মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাবু, সিঙ্গাপুর থেকে: ২এপ্রিল '২০১৬, অনুষ্ঠিত গোপালগঞ্জ জেলা বার কাউন্সিল এর নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন এ্যাডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দীন খোকন। দাদাকে অভিনন্দন। পারিবারিক জীবনে ছাত্র জীবন থেকে আমার বন্ধু কাজী শিহাব উদ্দিন লিটনের বড় ভাই এডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দিন মনের অজান্তে একটি জায়গা দখল করে আছেন।ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার কিছু নেই। তবে উনি আমার আদর্শ।কিভাবে একটি একান্ন বর্তী পরিবারকে ভালবাসা,আদর,স্নেহ দিয়ে আগলে রাখতে হয় তার কাছ থেকে শেখা।তিনি হয়তো জানেন না এ বিষয়টি। পারিবারিক ভাবে ধৈর্য্য ,সহনশীলতার আদর্শ তিনি। তার যোগ্য সন্মানিত স্থানে তাকে দেখতে পেয়ে আবেগ আপ্লুত। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন।
দাদার পরিবারের সাথে কিছু মধুময় স্মৃতি :
দাদা আমার দেখা একজন সাদা মনের মানুষ ,দাদা পরিবারকে কি করে আগলে রাখতে হয় তা শিখিয়েছেন তার অজান্তে।দাদা ,কাজীদের পরিবারে সবাই ভাইয়াকে দাদা ডাকে। আমিও ডাকি।বিরানব্বই সালে প্রথম যাই গোপাল গঞ্জে।স্বাভাবিক ভাবে আমি যে এলাকা থেকে এসেছি তার সাথে একটি পার্থক্য আছে বৈকি। আমাদের এলাকায় পা ধরে মুরুব্বিদের সালাম করার রেওয়াজ আছে. এখন অবশ্য ধর্মীয় বাধার কারণে কমে আসছে। দাদার হয়তো মনে নেই আমি পা ধরতে গিয়েছি অমনি বুকে টেনে নিয়েছিলেন।আশ্চর্য্য এক ভালবাসার বন্ধনের পরিবার। মশারির নিচ থেকে বেরিয়ে এলেন ছোট আপা। সে কি আদর ,আমি কোন দিন ভুলব না. মা আজ নেই। বাবা নেই। কি সোনার মানুষ ছিলেন।বড় আপা ,মেঝ দা,ছোট ভাই টিটু ,মিটু ,জীবনের প্রথম আমি সে বাসায় গেলাম ,মনে হয়েছিল আমি তাদেরই একজন.এর পর তিরানব্বই সাল ,যদি সন ভুল না করি ,বড় আপার বিয়ে ,বৃষ্টির এক সন্ধ্যা ,কাজী শিহাব উদ্দিন লিটন বন্ধু আমার ,থাকি জহির রায়হান হলে.ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। লিটন বললো ,আমি বাড়ি যাচ্ছি। বিয়ের বিষয়টা বলেনি বোধ হয় কিংবা সেও জানতো না হয়তো!পুরানো স্মৃতি , বাড়ি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেলো। আমি চুপ করে বসে রইলাম। কান্না পাচ্ছিলো। আসলে তখন ওকে ছাড়া আমার থাকতে কষ্ট হতো ,বদমাসটাকে খুব ভালবাসতাম।যদিও, ও আমাকে খালি জ্ঞান দিত। আজো দেয়.পকেটে টাকা নেই খুব বেশি ,হাতড়িয়ে দেখি শ দুয়েক হবে.গায়ে পুরানো শার্ট ,প্যান্ট আর রাবারের স্যান্ডেল। গত বছর কি করে গিয়েছিলাম!বাসে গাবতলী চলে গেলাম ,প্রচুর বৃষ্টি। অনুমান করে বাসে করে চলে গেলাম ,গোপালগঞ্জ। তখনো সকাল হয়নি ,না এবার প্রথমবারের মতো নগ্ন পায়ে শিশিরের গায়ে পা ভেজানো নুপুর পরা বালিকাদের দেখা পাই নি। বাস নামিয়ে দিল কোথায়? ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। একটি রিক্সা এলো। মুখস্ত রাখা বাড়ির ঠিকানা আর দাদার নাম বললাম ,রিক্সার ড্রাইভার বললেন ,আপনি কিছু ভাববেন না ,আমি আপনাকে ঠিক ঠিকানায় পৌছে দেব ,সে সুন্দর ব্যাবহার রিক্সা ড্রাইভারের। প্রথমবার এই পরিবারের সাথে আমি এই ছোট গোপালগঞ্জ শহরের প্রেমে পরেছিলাম বলা যায়। রিকসা অনেক ঘুরল আমায় নিয়ে। একটু পরিস্কার হতে পৌছে গেলাম লিটনদের বাসায়।ব্যাঙ্ক পাড়ায়। ইচ্ছে ছিলো লিটনের আগে পৌঁছব। পারিনি।যখন ঘরে প্রবেশ করি তখন লিটন জামা কাপড় ছাড়ছে ,আমায় দেখে বললো ,আমাকে বলতি তুই আসবি,উত্তর দিয়েছিলাম তুই আমার কাছে জানতে চেয়েছিস? এটা আমারও বাড়ি। ছোট আপা,বড় আপা দাদা,মেঝ্দা টিটু ,মিটু একটু রাগ করেনি ,আদরে বুকে টেনে নিয়েছিল।সেবার বড় আপার বিয়ে ,লিটনের সব বন্ধুরা মেয়েদের ছবি তোলা আড্ডা দেয়া নিয়ে ব্যাস্ত ,আমি আনন্দে আত্ম হারা ,বোনের বিয়ে,আপ্যায়নে ব্যাস্ত রেখেছিলাম নিজেকে।আর দেখছিলাম দাদা কি করে এই পরিবারকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর পর ছোট আপার বিয়ে হলো , বড় দুলাভাইয়ের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি ,ছোট দুলাভাই এসেছিলেন হোস্টেলে। তার পর তার বাসায় শিবচর বেড়াতে গিয়েছিলাম।যোগাযোগ না থাকা সত্বেও টিটু ,মিটু হাজির সেখানে। আচ্ছা এই পরিবারের সবাই ভালো মানুষ ,ছোট দুলা ভাই ভালো না হলে কি চলতো না! না উনি মনে হয় আরো এক ডিগ্রী বেশি ভালো। ছোট আপার বাসায় আমার কিছু দিন, শ্রেষ্ট দিন যাপন করেছি।শিবচর থানার সেই বিশাল পুকুর,ঘাট ,টুকরো স্মৃতি। এক সন্ধ্যায় দুলাভাই, আমি,লিটন,টিটু ,মিটুকে নিয়ে গেলেন সেলুনে ,নাপিতকে বললেন,এই চার শালাকে ন্যাড়া করে দাও,দারোগা বাবুর সে কি ডায়লগ।এক রাতে আমাকে আর লিটনকে নিয়ে মোটর সাইকেলে মাদারীপুর ,শিবচর থেকে গোপালগঞ্জ তার পর তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ছিলেন ।দুটি ঘটনা একটি লিটনের বাসার কাছে সম্ভবত দিবাদের গেটের সামনে মোটর সাইকেল স্লিপ করে ,দুলাভাই আবুল কাশেম টুটুল সাহেব সামলে নিলেও আমি পড়ে যাই ,আমার হাতে ছিল মিষ্টির প্যাকেট ,আমি চিত্কার দিয়ে বললাম ,দুলা ভাই মিষ্টি ঠিক আছে ,দুলা ভাই ধমক দিয়ে বললেন,আজব তো আমি ভাবছি তোমার কথা আর তুমি বলছ ,মিষ্টি ঠিক আছে ! আরেকটি, কয়েক কিলোমিটার পথ লিটন মোটর সাইকেল ধাক্কা দিয়েছে,আমি কাদায় হেটেছিলাম।
বড় আপা ছোট আপার বিয়ে হয়ে গেছে। দাদা বা লিটনদের অন্য ভাইয়েরা তখন ও ছাত্র। মা বয়স্ক মানুষ,অসুস্থ্য।ঢাকা পলিটেকনিক থেকে আমাদের ট্রেনিং পরলো টুঙ্গি পাড়ায় ,আমি ,লিটন,আকাশ,মিলন চারজনের। থাকার ব্যবস্থা দাদা করে দিলেন গেষ্ট হাউজের একটি ঘরে.রমজান মাস ,ভোরের সেহরী খেতে যেতাম লিটনদের বাসায়।প্রতি ভোর রাতে গরম ভাত.গ্যাস নেই তখন। একদিন আমি বললাম ,খালাম্মা প্রতি রাতে গরম ভাত দেন, ঠান্ডা হলে ক্ষতি কি,আপনার তো কষ্ট হয়, মা বললেন ,ওরে বাবু,তোমরা আসছ ,তোমাদের প্লেটে কি করে ঠান্ডা ভাত দেই ,আমি বেঁচে আছি এখনো।আমি থাকতে আমার ছেলে মেয়েরা খাবে ঠান্ডা ভাত ! মায়ের ভগ্ন শরীর নিয়ে দেশীয় পদ্ধতির রান্না ,বাবার সেই কিছু স্মৃতি আজো মনে পড়ে। যোগ্য মা বাবার যোগ্য সন্তান এডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দিন।আমার বন্ধু কাজী শিহাব উদ্দিন লিটন ,পরিবারের প্রত্যেক ছেলে মেয়ে হতে পারে আদর্শ।তবে আমার মনে মনিকোঠায় একজন সাদা মনের মানুষ,একজন ধৈর্য্যশীল মানুষ গোপালগঞ্জ বারের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি এডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দিন খোকন।
পার হয়ে গেছে অনেক বছর। আমার পলিটেকনিক জীবনের পাতানো বা ধর্ম বোন লিটনের ঘরনী।সবার ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে।লিটন মমির ভালবাসার সেঁতু বন্ধনে তিন কন্যা এক পুত্র।দু হাজার বারো সালে সুযোগ এলো আমার দুই কন্যা সহ গেলাম আমার আরেক পরিবারের কাছে গোপালগঞ্জে।ভেবেছিলাম ওরা ভুলে গেছে,যদিও দু হাজার তিনসালে ছোট আপা আর দুলা ভাইয়ের সাথে দেখা করি তার বাসায়। আমার দুই মেয়েকে আমার স্ত্রীকে পেয়ে এডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দিন সাহেবের পরিবার যা করেছে ,আমি কি দিয়ে এই ভালবাসার ঋণ শোধ করব?এরা কোন গ্রহের মানুষ। ছোট্ট ছেলেটা পর্যন্ত যেন এক ভালবাসার নদী ,বউ গুলি যেন এক একটি তারা ,ছেলেমেয়েরা মেজবাহ সাহেবের বাগানের ফুল ,যে বাগানে তিনি চাষ করেছেন ভালবাসা ,প্রেম,আদর,যত্ন,সন্মানের. হিংসা,অহংকারের চিহ্ন পর্যন্ত দেখলাম না এই পরিবারে!
৬ মে আমার বড় মেয়ের জন্মদিন আমি সেই বাসায়। সব মেয়েরা এক রুমে। যে ভাবেই হোক আমার মেয়ে নিশ্চই বলেছে ,আজ তার জন্মদিন। সকালে আমাদের রুমের দরজা খোলার আগেই হৈচৈ। শুরু হয়ে গেছে আনন্দ আর মাতামাতি ,আজ মিমের জন্মদিন আমার পরিবার এই সব পছন্দ করে না ,ধর্মীয় কারণে,শুধ আমি বাড়ি থাকলে একটা কেক এনে মেয়েদের নিয়ে ঘরোয়া আয়োজন করি. প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় যা থাকে তা না হয় না বললাম ,কিন্তু সে দুহাজার বারো সালের ৬ মে ,দাদা বউদের ডেকে বললেন,সব বউ মিলে বাজারে যাও ওদের জন্য গিফট নিয়ে আসো ,আজ মেয়ের জন্মদিন। বৌয়েরা মিলে রান্না বান্না,কেক তৈরী ,ছেলে মেয়েরা ঘর সাজানো ,ব্যাস্ত। আমি কি করি ?বাজারে গেলাম ,একটা দোকানে ,মাথায় কিছু ঢুকছেনা ,দেখলাম এক ছড়া কলা,বেশ নাদুস,নুদুস, ভাবলাম কিনে ফেলি। দোকানদারকে বললাম ,ভাই কতো ? দোকানী হেসে বললো, আপনার কেনা লাগবে না , কিছু বাকি নাই। সব কেনা হয়ে গেছে।আমি বললাম, মানে, আপনি সেজদার বন্ধু, কোন সেজদা ,ঐযে আনিকা ডায়াগনেষ্টিক সেন্টার , একটু ভাবলাম,ও লিটনকে ওরা সেজদা বলে,হ্যা ,ওরে আল্লা ,সব বউতে রিক্সা ভইরা নিয়া গেলো আর টিটু ভাই যা বাজার নেছে আপনার কিছু লাগবে না। ভাবলাম অনেক বছর আগে এক রিক্সা ওয়ালা কি সুন্দর ব্যবহার করেছিলো ,আজ এই দোকানদার। রাতে ঘটা করে জন্মদিন পালিত হলো মেয়ের।সব ছেলে মেয়েরা সে কি আনন্দ করলো ,বউ গুলি যেন কলেজের উচ্ছল তরুণী। আমার বউ মেয়েরা যেন এসেছে কোন এক আনন্দ নগরে।যেখানে শুধু ভালবাসা। বড় ভাবির সেই সুরেলা রবীন্দ্র সঙ্গীত ,আহা আজো কানে বাজে।দাদার পাশে দাড়িয়ে আমার মেয়েরা ইসলামী সঙ্গীত শুনিয়েছিলো। আর লিটন সিঙ্গাপুর থেকে কিছুক্ষণ পর পর নিচ্ছিলো খবর. মাঝে একদিন মিটু অর বউ মিশু,মমি,ওর ছোট ছেলে ,ছোট মেয়ে সহ গেলাম টুঙ্গি পাড়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ঘেরা জন্মস্থানে।দাদাই বন্ধের দিন জাদুঘরটি দেখার ব্যাবস্থা করেছিলেন।মিটুর মাধ্যমে।আমার বোন মমি কি মমতায় বাচ্চাদের আর বৌয়ের যত্ন করেছে কি করে বুঝাব। সময় ফুরিয়ে এলো ,টিকিট নিয়ে রেখেছে মিটু , বাড়ির আঙ্গিনায় আমরা ,ওরা বাসার সবাই ,এডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দিন খোকনের একান্নবর্তী বিশাল ভালবাসার স্বর্গের মানুষ গুলি ,সবাই অশ্রুসিক্ত। ছেড়ে আসতে মন চাইছিলো না.কারো চোখের পানি থামছিলো না। ছেড়ে আসলাম।কাজী সাহেবের বাড়ি ,এডভোকেট কাজী মেজবাহ উদ্দিন খোকনের বাড়ি।আমার ভালবাসার সেকেন্ড হোম। বাসে ফেরিঘাট পর্যন্ত আমার নিরব অশ্রু আমার বউ তার আঁচলে মুছে দিয়েছে।আমার মেয়েরাও ছিলো কেমন উদাস। লিটনের ছেলে আবির বলেছিল,তোমরা যেওনা।
৩ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস