তারেক হাসান: বেশকিছু দিন আগের কথা ১৯৯৭ সাল, আমি তখন ১৪বছরের বালক মোটামুটি ভালমন্দ সবেমাত্র বুঝতে শিখেছি। তবে আমার বয়স বেশি না হলেও গ্রামের ছোট বড় সবার কাছে যেমন ছিলাম পরিচিত মুখ তেমনি ভালবাসার পাত্র।হয়ত বা আমার বাবার পরিচয়ে ছিল আমার পরিচয়টা।কারণ আমার বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এলাকার সবাই এক নামেই চিনতেন। যাই হোক সেদিন রমজান মাসের ২৭তারিখ ছিল, আমি ঈদের কেনাকাটার জন্য শহরে গিয়েছিলাম,দেখি নিউমার্কেটের মোড়ে অনেক লোকের ভিড় আমি পিছন থেকে কিছুই দেখতে পারতেছিলাম না, তাই ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে যাই। ঢুকেই দেখি এক নিদারুণ দৃশ্য, মধ্যবয়সী এক লোকের হাত পা রশি দিয়ে বাঁধা তার ছেলের বয়সী এক যুবক তাকে লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছে,আর সেই লোকটি চিৎকার করে বলছে বাবা আমি চুরি করিনি,কিন্তু কেউ জানতে চাচ্ছেনা আসলে কি ঘটনা,সবাই শুধু বলছে পিটা শালারে -চোরের বাচ্চা চোর!কিন্তু ঐ লোকের চিৎকার আমার বিবেকে নাড়া দিয়ে উঠে,আমি ঐ ছেলেটিকে বললাম
- ভাই এই ভাবে পিটাচ্ছেন কেন?
-সে রেগে আমায় জবাব দিল, এই বেটা এই চোর বাপ লাগে নাকি!
-না, বাপ লাগেনা তবে, আপনার -আমার বাবার বয়সী।
এই কথা বলতেই ঐ যবুকটি আমার উপর রেগে যায়, চড়াও হয়ে আসে আমার দিকে,আমি তার হাত থেকে লাঠিটি কেড়ে নিই,আর আমি সেই ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদ করি।অবশ্য ততক্ষণে আমার পক্ষে অনেক লোক কথা বলছে-প্রথমে আমি জানতে চাই ঐ মধ্য বয়সী লোকের কাছে যাকে এতক্ষণ চোরের মত পিটাচ্ছিল।সে বলে-
-বাবা আমি চুরি করিনি,আমি অন্যের বাড়ি দিন মুজুর খাটি,সামনে ঈদ তাই কিছু টাকা নিয়ে শহরে এসেছিলাম ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য ঈদের নতুন জামা কাপড় কিনতে। কিন্তু এই ভিড়ে কে যেন আমার পাঞ্জাবীর পকেট কেটে সব টাকা নিয়ে গেছে। একথা বলেই লোকটি হাউমাউ করে শিশু বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠে।
-কিছু বলার আগেই অনেকেই বলছে পকেট মারে টাকা নিয়ে গেছে, এই ছেলেটি আমার পাশে দাঁড়ানো ছিল তার পকেট ও মেরে দিয়েছে।আমি গরীব মানুষ তাই আমাকে সন্দেহ করে ।টেনে হিচরে নিয়ে আসে,আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ দেয়নি।তার আগেই.....আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে লোকটি।কথাগুলো শুনে প্রথমে ঐ লোককে চেক করা হয়।আসলে তার পাঞ্জাবীর পকেট কাটা,তার মানে লোকটি যা বলেছে তা সত্য, অযথা লোকটিকে চোর সাজানো হয়, কোন কিছু না জেনে।তখন লোকজনের আরো ভিড় হয়ে গেছে যুবকটি আর কথা বলছেনা মাথা নিচু করে আছে,এর মাঝেই একটি লোক হঠাৎ যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল -মাসুদ তুই কাকে মারলি সেতো তোর বাবা!আজ থেকে ২০বছর আগে তোর মা, তোর বাবার সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে তোকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল,পরে তোর মা তোর বাবাকে ডিভোর্স দেয়।তোর বাবা বারবার তোকে নিতে এসেছিল কিন্তু তোর মা দেয়নি।
সেখানে বাংলা সিনেমার মত একটা হৃদয় বিদারক দৃশ্যর সৃষ্টি হলো।যুবকটি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সেখানে যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে হা করে চোর পিটানোর দৃশ্য দেখছিল তারা শেষ দৃশ্যটি দেখে খুব মর্মাহত হলো।
সেদিন শহর থেকে বাড়ি ফিরতে আমার বেশ রাত হয়ে যায়।আমরা মফস্বল এলাকার,তাই লোকজন একটু আগেই ঘুমিয়ে যায়, মনে হচ্ছিল ঘুমন্ত মফস্বলে আমিই একমাত্র রাতের পাহারাদার, তখন আমার নিজ এলাকায়,আমি লাউ গাছের মাচার নিচে মানুষের ছায়ার মত কি জানি দেখতে পেলাম,থমকে গেলাম আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিচ্ছি বারবার।তবুও বুকের ভিতর একটু সাহস জুগিয়ে ডাকতে লাগলাম-
-কে ওখানে?
কোন উত্তর নেই,আমার মাথায় কোন কাজ করছিল না,বারবার বলতে থাকি কে!কেরে?এবার আমি ঐ ছায়ার দিকে এগুতে থাকলাম, কাছে গিয়ে দেখি আমাদের মফস্বলের নেয়ামত আলী,এলাকার খুব ভালএকজন মানুষ।আমাকে দেখেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে,আমি কিছুই বুঝতে পারিনা। আমি জিজ্ঞেস করি -কি হয়েছে নেয়ামত ভাই? সে কোন উত্তর দেয়না -কাঁদছে তো কাঁদছেই!দেখি তার হাতে একটা ব্যাগ, আর ব্যাগের ভিতর দুইটা লাউ, আমার বুঝতে বাকি রইলো না, যা সে অন্যের গাছ থেকে চুরি করেছে, কারণ তার নিজের বাড়ি ভিটে নেই অন্যের বাড়িতে থাকে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম-
-কেন সে অন্যের গাছের লাউ চুরি করেছে?
কারণ সে চুরি করতে পারেনা, অন্যের জিনিসের প্রতি তার কোন লোভ নেই,এর আগে তা বেশ কয়েক বার তার প্রমাণ দিয়েছে, এলাকার সবাই তা জানে।ততক্ষণে সে আমায় জড়িয়ে কাঁদতে থাকে লজ্জায়,আমায় বলে-
আজ দুদিন আমার ঘরে কোন খাবার নেই ছেলেমেয়েরা উপাস খাবার জন্য কান্নাকাটি করছে,ঈদে নতুন জামার জন্য বারবার বলছে আমাকে- বাবা ঈদ তো কালকে কখন জামা কিনে দিবে?ছেলেমেয়েদের কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছিল না তাই জীবনের প্রথম বারের মত অন্যের মাল চুরি করতে বেরিয়েছি রাতের অন্ধকারে-এছাড়া আর আমার কোন পথ ছিল না,আবার কাঁদতে থাকে আমাকে জড়িয়ে ধরে,আর বলতে থাকে এই লজ্জা! কাল এলাকার মানুষের সামনে মুখ দেখাবো কি করে? তার কথাগুলো আমার হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। ঘৃণা হচ্ছিলো আমার নিজের প্রতি, ঘৃণা হচ্ছিলো এই সভ্য সমাজের প্রতি। তাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। তাই লোক সমাজে যেন তার মাথা নিচু না হয়, তার সাথে আমি নিজেই সেদিনের জন্য চোর সেজে গেলাম আর ও বেশ কিছু লাউ চুরি করি অন্যের গাছ থেকে এবং কি আমাদের নিজের গাছ থেকে।সব গুলো তারে দিয়ে বলি-
এগুলো সব বিক্রি করে টাকা গুলো মালিকের কাছে তার দাম ফেরত দিতে, আমার পকেটে থাকা পঞ্চাশ টাকা দেই চাল কিনার জন্য আর বলি সকালে আমার সাথে দেখা করতে।যাই হোক সবার আগে সকাল বেলা আমার বাবার সাথে গতকালের সমস্ত ঘটনা শুনাই, বাবা আমার খুব মর্মাহত হয়।এরি মাঝে শুনতে পাই অনেকেই বলছে গাছের লাউ চুরি হয়ে গেছে।আমার বাবা লোক মারফত খবর দেয় এলাকার লোকদের, প্রথমে কথা উঠে অনেকদিন পর এলাকায় চুরি হয়েছে, আবার গাছের লাউ!আমি বলে ফেলি আমি চুরি করেছি-আমার কথা শুনে সবাই অবাক!তারপর আমার বাবা এলাকার লোকদের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে-সবার মনে কথাগুলো নাড়া দিয়ে উঠে সবাই নেয়ামত আলীর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়,তাতে কারো তেমন বড় ক্ষতি হয়নি,বরং নেয়ামত আলীর মত অনেক অসহায় বাবাকে সাহায্য করার কারণে তাদের পরিবারে খুশীর বন্যা বয়ে গিয়েছল সেবারের ঈদে, সাজতে হয়নি কোন বাবাকে চোর! ছেলে মেয়ের আবদার মিটাতে।কোন সন্তানের মন কুলষিত হবে না এই কথাটি ভেবে "আমার বাবা চোর......
(বিঃদ্রঃ) আসুন আমাদের সকলের একটু সহযোগীতা হয়ত ফুটে উঠবে অভাবের পরিবারে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি, মেতে উঠবে ঈদের আনন্দে, আপনা আমার সন্তানের মত।অন্তত আমার প্রতিবেশী যারা গরীব, তাদের একটু সহযোগীতা করি)
৩ জুলাই ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস