আবু এন এম ওয়াহিদ: কলকাতার স্যাটেলাইট চ্যানেল, ‘তারা নিউজ’-এ প্রতি রোববার ‘বই পড়া বইপাড়া’ নামে খুব জনপ্রিয় একটি টক শো দেখানো হত (এখন হয় কিনা জানি না।) লেখক রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় এর হোস্ট। এ অনুষ্ঠানে রঞ্জন বাবু একেক দিন পশ্চিম বঙ্গের একেক জন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে নির্দিষ্ট স্টুডিওতে বসে আড্ডা জমান। এই টক শোতে অনেক মজার মজার কথা, গল্প, কাহিনি, ঘটনা, তথ্য, ইত্যাদি শুনতে পাওয়া যায়। আমার ঘরে ‘তারা নিউজ’ নেই তাই আমি ‘বই পড়া বইপাড়া’ অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখতে পাই না। অবসর সময় থাকলে ইউটিউবে গিয়ে কম্পিউটার ¯িঙঊনের সামনে বসে পুরনো আড্ডায় যোগ দিই এবং বেশ উপভোগ করি। কোনো কোনো সময় এই টক শো আসরে আমি এমনভাবে মশগুল হয়ে যাই যে, আড্ডা শুনে একা একা আপন মনে হাসি, অভিভূত হই, নস্টালজিয়ায় ভুগি, কখনোবা আবেগে আপ্লুত হই, মনের অজান্তে কোনো কোনো সময় চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।
এমনি একদিন ‘বই পড়া বইপাড়া’র আশে পাশে ইউটিউবের ওপর কারসার ঘোরাতে ঘোরাতে আবিষ্কার করি এক মজার আড্ডা। ওই দিন রঞ্জন বাবুর অতিথি ছিলেন ওপার বাংলার স্বনামধন্য গবেষক-লেখক, কিনড়বর রায়। দুই বঙ্গেই কিনড়বর রায়ের সুনামের কোনো কমতি নেই। তবু সংক্ষেপে তাঁর পরিচয়টা দিলে মন্দ হয় না। সিরিয়াস লেখায় আসার আগে কিনড়বর রায় কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় চাকরি
করতেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিভিনড়ব স্থানীয় কাগজ থেকে তিনি ভাল ভাল চাকরির ওফার পেয়েছিলেন, কিন্তু চাকরিতে আর না গিয়ে ফুলটাইম লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েন। কিনড়বর বাবু নিজেকে জনপ্রিয় লেখক বলে মনে করেন না। তাঁর লেখার প্রায় সবই গভীর চিন্তাভিত্তিক, ঐতিহাসিক এবং গবেষণাধর্মী। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় আশিটির ওপরে বই লিখেছেন।
২
ঢাকা থেকেও তাঁর কিছু বই বেরিয়েছে, এবং পরে আরো বেরোবে বলে জানিয়েছিলেন। কথাবার্তায় মনে হল এই লেখক ভীষণভাবে আবেগপ্রবণ একজন মানুষ। তিনি সব সময় একা একা থাকতেই পছন্দ করেন। ঘরের বাইরে খুব একটা বের হন না। সভা, সমাবেশ, বক্তৃতা, বিবৃতিতে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই। চিন্তা-ভাবনা আর লেখালেখিতেই একান্তে সময় কাটান। সর্বদা নিজের মাঝেই নিজে লুকিয়ে থাকতে ভালবাসেন। ওই দিনকার আলোচনায় কিনড়বর বাবু ছেলেমেয়ের কথা কিছু বলেননি, তবে তাঁর স্ত্রী আছেন এবং তিনি জীবন বীমায় চাকরি করে স্বামীর লেখালেখিতে ষোল আনা সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। কিনড়বর বাবু ও তাঁর স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সুখের বলে সেদিন তিনি শ্রোতা- দর্শকদের আস্বস্ত করেছেন। কিনড়বর বাবু থাকেন কলকাতার উপশহর ব্রহ্মপুরে, ৫০০ বর্গফুটের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িতে, নগরের কোলাহল থেকে দূরে, এক নিরিবিলি জায়গায়।
লেখক কিনড়বর রায়ের ব্যক্তিগত জীবনের এত খুঁটিনাটি বর্ণনায় কোনো পাঠকের বিরক্তি আসলেও আশা করি তিনি আরেকটু পরেই বুঝতে পারবেন আমার আজকের নিবন্ধের মূল বক্তব্য ফুটিয়ে তোলার জন্য বিষয়টা খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওই দিনের আড্ডায় কিনড়বর বাবু একথা সেকথা অনেক কথাই বলেছেন। তাঁর লেখার তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করার জন্য শহরের বাইরে তিনি কখন কোথায় গিয়েছেন, কোথায় থেকেছেন, কীভাবে থেকেছেন, কী দেখেছেন, কী শিখেছেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে স্টিমারে
ঢাকা থেকে বরিশাল ভ্রমণের একটা আকর্ষণীয় বৃত্তান্তও তিনি প্রসঙ্গμমে তুলে ধরেছেন। কিনড়বর রায় তাঁর গবেষণা এবং চিন্তা-ভাবনা নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ও অভিজ্ঞতার কথা সেদিন সবার সঙ্গে শেয়ার করেছেন, তবে যে ঘটনার দিকে আজকে আমি আমার পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব তা একটু অন্য রকমের। আড্ডায় যেভাবে উঠে এসেছে, আমার মূল বক্তব্য এবং উপসংহারের সাথে প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য ঘটনাটাকে অবিকৃত রেখে বর্ণনাটা
৩
আমি আমার নিজের ভাষায় দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আশা করি এ জন্য পাঠকগণ আমাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।
কিনড়বর বাবুর একঘেঁয়ে জীবনের সাদামাটা একটা স্বাভাবিক দিনের কথা। স্ত্রী অফিসে গেছেন। তিনি ফ্ল্যাটবাড়িতে একা আছেন। প্রতিদিনকার অভ্যাসবশত সকালের দিকটা হয়ত লিখে কাটিয়েছেন। এটা তার লেখার বাঁধা সময়। দুপুর বেলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন বাইরের পরিবেশটা খুব সুনসান, সুন্দর, নিথর, নিস্তব্ধ। এমন সময় জানালার পাশে গাছে এসে একটা পাখি বসল। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। পাখি ডালে ডালে লাফাচ্ছে এবং কিচিরমিচির গান গাইছে। দুপুরের রোদ খাঁ খাঁ করছে। মানুষজনের তেমন কোনো আনাগোনা নেই, হৈ হুল্লূড় নেই। প্রকৃতির এমন বিরহ ভাব দেখে কিনড়বর বাবু কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। উতলা হয়ে উঠল তাঁর মন। ওই সময় চারপাশের পরিবেশ,
প্রকৃতি ও নিজের জীবন তাঁর কাছে খুবই বিষণড়ব লাগছিল, অর্থহীন মনে হচ্ছিল। এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে লাভ কী? এ রকম ভাবতে ভাবতে তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল আত্মহত্যা করতে, কিন্তু যখন রানড়বাঘরে গেলেন তখন মুহূর্তের মধ্যে লেখকের মন বদলে গেল। হতাশা, উদাসীনতা এবং আবেগপ্রবণতা থেকে তিনি বাস্তব জগতে ফিরে এলেন। ভাবলেন, ‘একটু রানড়বা করি, ছোট করে খাই’ (অর্থাৎ সামান্য করে
খাই)। যখন তিনি একথা বলছিলেন ঠিক সে সময় রঞ্জন বাবু তাঁর মুখের কথাটা কেড়ে নিলেন এবং দু’জন মিলে একই সুরে বলে উঠলেন, ‘মরে লাভ কী? আজ তো বাঁচি কাল দেখা যাবে’। আমি মনোস্তত্ত্ববিদ নই, তবু যা বুঝি, তাতে মনে হয় অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ লোকেরাই সাধারণত আত্মহত্যার প্রম ও সহজ শিকার হয়ে থাকেন।
এবার আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাই। ওপার বাংলা থেকে ফিরে আসি এপার বাংলায়। বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, অনাচে কানাচে যে সব নারী-পুরুষ প্রতি দিন আত্মহত্যা করতে চাচ্ছেন বা করছেন, তাঁরা কি লেখক কিনড়বর রায়ের মতো শুধু শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন? নাকি তার
৪
পেছনে অন্য কোনো গভীর বৈষয়িক কারণ কাজ করছে? আবেগের কথা অস্বীকার করি না, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মানুষের এই আত্মঘাতি অবেগকে নিঃসন্ধেহে উসকে দেয় কিছু আর্থিক ও সামাজিক অনাচার, অবিচার, অত্যাচর, অপারগতা ও নির্যাতনজনিত হতাশা। বাংলাদেশের বেলা এটা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলেই আমার মনে হয়। সাধারণভাবে আমরা জানি, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেমে ব্যর্থতা, আত্মহত্যার একটা অন্যতম কারণ। ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা ফেল করেও আত্মহত্যা করতে পারে। বেকার যুবক চাকরি না পেয়ে কিংবা বিদেশ যাবে বলে আদম বেপারি কতৃর্ক আথির্ক ভাবে প্রতারিত হয়ে নিজের জীবন নিজেই হরণ করেছে এমন অনেক ঘটনা আমরা জানি। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সময়মত শোধ দিতে না পেরে ঋণ গ্রহীতা নারী নিজের জীবন কেড়ে নিয়েছেন, এমন কথাও মাঝে মধ্যে শোনা যায়। বিবাহিত নারী, স্বামী, শাশুড়ি, কিংবা সমাজের অত্যাচারে, আবার স্বামী, স্ত্রীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেও এ সর্বনাশা পথ বেছে নিতে পারেন। দূর্নীতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে লোকলজ্জার ভয়ে অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মচারী কর্মকর্তা নিজের জান নিজেই কবজ করেন। কখনো বা আবার সামাজিক অথবা রাজনৈতিক চাপেও কেউ আত্মহত্যা করতে পারেন। অনেক সময় অভাব অনটনের কারণেও নারী-পুরুষ এমন সাংঘাতিক কাজ করে থাকেন।
যাঁরা অভাব ছাড়া অন্য কারণে নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যা করতে চান, তাঁদেরকে যদি কোনো রঞ্জন বন্দোাপাধ্যায় সময়মত রানড়বাঘরে নিয়ে যেতে পারেন তাহলে তো তাঁরাও কিনড়বর রায়ের মতন বলতে পারেন, ‘একটু রাঁধি, ছোট করে খাই, মরে লাভ কী, আজ তো বাঁচি কাল দেখা যাবে’। আবার যাঁদের হাতে টাকা নেই, রানড়বাঘরে খাবার নেই, নিজে খেতে না পেয়ে অথবা ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে আত্মহত্যা করতে চান, বা করেন, তাঁদের প্রতি আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ, সরকার কিংবা রাষ্ট্রের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? সবাই একবাক্যে বলবেন, অবশ্যই আছে। প্রতিবেশী, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র যদি এ দায়িত্ব পালন করে তাহলে প্রতি বছর অনেক জীবন অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। আর তা যদি নাই বা হয়, যেমন বাংলাদেশে হচ্ছে না, তাহলে
৫
এমন স্পর্শকাতর অবস্থায় কেউ যখন নিজের জীবন হরণ করতে চান তখন যদি কোনো রঞ্জন বাবু তাঁদেরকে পাকঘরে নিয়ে যেতে পারেন তাহলে তাঁরা কি কিনড়বর রায়ের সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বলতে পারবেন? ‘একটু রাঁধি, ছোট করে খাই, মরে লাভ কী, আজ তো বাঁচি কাল দেখা যাবে’। না, পারবেন না। কারণ তাঁর রানড়বাঘরে চুলো জ্বালাবার মত তো কোনো উপাদানই নেই। ভাগ্যের নির্মম
পরিহাসটা এখানেই। একজন সচ্ছল আবেগতাড়িত মানুষ যেখানে সখ করে মরতে গিয়ে এক প্লেট খাবার দেখে বারবার বেঁচে উঠেন, সেখানে গ্রামবাংলার হাজার হাজার হতভাগা নারী-পুরুষ দু’মুঠো ভাতের অভাবে বিষ পানেই চিরকালের মত পেটের খিদে নিভিয়ে দেন!
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসী স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
১৫ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস