 
                                        
                                        
                                       
                                        
                                             
                                                                                    
সোহেল এমডি রানা: ছোট বেলায় শুনেছি তানসেন নাকি গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতেন। তেমনি একটি বৃষ্টি
নামানোর গল্প আজকে বলব।
তখন আমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। প্রচন্ড দাবদাহ ঠিক এখনকার মত। তো আমাদের বড়রা একটা দল গঠন করলো। তাদের উদ্দেশ্য হলো -তারা বৃষ্টির গান করবে।
আমিও সে দলে নাম লিখালাম। যেমনি কথা ওমনি কাজ। পরের দিন সকালে একদল ছেলেপেলে নিয়ে আমাদের উঠানে বড় ভাইয়ারা হাজির। সবাই আমাদের বারান্দায় বসে পরিকল্পনা করল কোনদিক থেকে শুরু করবে এবং কোথায় শেষ করবে। সবাই আমরা প্রস্তুত। গানটা সবাইকে একবার গেয়ে শুনান হল এবং নিয়ম কানুন বলে দেয়া হল।
"আল্লাহ্ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে
তুই আল্লাহ মেঘ দে
আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা
মেঘরাজা ঘুমাইয়া আছে
মেঘ দিবে কেডা
আল্লাহ্ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে
তুই আল্লাহ মেঘ দে..
হালের গরু বাইন্দা গেরছ মরে কাইন্দা.."
আমাদের বাড়ি থেকেই শুরু হলো বৃষ্টির গান। এই গানটা গাওয়ার সময় সবাই গোল করে ঘুরে ঘুরে পালা গানের মত করে গাইতাম। আর যে বাড়িতে গাওয়া হতো সে বাড়ির মানুষজন সবাই কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে, কেউ কোলে বাচ্চা নিয়ে কেউ বা ঘরে শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে গলা বের করে গান শুনতো।
আর জগে করে, লুটা, বদনা করে, কলসে করে, বালতিতে করে পানি এনে আমাদের গা ভিজিয়ে দিত। আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে আবার গান গাইতাম।
এভাবে গান এক সময় শেষ হলে সে বাড়ির লোকজন আমাদের বস্তায় চাল, ডাল ইত্যাদি ভরে দিত। এরকমভাবে এক বাড়ি হতে অন্য বাড়ি, একপাড়া হতে অন্য পাড়ায় চলে যেতাম বৃষ্টির গান করতে করতে।সবাই খুব সানন্দে বিষয়টা গ্রহন করতো। খুব মজা হতো। কোথায় গেল সেসব দিন!
তবে কিছু সমস্যাও মোকাবেলা করতে হতো। এই যেমন আমাদের দলের কোনো সদস্যের ঠাট্টা সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে গান করার সময় পঁচা পানি গায়ে মারতো। কেউ কেউ আবার গরুর পানি খাবার চাড়ির পানিও আমাদের গায়ে মারতো। এতে অামাদের ভিজা কাপড় থেকে আস্টে গন্ধ আসতো। কিন্তু কিছুক্ষন বাদেই যখন আবার অন্য একটা বাড়িতে ভাল ফ্রেস কুয়া বা টিউবওয়েলের পানি মারতো সেই গন্ধ দূর হয়ে যেতো।
এখানে বলে রাখা ভাল যে আমাদের সবাই খালি পায়ে গান করতাম। গরমের প্রচন্ড দাহ এতটাই ছিল যে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলে জামা আবার শুকিয়ে যেতো। কোন কোন বাড়ির উঠান এতটাই শুষ্ক থাকতে যে আমাদের গায়ে যে পানি মারতো সেই পানি মাটিতে পড়ার সাথে সাথে উঠানের শুষ্কতা তা কয়েক মিনিটে শুষে নিত। এভাবে আমরা ভেজা জামা, ভেজা চুলে, আর ভাঙা গলায় গান গাইতে গাইতে প্রায় বিকেল টাইমে বাড়িতে ফিরতাম। তবে সবচে কষ্ট হতো সেই লোকটার যার দায়িত্ব ছিল চালের বস্তা, ডালের বস্তা বহন করার।
যা হোক, এভাবে আমরা পর পর দুদিনে বৃষ্টির গান করে যে চাল ডাল উঠল তা দিয়ে পিকনিকের মতো একটা আয়োজন করে বিস্তীর্ণ ফসেলের মাঠের বড় একটা গাছের নিচে মিলাদের আয়োজন করলাম। মসজিদের হুজুরকে দাওয়াত করলাম দোয়া পড়ানোর জন্য। মহান আল্লাহ্ পাক যেনো তার রহমতের বৃষ্টি দিয়ে আমাদের একটু শান্তি দান করেন। এরপর সবাই মিলে সেই যে প্রত্যেক বাড়ি থেকে দেয়া চাল ডালের খিচুরি কলার পাতায় নিয়ে মাঠে বসেই খেয়ে অপেক্ষায় থাকতাম বৃষ্টির। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে।
আমাদের খাবার দাবার শেষ হতে না হতেই দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে লাগল। আমরা সবাই আনন্দে আস্ফালন করছিলাম আর আকাশের দিকে তাকিয়ে যেনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম।
আজ এত বছর পর গরমের প্রচন্ড তীব্রতায় ডিজিটাল যুগে শহরের বাসায় বসে সেই অতীতটা মনে পড়ে গেল। মনে হয় আবার একবার বৃষ্টির গান করবো নাকি? এখন হয়তো অনেকে এ ব্যাপারে জানেই না। আমরাও একটু বৃষ্টির অপেক্ষায় আছি।
২৬ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস