শনিবার, ০৭ মে, ২০১৬, ১০:৫০:১৭

বৈরুতের ভয়!

বৈরুতের ভয়!

আবু এন. এম. ওয়াহিদ: আমি ২০০৬ সালে গিয়েছিলাম তিউনিসিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অফ টিউনিস-এলমানার’-এ। সে বার তিউনিস থেকে ফেরার পথে আমার বৈরুত হয়ে আসার কথা ছিল, কিন্তু কেন সেটা হয়ে ওঠেনি, তা এখন আর মনে নেই। দশ বছর পর আবার যখন বৈরুত যাওয়ার সুযোগ এল তখন ভাবলাম এবার আর কোনμমেই এ মওকা হাতছাড়া করব না। লেবানিজ আমেরিকান উইনিভার্সিটি (এলএইউ) আমার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে; দাওয়াত করেছে দু’টো সেমিনার ও একটা খোলা আলোচনার জন্য। তারিখ ঠিক হয়েছে এপ্রিলের ২০, ২০১৬। বৈরুতমুখী যাত্রা হলেও আমার মূল গন্তব্য কিন্তু দুবাই। দু’দিনের কনফারেন্স - এপ্রিল ১৭-১৮। রওয়ানা দেব ১৫ তারিখ। টিকেটও করেছি সেভাবেই, ন্যাশভিল-দুবাই-ন্যাশভিল। দুবাই থেকে বৈরুত যাওয়া-আসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছে ‘ফ্লাই দুবাই’ এয়ারলাইন্স-এর সাথে। যাব ১৯ তারিখ, দু’রাত থেকে ফিরব ২১শে এপ্রিল, দুবাই হয়ে সোজা বাড়ি।
বৈরুত নিয়ে সব সময়ই আমার মনে কৌতূহল ও উত্তেজনার সাথে সাথে একটা শঙ্কা এবং ভীতি কাজ করত। এ বার সফরের সময় যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, উত্তেজনা যেমন তেমনই রইল, কিন্তু ভীতি যেন আস্তে আস্তে ঘনীভূত হতে থাকল। সফরসূচী চূড়ান্ত করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ‘ফ্লাই দুবাই’-এর একটা ফ্লাইট রাশিয়াতে গিয়ে μ্যাশ করল। বাষট্টিজন যাত্রীর মধ্যে কেউই বাঁচল না। শুনেই মনটা কেন জানি ছ্যাঁত করে উঠল, ক’দিন পর তো আমাকেও উড়তে হবে ‘ফ্লাই দুবাই’-এ! দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে, একদিন রেডিওতে শুনলাম, বৈরুতে এক অষ্ট্রেলীয় শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, আমার মনের অবস্থাটা কেমন। যাব কি যাব না, ভাবতে শুরু করেছি, কিন্তু আমার ছেলে ও তার মাকে কিছু বলিনি। আমি জানি, ঘরে এসব


আলোচনা হলে এবারও আমার বৈরুত যাওয়া মাঠে মারা যাবে। বড় মেয়ে তো আমার সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েই রেখেছে।
যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, এমন সময় হঠাৎ একদিন ট্র্যাভেল এজেন্টের ইমেল পেলাম। লিখেছে, ‘ফ্লাই দুবাই’-এর বৈরুত ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। আমি সাথে সাথে এলএইউ-কে জানালাম। তারা বলল, “চিন্তার কোন কারণ নেই, অপেক্ষা কর, আমরা ‘মিড্ল ইস্ট এয়ারলাইন্স’-এর টিকেট কিনে তোমাকে শিগগির জানাচ্ছি”। কয়েক দিনের মধ্যেই ফ্লাইট কনফার্মেশনসহ আইটিনারি চলে এল। আমিও মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, যাব। বাক্সপেটরা গুছানো হয়ে গেছে। যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে ঘটল আরেক ঘটনা। এলএইউ আমার জন্য ১ মিলিয়ন ডলারের ট্র্যাভেল ইনস্যুরেন্স কিনে তার কাগজপত্র ইমেল মারফত পাঠিয়েছে। ‘ট্র্যাভেল ইনস্যুরেন্স’ দেখেই তো আমার হৃৎকম্পন আবার বেড়ে গেল। তার মানে বৈরুত সত্যি সত্যি একটি ভয়াবহ ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা, যাওয়ার আগে সবাইকে ইনস্যুরেন্স কিনতে হয়, অর্থাৎ জীবনের নিরাপত্তা নেই!
এমন দোলাচলের মধ্যেই আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে মন শক্ত করলাম এবং এপ্রিলের ১৫ তারিখ যথারীতি দুবাই-বৈরুতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। দুবাইয়ের কাজ সেরে উনিশ তারিখ এয়ারপোর্ট গিয়ে যখন বৈরুতগামী মিড্ল ইস্ট এয়ারলাইন্সের (এটা লেবাননের ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার) বিমানে উঠলাম, তখন ফ্লাইট এটেন্ডেন্টদের রূপমাধুর্য ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম এবং ভাবলাম, এমন সুন্দর সুন্দর মানুষ যে শহরে থাকে, সে শহর মানুষের জন্য কী করে অনিরাপদ হয়? আপাতত স্বস্তির সাথে বসলাম। বিমান আকাশে ডানা মেলার সাথে সাথে জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম দুবাই-উপকূলের কৃত্রিম দ্বীপে বানানো হোটেল আটলান্টিস ও পামজুমায়রা; ওপর থেকে অপরূপ লাগছিল! তারপর শুরু হল বালুর সাগর পার হওয়ার পালা। ঘন্টা দু’এক পরে গরম ভাপ ওঠা সুস্বাদু খাবারের গন্ধ ক্যাবিনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। এমন খুশ্বুতে খিদে


না লাগলেও খেতে ইচ্ছে করে। খাবার আয়োজন চলছে। এক ফøাইট এটেন্ডেন্ট আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘চিকেন অর ফিশ?” প্রশড়ব করলাম, হোয়াট কাইন্ড অফ ফিশ? “হামুর” হাসিমুখে বললেন তিনি। সাধারণত সফরে আমি মাছ খাই না, কিন্তু কী মনে করে তখন বলে ফেললাম, লেট মি ট্রাই ফিশ। খেয়ে ভালই লাগল। ‘হামুর’ অত্যন্ত মজাদার একটি সামুদ্রিক মাছ। আপনারাও কোন দিন সুযোগ পেলে খেয়ে দেখবেন।
বিস্তীর্ণ মরুভূমির ওপর দিয়ে উড়ে এসে যখন বৈরুতে নামলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেলেও বিকেল হয়নি। এরাইভ্যাল এরিয়াতে এসে দেখি এক ভদ্রলোক আমার নাম লেখা এক টুকরো কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই তিনি বুঝে গেলেন আমিই তাঁর অতিথি। আমাকে নিয়ে এসে উঠলেন তাঁর গাড়িতে। ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে কেন জানি আমার মনে একটু সন্দেহ জাগল। সঠিক লোক না হলে তিনি আমার নাম জানবেন কী করে? আজ এই ফ্লাইটে আমি আসছি, সেটাই বা বুঝবেন কীভাবে? এ সব তো যুক্তির কথা। তাতে কী? ভয়ভীতি কি আর যুক্তি মানে? একটু থিতু হয়ে গাড়িতে বসার পর তাঁর সঙ্গে দু’দ- কথা বলে মনে হল, তিনি এলএইউ’র কোন শিক্ষক নন, ট্যাক্সিওয়ালা তো ননই। তাহলে তিনি কে? ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমি কি কোন কিডন্যাপারের ফাঁদে পা দিলাম? তবে নার্ভাস না হয়ে একটু বুদ্ধি খাটালাম। তাঁকে বললাম, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? আমার এ প্রশেড়বর উদ্দেশ্য, যদি তিনি আমার হোটেলের নাম সঠিক বলতে পারেন, তাহলে আমি নিশ্চিত হব যে, আমার ড্রাইভার এলএইউ’র পাঠানো ব্যক্তি এবং নিরাপদ। যখন বললেন, “কমোডোর হোটেল,” তখন স্বস্তি পেলাম, ভয় কেটে গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক কালের প্রাচ্যের ভেনিস, বৈরুতের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম।
এর মধ্যে গাড়ি ভূমধ্যসাগরের পাড় ধরে চলতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি পাম গাছ। কিন্তু বড় করুণ তাদের চাহনি! সবক’টা গাছের ডাল ও


পাতা আধমরা, শুকিয়ে বাদামি রঙ ধরেছে, নিচের দিকে সামান্য একটু সবুজের ছোঁয়া আছে মাত্র। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, গাছগুলোর অবস্থা এমন কেন? তিনি বললেন, “বৃষ্টি হচ্ছে না, তাই”। সাগর ভরা পানি, অথচ পানিরই অভাবে পানিসংলগড়ব সাগরতীরের গাছগুলো সব মৃত্যুর সাথে লড়ছে। হলে কী হবে, মনে হল, তবু তারা মানুষের মত অকৃতজ্ঞ নয়! আধমরা গাছগুলো একাগ্রচিত্তে তাদের প্রভূর নাম জপছে আর বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন গুনছে।
একটু পরেই গাড়ি ডানদিকে বাঁক নিয়ে পুরনো বৈরুতের ভেতর ঢুকে পড়ল। চারদিকে জীর্ণশীর্ণ অতি প্রাচীন দালানকোঠা, ঘরবাড়িতে দারিদ্রের ছাপ প্রকট, চাপা চাপা রাস্তা, কোন রকমে একটা গাড়ি চলতে পারে। ময়লা নোংরা সরু গলি দিয়ে গাড়ি এলোমেলোভাবে ধীর গতিতে চলতে লাগল। দিনের বেলাও অন্ধকার অন্ধকার লাগছে, আর বনের বাঘের আগে মনের বাঘে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে! ভয়-ভীতি যেন আমাকে ছেড়েও ছাড়ছে না। সাধারণত বাইরে গেলে আমি ড্রাইভারদের সাথে ফটর ফটর অনবরত কথা বলতে থাকি, কিন্তু সেদিন আমার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিল না। ভয়ে কাঁপছি এবং আল্লাহ আল্লাহ্ করছি।
এভাবে ঘুরেফিরে এক সময় গাড়ি এসে থামল হোটেল কমোডোরের সামনে। আপতত ভয়ের অবসান হল। জিনিসপত্র টেনে নিয়ে হোটেলে উঠলাম। বিকেলে খেতে যখন নিচে নামলাম, তখন ফের ভীতি এসে আমাকে তাড়া করতে লাগল। লবিতে দেখলাম লোকজন আছে, কথাবার্তাও বলছে, কিন্তু কেন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। তার ওপর আরেকটা বিষয় নজর কাড়ল। যখন চেকইন করি তখন ক্লান্তি এবং তাড়াহুড়োর কারণে খেয়াল করিনি, এবার দেখলাম; দেখে একটু ঘাবড়ালামও বটে! পাঁচ তারকা হোটেল, তার সামনের প্রধান রিভলভিং ডোর বন্ধ। ডান দিকের ছোট দরজা দিয়ে লোকজন ঢুকছে এবং বাঁ দিকেরটা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ডান দিকের দরজার পরেই এয়ারপোর্টের মত একটি মেট্যাল ডিটেক্টার গেট, যার ভেতর দিয়ে আমি


ঘন্টাখানেক আগেই পাস করেছি, কিন্তু টের পাইনি। আরো দেখলাম ওই সিকিউরিটি দরজার পাশে একটি টেবিলের ওপরে রাখা কালো মেট্যাল ডিটেক্টার ব্যাটন। কাছেই স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে একজন সিকিউরিটি গার্ড। ভয়ে ভয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের হোটেলে ইদানীং কি কোন অঘটন ঘটেছে? বলল, “না, হোটেলে কিছু হয়নি, তবে শহরে এদিক-ওদিক যখন-তখন বোমাবাজি হয়, তাই আমরা সব সময় সাবধান থাকি”। হোটেলে এসেও শান্তি নেই! বুঝলাম বৈরুতের বাকি দিনগুলোও আমাকে এভাবেই কাটাতে হবে।
এ বার ভয়কে ঠেলে ফেলে পেটের ধান্ধায় লাগলাম। খবর নিয়ে দেখলাম হোটেলে দু’টো রেস্তোর‌্যাঁ আছে, একটা জাপানি আরেকটা লেবানিজ। হিরোশিমা-নাগাসাকির পর জাপানিরা আমেরিকাকে খুব সমীহ করে, কিন্তু বৈরুতের ভয় তাদের কাবু করতে পারেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুদূর ভূমধ্যসাগরের পাড়ে এসেছে ব্যবসা করতে। জাপানি খেতে ইচ্ছে হল না, তাই লেবানিজ রেস্তোর্যাঁয় গেলাম, এবং মেন্যু না পড়ে কিচেন কাউন্টারে তৈরি খাবার দেখে দেখে রুম-সার্ভিস অর্ডার করে ফিরে এলাম। আধঘন্টার মধ্যে একটি বিশাল ট্র্যে হাতে করে ওয়েটার এসে রুমে হাজির। তৃপ্তির সাথে খুব মজা করে খেলাম। কতক্ষণ টিভি দেখে ঘুমোতে গেলাম। বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথে অন্য ধরণের এক আজব শঙ্কা আমাকে ঘিরে ধরল।
আপনাদের হয়ত মনে আছে, ঊনিশশো পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বৈরুতেরই এক হোটেলে
ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন। আমার বার বার ভয় হচ্ছিল, আমিও যদি এভাবে ঘুমের মধ্যে মরে পড়ে থাকি, তা হলে কী হবে? নিজের অবুঝ মনকে নিজেই বুঝাতে লাগলাম, সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আমি তো তাঁর ব্যাগ বওয়ারও যোগ্য নই। তিনি বৈরুতে এসে মারা গেছেন বলে আমিও মারা যাব - এটা কি কোন যুক্তির কথা হতে


পারে? অবশেষে মনের ভয় যুক্তির কাছে না হলেও ক্লান্তির কাছে হার মানল। কখন যে কীভাবে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিলাম সেটা টেরই পাইনি। সকালে উঠে দেখলাম ওই সব ভয়টয় উবে গেছে। প্রথম রাত যখন পার করে দিয়েছি, তখন এ যাত্রা আর মরব না।
আগের কথামত সকাল সাড়ে দশটায় এলএইউ’র দু’জন শিক্ষক এলেন আমাকে নিয়ে যেতে। আমরা ১৫-২০ মিনিট পথ হেঁটে ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেলাম। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাব, দেখি এক সৈনিক একে-৪৭ কাঁধে নিয়ে বসে আছে। বাইরে যেমনই হোক না কেন, ক্যাম্পাসের ভেতরটা নিরাপদ, ছেলেমেয়েদের প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর। প্রথমে ডিন ও পরে অর্থনীতি বিভাগের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। লেবানিজদের একটা বৈশিষ্ট্য হল, তাঁদের চেহারা দেখে কিংবা নাম শুনে বোঝা যায় না, কে মুসলমান এবং কে খ্রিষ্টান। তাই কাকে সালাম করব আর কাকে গুডমর্নিং বলব সেটা ঠাহর করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। বিভাগীয় প্রধান কথায় কথায় লেবানিজ সিভিল ওয়ারের কথা বললেন। আমি বুঝলাম, তিনি মন খুলে আমার সাথে সব কথা বলতে পারেননি; হয়তো বা আমি মুসলমান বলে। শুধু বললেন, “গরম যুদ্ধ শেষ হয়েছে ২৫ বছরেরও ওপরে, এখন ঠা-া লড়াইয়ের টানাপড়েনে লেবানন একটা ডিসফাংশন্যাল স্টেট হিসেবে চলছে”। ১৯৭৫ থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে চলছে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মারামারি শেষ হয়েছে, অথচ এখনও বৈরুতের রাস্তাঘাটে এবং দালানকোঠায় দেখা যায় যুদ্ধের জ্বলজ্যান্ত চিহ্ন। মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তাঁদের হৃদয়ে রয়ে যাওয়া ক্ষত তার চেয়েও গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে।
কেমন করে বুঝলাম, এবার শুনুন তার বয়ান। লাঞ্চে যাওয়ার সময় বিভাগীয় প্রধানকে জিজ্ঞেস করলাম, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মুসলমান-খ্রিষ্টান অনুপাত কত? তাঁর পাশ থেকে আরেকজন জবাব দিলেন, “আমরা এ পরিসংখ্যান রাখি না”। এটা শুনে শিক্ষকদের মধ্যে অনুপাত কেমন, তা আমি আর জানতেও চাইনি।


লাঞ্চ সেরে এসে বসলাম অন্য এক অধ্যাপকের অফিসে। তাঁর নাম হোসেইন জিটার। ড. জিটারের সাথে কথা হচ্ছিল কাহ্লিল জিবরানকে নিয়ে। দেখলাম তিনি জিবরানের একজন বড় ভক্ত। কথা বলতে বলতে হোসেইন উঠে তাঁর পেছনের দেয়াল থেকে একটা কাঠের ডেকোরেশন পিস নিয়ে এসে আমাকে গিফ্ট করলেন। ওর মধ্যে জিবরানের একটা স্কেচ পোট্রেটসহ আছে জিবরানেরই লেখা একটি আরবি কবিতা। আমাকে কিছু পড়ে শোনালেন। তিনি আমাকে পরদিন জিবরানের গ্রামের বাড়ি, মিউজিয়াম ও তাঁর সমাধিতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। ডেকোরেশন পিসের সাথে তিনি একজোড়া তসবিহ নামালেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনি এগুলো দিয়ে কী করেন? তিনি বললেন, “সুবহানাল্লাহ্, সুবহানাল্লাহ্ পড়ি”। এবার আমি নিশ্চিত হলাম, তিনি মুসলমান।
আমি নামাজ পড়তে চাইলাম, তিনি একটা টাওয়েল বিছিয়ে দিলেন। তারপর মন খুলে আমার সাথে বেশ কিছু কথা বললেন, মনের দুঃখ নামাতে পেরে মনটাকে হালকা করলেন। বললেন, এলএইউতে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ৭০ শতাংশের মত। প্রতিষ্ঠানটির সমানুপাতিক আয় আসে মুসলমান অভিভাবকদের কাছ থেকে, অথচ শিক্ষক-কর্মচারিদের মধ্যে ২০ শতাংশ মুসলমানও নেই। যাও বা আছে, তারা পদে পদে দারুণভাবে বৈষম্যের স্বীকার। সমস্ত রিকোয়ারমেন্ট মিট করার পরও আমার প্রমোশন হয়নি। একমাত্র কারণ, আমি মুসলমান। বুঝলাম, প্রশাসন খ্রিষ্টানদের দখলে। সাধ্যমত তাঁকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, আপনাদের মত তিক্ত অভিজ্ঞতা আমারও আছে। “খরভব রং হড়ঃ ভধরৎ, নঁঃ ংঃরষষ রঃ রং মড়ড়ফ!" তা না হলে তো মানবের জন্য দড়ি-কলসি যোগান দেয়াই কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াত।
আলোচনার এক পর্যায়ে জিবরান সম্পর্কে তাঁর কাছে আমি একটি প্রশড়ব রাখলাম। মুস্তাফা, ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এরই আরেক নাম, এ কথা জিবরানের অজানা ছিল না। তারপরও একজন খাঁটি খ্রিষ্টান হয়ে তিনি কেন তাঁর


মাস্টার পিস, “দি প্রফেট”-এর মূল চরিত্রের নাম আল্-মুস্তাফা দিলেন? হোসেইন বললেন, খ্রিষ্টান হলেও জিবরান আমাদের রাসুল (সঃ) প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল এবং ঐতিহাসিকভাবে বিবদমান এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক উনড়বয়নের উদ্দেশ্যে তিনি সচেতনভাবে তাঁর মাস্টার পিসের প্রধান ও মূল চরিত্রের নাম দিয়েছেন আল্-মুস্তাফা।
তারপর শুরু হল আমার প্রেজেন্টেশনের পালা। প্রথমটা ছিল শিক্ষকদের জন্য, পরেরটা ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে। আমার সেমিনারে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। একটি বড় অডিটোরিয়াম, প্রায় ভরা ছিল। ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের সংখ্যা দেখলাম অনেক বেশি। লেবানিজ মেয়েরা যে এত রূপবতী হয়, তা আমার জানা ছিল না। একজনের চেয়ে আরেকজন সুন্দর - একেকটি মেয়ে যেন বাগানের একেকটি প্রস্ফুটিত তাজা গোলাপ। শুধু রূপ নয়, গুণও আছে তাদের। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশড়ব করেছে আমাকে। আমেরিকার অর্থনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে যা যা জানতে চেয়েছে, তাতে মনে হল তারা দিন-দুনিয়ার খোঁজখবরও রাখে এবং ভালই রাখে।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানাদি শেষে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবার ফিরে আসার পালা। বিকেল পাঁচটার সময় দু’জন শিক্ষক আমাকে গাড়িতে করে হোটেলে নামিয়ে দিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আটটায় এসে ডিনারে নিয়ে যাবেন। ডিনারে কোথায় গেলাম, কী খেলাম, কী আড্ডা মারলাম? তারপর রাতের বৈরুতে পায়ে হেঁটে ও গাড়িতে করে কী কী দেখলাম, কী বুঝলাম, কী ভাবলাম, সে সব নিয়ে আরেকটা পিস লেখার ইচ্ছে আছে। লিখতে পারলে অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। আজকের মত এখানেই ইতি।
অধ্যাপক: টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর: জার্নাল অব ডেভোলপিং এরিয়াজ
৭ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে