৌঁছলাম। বারো-তেরো ঘন্টার ফ্লাইটে একবার কি দু’বারের বেশি ছোটঘরে যেতে হয়নি। আশান্বিত হলাম বোধ হয় রোগটা উনড়বতির দিকে। প্লেন ল্যান্ড করে যখন রানওয়েতে ট্যাক্সি করছে তখন বলা হল যখন গেটে এসে থামবে তখন কেউ যেন সিট ছেড়ে না ওঠে। পাবলিক হেল্-এর লোকজন এসে যাত্রীদের পরীক্ষা করে ঘ১ঐ১ ক্লিয়ারেন্স না দেওয়া পর্যন্ত কারো ডিসএম্বারকেশন হবে না। আরো ঘোষণা হল, কাউকে অসুস্থ পেলে সুওয়াইন ফ্লু সন্দেহে তাকে কোয়ারেন্টাইন করা হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার খবর হয়ে গেল! ভাবলাম, চীনের মাটি দেখা এবারও বুঝি মাটি হল! যা দেখছি তাইওয়ানেও তো যেতে পারব না। এখানে কোয়ারেন্টাইনে কতদিন থাকতে হবে আল্লাহ্ই মা’লুম। ভয়ে সিটে বসে রীতিমত কাঁপছি আর আল্লাহ্কে ডাকছি। এমন সময় দেখি মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভ্স পরে দশ-বারো জন জাপানি প্যারামেডিকস হুলুস্থূল করে বিমানের পেটের ভেতর ঢুকে তুলকালাম কা- শুরু করে দিয়েছে। মনে হল যেন একদল টেরোরিস্ট উঠে বিমানকে ছিনতাই করেছে। ঝড়ের বেগে
৮
তারা এলো আর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করল না। রোগমুক্তি না হলেও স্বস্তিতে বিমান থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ নারিতা থেকে সংযোগ ফ্লাইট নিয়ে রওয়ানা দিলাম তাইপে। নারিতাতেও টয়লেট ভিজিট করতে হয়েছিল আরেকবার। দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষ অংশে চার ঘন্টা উড়ে সময়মতই তাইপে এসে পৌঁছালাম। ইমিগ্রেশন কাস্টমস সেরে বের হতে হতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল। পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী বাইরে এসে দেখলাম ট্যামক্যাঙ্গ ইউনিভার্সিটির দু’জন ছাত্র আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা আমাকে ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউসে তুলে দিয়ে বলল, ‘‘চল তোমাকে নিয়ে খেতে যাব রেস্টুরেন্টে’’। আমি ক্লান্তির কৈফিয়ত দিয়ে যেতে চাইলাম না, বরং তাদের কাছে একটা অনুরোধ রাখলাম, তোমরা আমাকে একটা সাদা পাউরুটি, আধা ডজন কলা এবং দুই বোতল পানি এনে দিয়ে যাও। এখানে শুধু রুটি আর কলা খেয়ে কাটালাম দু’দিন। পেটের অবস্থা একটু ভাল বোধ করলাম। তারপর গেলাম তাইনান। সেখানে একটা পাবলিক টক ছিল, শেষ হলে পরে কেএফসিতে সাহস করে খেয়ে ফেললাম। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবার শুরু হয়ে গেল বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি। দু’দিন পরই আমার বেইজিং যাওয়ার কথা।
এবার টিটিইউতে আমার কনট্যাক্ট পার্সন ড. চুন ম্যায়ের সাথে যোগাযোগ হল। তাকে আমার পুরো অবস্থা খুলে বললাম। সে জানাল, ‘‘তুমি আসতে পার, আমি এয়ার পোর্টেও থাকব, কিন্তু যদি পাবলিক হেল্ টের পায় তাহলে তোমাকে কোয়ারেন্টাইন করে ফেলবে। এমতাবস্থায় আসা না আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে’’। বাড়িতে ফোন করে বউ ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বললাম, নিজেও ভাবলাম।
অবশেষে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিলাম, চীনের পথে আর পা বাড়াবো না, ওপথটা আমার নয়। পরদিন তাইপে এয়াপোর্টে গিয়ে নতুন করে ওয়ানওয়ে
টিকেট কিনে এক হাজার ডলার দ-ি দিয়ে এলএ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এলএতে নেমেই বুঝলাম, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। অচেনা চীন অচেনাই রইল, কিন্তু
৯
মৈত্রেয়ী দেবীর কথা মনে পড়ায় আগের বারের মত এবার আর মুখ বেজার হল না, মনে আফসোসও থাকল না। তিনি তো চীন দেখে এসে বলছিলেন, ‘‘অচেনা চীন’’ আর আমি না দেখেই বললাম ‘‘অচেনা চীন’’। তফাতটা কী? পুনশ্চ: ঠিক পরের বছর প্রায় একই সময়ে একই ফøাইটে টোকিও হয়ে আবার তাইপে গেলাম একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কীনোট স্পিচ দিতে। সেদিনও আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এল সেই ছেলে দু’টো। গাড়িতে ওঠার পরই একজন বলল, ‘‘ড. ওয়াহিদ, তোমার জন্য পানি এবং রুটি নিয়ে এসেছি, যাওয়ার পথে কলা কিনে দিয়ে যাব”। আমার প্রশ্ন তোমাদেরকে এগুলো আনতে কে বলেছে? অন্যজন উত্তর দিল, ‘‘তুমি যে গেল বছর রুটি, কলা, আর পানি ছাড়া অন্য কিছু খাওনি, তাই এনেছি’’। মনে মনে হাসলাম ও তাইওয়ানী ছেলেদের সরলতা দেখে অভিভূত হলাম! (লেখাটা পরিবর্তন পরিমার্জন করে দিয়েছে আমার এক ছোট ভাই সরকার জাভেদ ইকবাল। তার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই।)
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসী স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
২৫ মার্চ, ২০১৬,এমটিনিউজ২৪.কম/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস