আবু এন এম ওয়াহিদ: জীবন স্মৃতির আয়নার দিকে তাকালে আমি উনিশ শ’ ষাটের দশকের গোড়া পর্যন্ত যেতে পারি। এর আগের ঘটনাবলি আমার মগজের হার্ডডিস্কে সেভ হয়নি। অর্থাৎ তখনও অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মৃতির খাতায় স্থায়ীভাবে লিখে রাখার মত বয়স হয়নি আমার। বাংলাদেশে আমাদের ছোটবেলার বেড়ে ওঠার দিনগুলো আর আজকের দিনের মধ্যে বিস্তর ফারাক! পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান। অর্ধ শতাব্দীতে দেশ, দেশের মানুষ, তাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, আয়-উপার্জন, জীবন-জীবিকা, ইত্যাদি সবই বদলে গেছে। বদলে গেছে বিভিনড়ব রঙে, বিভিনড়ব ঢঙে। দীর্ঘ দিন ধরে দেশের বাইরে থাকি! বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিদিনকার μমাগত পরিবর্তন অনুভব করার সুযোগ পাই না। মাঝে মধ্যে যখন দেশে যাই, অনেক ব্যাপারে বড় বড় পরিবর্তন সহজেই চোখে ধরা পড়ে। যাঁরা দেশে থাকেন, যাঁরা পরিবর্তন করেন, এবং পরিবর্তনের মধ্যে সব সময় ডুবে থাকেন, তাঁরা যতটা দেখেন আমরা পাখির দৃষ্টিতে (বার্ডস আই ভিউ) তার চেয়ে বেশি তীক্ষèতার সাথে নজর ফেলে থাকি। কোনো কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন দেখে অবাক হই, মনের গভীরে ধাক্কা খাই,
দুঃখ পাই! আবার কোনো কোনো ইতিবাচক উনড়বতিতে খুশি হই, দেশের ভবিষ্যত চিন্তা করে আশায় বুক বাঁধি, শান্তিতে শ্বাস ফেলি! আলাপ আলোচনায় বুঝতে পারি, এ অনুভূতি আমার একার নয়। প্রবাসী বাংলাদেশি সবাই দেশকে নিয়ে এমনই ভাবেন। আমি তার বিন্দুমাত্র ব্যতিμম নই।
যেহেতু বাংলাদেশেরই কোনো এক অজপাড়া গাঁয়ে আমার জন্ম, তাই আমাদের ছোটবেলার ঈদ আনন্দও হত গ্রামবাংলার সেই সময়কার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। ঈমানদারদের জন্য অসীম রহমত ও ফজিলতের মাস রোজার মাস! এ মাস শেষ হলেই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঈদ আসে খুশির বার্তা নিয়ে, বয়ে নিয়ে আসে আনন্দের সওগাত! পরিবারপরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে সবাই দু’ এক দিনের জন্য হলেও নির্মল আনন্দে মেতে ওঠেন। আজকাল বাংলাদেশের নারীপুরুষ, ছেলেবুড়ো, ও শিশুরা কিভাবে ঈদ আনন্দ উপভোগ করেন তা সঠিক জানি না, তবে আমাদের কালে আমরা কিভাবে ঈদের খুশিতে ফেটে পড়তাম তা আজও মনে হলে সুখ পাই, পাই অনাবিল আনন্দ। স্মৃতির পাতা থেকে আমাদের ছোটবেলাকার ঈদের কিছু কথা, কিছু ভাবনা, কিছু অনুভূতি ও উপলব্ধি এই নিবন্ধের মাধ্যমে পাঠক পাঠিকাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। শেষ রোজার দিন সবার সাথে জামাতে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যেতাম। নামাজের পরে মসজিদ থেকে বেরিয়েই পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে
অধীর আগ্রহে খুঁজতে থাকতাম ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদ। এক চিলতে চিকন চাঁদ - এই দেখি এই নেই! নজরে পড়ত, আবার মুহূর্তে যেন মিলিয়ে যেত। ফের খুঁজে পেলে আঙুল ঘুরিয়ে চিৎকার করে অন্যদেরকে দেখাতাম। কেউ দেখতে পেত, কেউ না। খুশিতে নাচতে নাচতে এক দৌড়ে চলে আসতাম বাড়িতে। ঘরে এসে মাকে বলতাম, জান মা, আজ সবার আগে আমিই চাঁদ দেখেছি। কাল ঈদ। মা হেসে হেসে বলতেন, ‘তাই নাকি? তুই যে চাঁদ দেখেছিস তার সাক্ষী রেখেছিস কাউকে? আর চাঁদ দেখে থাকলে কাল থেকে নয়, খুশির ঈদ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে’। রমজান মাসের শেষ তারিখ চাঁদ দেখার সাথে সাথেই যে ঈদ শুরু হয়ে যায় এবং
শাবান মাসের শেষ দিন সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে রোজার মাসের সূচনা হয় সেটা বুঝেছি অনেক পরে, বড় হয়ে। সৃষ্টির শুরুতে অন্ধকারের গভীরেই আলোর জন্ম, আর তাই আরবী ক্যালেন্ডারে স্বাভাবিকভাবে দিনের আগে রাত
আসে।
এ লেখা নিয়ে বন্ধু মাহবুবের সাথে কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় মনে পড়ল। আপনাদের সুবিধার জন্য সেগুলো আমি জায়গায় জায়গায় যোগ করে দিয়েছি। এ জন্য মাহবুব ‘আরেকটি’ ধন্যবাদ পেতেই পারে। ‘আরেকটি’ বলার কারণ, এমন ধন্যবাদ আমার কাছে মাহবুবের সব সময়ই পাওনা থাকে। আমাদের ঈদের প্রস্তুতি ঈদের আগেই শুরু হয়ে যেত। আমার যতদূর মনে পড়ে, এ
তোড়জোড় আরম্ভ হত রোজার শেষ দিকে হাতে মেন্দি পরা দিয়ে। আমরা যখন গ্রামের বাড়িতে বড় হচ্ছি, তখন আমাদের কোনো বোন বা চাচাত বোনও ছিল না। তারা যখন দুনিয়ার আলো দেখেছে তখন আমরা পড়া-লেখার উদ্দেশ্যে বাড়িছাড়া। মেন্দি জিনিসটি সাজগোজের বিষয় এবং একটি মেয়েলি ব্যাপার। স্বভাবতই এতে তাদেরই উৎসাহ বেশি থাকার কথা। মাঝে মাঝে ওই সময় যখন বড়ফুফু নাইয়র আসতেন তখন ফুফাতো বোনদের নিয়ে মেন্দি উৎসব খুব জমত। ফুফু এবং কাজের মেয়েলোকরা আদর করে, যতড়ব করে আমাদের হাতে মেন্দি পরিয়ে দিতেন। আমি একটু অধৈর্য ছিলাম, কতক্ষণ পরপর আঙ্গুল দিয়ে মেন্দি পাতার পেইস্ট সরিয়ে
দেখতাম হাত লাল হচ্ছে কিনা। এতে আমার হাতের মেন্দি লেপটে-চেপটে যেত। মেন্দির লাল কারুকার্য পরিষ্কার হয়ে হাতে ফুটে ওঠত না, তাই ধোয়ার পরে অন্যদের সাথে যখন হাত মিলিয়ে দেখতাম তখন মন খারাপ লাগত। আমাদের বাড়িতে মেন্দি লাগান যে শুধু মেয়েদের বা ছোটদের ব্যাপার ছিল তাই নয়। আব্বা ও চাচাদেরকেও দেখতাম বাঁ হাতের ছোট আঙ্গুলের মাথায় এবং ওই হাতের তালুতে পূর্ণচন্দ্র আকারে মেন্দি পরতেন। আমাদের দুই হাতের তালুতে বেশ ডিটেইল্ড কারুকাজ সহ মেন্দি লাগানো হত। মাঝে মধ্যে আমরা দুই হাতের তালুতে চ্যাপ্টা করে মেন্দির পেইস্ট লাগিয়ে দিতাম। সে কাজ আমরা নিজেরাই করতে পারতাম, এবং একে বলতাম জোড়-মেন্দি।
যাই হোক, ফিরে আসি ঈদের দিনের কথায়। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রানড়বাঘরে নানা জাতের পিঠা ও মিঠাই বানানো শুরু হয়ে যেত। আমরা ঘুমাবার আগেই কিছু খেয়ে নিতাম। তারপর বিছানায় যেতাম ঠিকই, কিন্তু ঈদের খুশিতে আর উত্তেজনায় চোখে ঘুম আসতে চাইত না। ফজরের আযানের আগেই উঠে যেতাম। একানড়ববর্তী পরিবার, আমরা সমবয়সি ভাইরা, পাশের বাড়ি, এবং গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের সাথে গোসল করতে বাড়ির সামনে পুকুরে চলে যেতাম। এবং ‘নূর নবী মক্কার পানি ঈদের গোসল করলাম আমি’ এই দোয়া জপ করতে করতে ভাল করে গোসল সেরে জামাকাপড় পরে নিতাম। কাপড়গুলো আগেই ধুয়ে, শুকিয়ে, ভাঁজ করে বালিশের নিচে রাখতাম অন্তত তিন-চার দিন। তখন বাড়িতে লোহার ইস্ত্রি এসেছি কিনা সঠিক মনে নেই, আসলেও ওটা ছুঁয়া আমাদের এখতিয়ারের বাইরেই ছিল। পরিষ্কার জামা কাপড় পরে যখন ঘরে ফিরে আসতাম তখনো চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে একটি কথা বলে রাখি, ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পরার কথা জানতাম, তবে আমাদের ভাগ্যে তা জুটত না! কদাচিৎ
নতুন কাপড় পেলেও এমন ঈদের কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে না। কিন্তু এতে মোটেও খারাপ লাগত না, কারণ বলতে গেলে বাড়ির এবং গ্রামের সব ছেলেমেয়েদের অবস্থাই ছিল তথৈবচ। ঈদ গোসলের এই অভিনব দোয়াটি কে শিখিয়েছিল, তাও মনে নেই। এর মানে কী? এটা আদৌ কোনো সহি দোয়া কিনা? ইত্যাদি প্রশড়ব তখন কোনো দিন কারো মনে জাগেনি, তবে এটা যে একটা পবিত্র
দোয়া এ ব্যাপারে আমাদের কারোরই বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি ছিল না। আজ একা একা যখন সেই সব ঘটনা এবং স্মৃতিতর্পণ করি তখন মনে মনে হাসি। সূর্য ওঠার আগপর্যন্ত সবাই জটলা বেঁধে বিছানায় বসে গল্পগুজব করতাম, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠতাম।
পূব আকাশে আলো ফোটার সাথে সাথে আমরা ছেলেরা সব দল বেঁধে বাড়ির মুরব্বিদের যে যেখানে পেতাম পায়ে ধরে (কদমবুচি) সালাম করতাম। বাবা, চাচা, মা, চাচীদের পর সব শেষে যেতাম দাদীর ঘরে। দাদী বসে থাকতেন পিঠা ও মিষ্টি দ্রব্যের ভান্ড হাতে নিয়ে। সালাম করার পর দাদী আদর করে সবার হাতে তুলে দিতেন মিষ্টি জাতীয় খাবার। খেতে খেতে নেচে নেচে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। তারপর একে একে গ্রামের এঘর-ওঘর সববাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। মুরব্বিদের পায়ে ধরে সালাম করতাম আর বখরা পেতাম বিভিনড়ব জাতের ঘরে বানানো পিঠা। দু’ এক ঘর খাওয়ার পরেই পেট ভরে যেত। শেষের দিকে সাধলেও আর খাবার হাতে নিতাম না। সালাম করে খুশি মনেই খালি হাতে চলে আসতাম। খেতে খেতে μমান্বয়ে আমাদের কাছে মিষ্টি/পিঠার প্রান্তিক উপযোগিতা কমতে কমতে যে শূন্যের নিচে চলে আসত, সেটা বুঝেছি বড় হয়ে অনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বকথা পড়তে গিয়ে। তবে কদাচিৎ কেউ একটা দুটো সিকি আধুলি হাতে তুলে দিলে মনে হত যেন সাত রাজার ধন মানিক পেয়ে গেছি!
গ্রাম ঘোরা হলে বাড়িতে ফিরে আসতাম। এসে দেখতাম বাড়ির সামনে কাছারি ঘরের উঠানে লাইন ধরে ফকিরমিসকিনরা দাঁড়িয়ে আছে ফেত্রা নেয়ার জন্য। মিসকিনরা একে একে এগিয়ে আসছে, আর আব্বা বারান্দায় একটি পুরনো কাঠের চেয়ারে বসে কাউকে সিকি, কাউকে আধুলি, আবার কারো হাতে টাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন। ফকির মিসকিনরা চলে গেলে আমি আব্বার আশে পাশে ঘুর ঘুর করতাম। ভাবতাম, একটা সিকি আধুলি তো আমাকেও দিতে পারে! কিন্তু দেয় না কেন? বাবা যে ফেত্রার পয়সা আমাকে দিতে পারেন না, সেটা তখন জানলে তাঁর ওপর আমার এমন রাগ-অভিমান হত না।
তারপর সবার সাথে নামাজের জন্য ঈদগাহে যেতাম। নামাজ শেষে ঈদগাহের আশেপাশে দেখতে পেতাম সাদা টুপি মাথায় শুধু মানুষ আর মানুষ - ছুটছে এলোপাথাড়ি। তার মাঝে দুটো চিত্র স্পষ্ট আমার নজরে পড়ত। কুরবানির ঈদ হলে এক দল লোক দেখতে পেতাম ঘোরাঘুরি করছে। তাদের গায়ে ময়লা নোংরা ছেঁড়া কাপড়, মাথায় গামছা বাঁধা, এক হাতে বাঁশের লাঠি (কাঁধে করে চামড়া বয়ে নেওয়ার জন্য) আরেক হাতে ছালায় ছুরি-ছোরা ইত্যাদি। আর প্রায় সব ঈদেই থাকত আরেক দল, তারা ফেরিওয়ালা। বেলুন, হাওয়ার মিঠাই, বাঁশের বাঁশি, লেবেনচুষ, ইত্যাদি বিμি করত। নিজের পকেটে পয়সা থাকলে কিছু কিনতাম, না থাকলে মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম। পয়সার জন্য মানুষের ভীড়ে আব্বাকে খোঁজার বু্িদ্ধ থাকলেও সাহসটি ছিল না। ওই দুই দলের লোকদের ঈদের ময়দানে তখন একেবারেই বেমানান লাগলেও, অনেক পরে এসে বুঝেছি, তারাও ঈদ আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ্ এবং তাঁর রসুল ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে তিজারতকে একীভূত করে দিয়ে ইসলামকে আরো বাস্তবসম্মত ও জীবনঘনিষ্ঠ করে
গড়ে তুলেছেন!
রোজার ঈদ হলে নামাজের পরে বাড়িতে বকরি জবাই হত আর কোরবানির ঈদ হলে সাথে একটা গরুও থাকত। বাড়ির বাইরের ঘরের সামনে এক দিকে চলত গোশ্ত কাটাকাটি। আরেক দিকে চলত ঈদগাহ কমিটির বিশাল মিটিং। আমাদের ঈদগাহের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা ছিল আশপাশের পাঁচ গ্রামের পাঁচ পঞ্চায়েতের যৌথ মোয়ামেলাত। আব্বা ছিলেন এর মুতাওয়াল্লী। তাই মিটিং বসত আমাদেরই বাড়িতে। উপস্থিত থাকতেন পাঁচ গ্রামের সব মাতবররা। নামাজের পরে ঈদগাহে যে চাঁদা তোলা হত, তা আমাদের বাড়ির মিটিংএ গোনাগুনি হত। গোনার পর পুরো টাকাই ঈদগাহের ইমাম ও অ্যাসিস্টেন্ট ইমামের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। আমি
কতক্ষণ গোশ্ত কাটাকাটি দেখতাম, আবার কতক্ষণ মিটিং শুনতাম, ফলে কোনো কাজই ঠিকমত হত না। ইমামদের টাকাটা ফিফটি/ফিফটি অনুপাতে ভাগ হত না অন্য রকম তা বুঝতে পারিনি, আব্বাকে কোনোদিন জিজ্ঞেসও করিনি। ঈদের মিটিংটি বড় বলে পিঠা সন্দেশ খাওয়ানো সম্ভব হত না, কিন্তু পান-সুপারি আর গুড়গুড়ি হুঁকোর এস্তেমাল চলত বেহিসাব। জানতে বড় ইচ্ছে করে হুঁকো, তামাক, আর পান-সুপারির চল কি এখনো গ্রামদেশে আছে? রানড়বাবানড়বার জন্য স্বাভাবিকভাবেই দুপুরের খাবারে দেরি হত। তবে মজা করে ইচ্ছেমত পেট ভরে গোশ্ত দিয়ে খাওয়াটা আমি খুবই এনজয় করতাম। এমন জেনারাস মেন্যু বছরে মাত্র দুবারই আমাদের কপালে জুটত। বিকেল বেলা পাশের গ্রামে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছিল ঈদ উদযাপনেরই একটি অংশ। ফুফুর বাড়ি গেলে পেতাম সেমাই এবং মাঝে মাঝে আখনি পোলাও (বিরিয়ানির সিলেটি সংস্করণ)। হৈ-হুল্লোড় করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতাম ঘরে। আমাদের বাড়িতে কোরবানির ঈদের দুটো বিশেষত্ব ছিল। প্রমটি হল, যাঁদের নামে পশু কোরবানি করা হত, তাঁরা কোরবানির গোশ্ত রানড়বা হওয়ার আগে অন্য কিছু খেতেন না। এ রকম নিয়ম ইসলামে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমাদের বাড়িতে কে কখন এই রীতি চালু করেছিল তার ও হদিস আমি জানি না। দ্বিতীয়টি হল, আমার দাদী গরম করে করে কোরবানির গোশ্ত প্রায় এক মাস ধরে সেভ করে রাখতে পারতেন। সে যুগে রেফ্রিজারেশনের কথা তো গ্রাম দেশে কল্পনারও বাইরে ছিল। দাদী আরেকটি কাজ করতেন। ওই গোশ্ত দিয়ে একেক দিন একেক পরিবার করে আমাদের গ্রামের সবাইকে দুপুর বেলা ভাত খাওয়াতেন, এবং এ জিয়াফত সিরিজ
চলত প্রায় তিন/চার সপ্তাহ ধরে। কী রোজা, কী কোরবানির ঈদ, এশার নামাজের পর আমাদের বাড়িতে শুরু হত ওই দিনের আসল উৎসব। গ্রামের সবাই যার যার ঘরে ঈদের যা রানড়বা হত তার একটি বড় অংশ নিয়ে আসত আমাদের কাছারি ঘরের সামনের উঠানে। কেউ নিয়ে আসত পোলাও গরু গোশ্ত, কেউ আনত খিচুড়ি, কেউবা নিয়ে আসত সাদা ভাত আর তার সাথে খাসি অথবা মুরগির গোশ্তের তরকারি। ছোটবড়, ছেলেমেয়ে, জোয়ান-বুড়ো সবার মিলন মেলা বসত আমাদের বাড়ির আঙিনায়। ছোট ছোট হারিকেন জ্বালিয়ে আলো-আঁধারির মাঝে আমরা সবাই একসাথে ভাগ-যোগ করে খাবারগুলো খেতাম। কোনো কোনো সময় অন্ধকারের মধ্যে খাবার পাতে যে পোকা-মাকড় পড়ত না তাও নয়। আর পড়লেই বা কী? এত কিছু দেখে ও বেছে খাওয়ার কি সময় ছিল আমাদের? খাওয়া শেষ হলে পুকুরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসতাম। এটা ছিল ঈদের দিনের সবচেয়ে শেষ এবং সবচেয়ে উপভোগ্য আনন্দ অনুষ্ঠান। আজকাল দেশে বিদেশে নামি দামি হোটেল, মোটেল, ও কমিউনিটি সেন্টারে কত সৌখিন পার্টি হয়, খাওয়া দাওয়া হয়, কিন্তু ছোটবেলাকার সেই আনন্দ কোথাও খুঁজে পাই না। সারা দিন হৈচৈ করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তবু শুতে যেতে চাইতাম না। মনে হত ঘুমাতে গেলেই তো ফান মিস্ হয়ে যাবে। অবশেষে আব্বার বকাবকিতে বিছানায় যেতে হত। অবসনড়ব শরীর নিয়ে বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ক্লান্তিতে আরামের লম্বা ঘুম ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আগামী ঈদের স্বপড়ব দেখতাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠলে দিন গুনতে শুরু করতাম কবে আসবে আবার ঈদ! খুশির ঈদ! প্রবাস জীবনে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে আজও ঈদ করি। আজও আনন্দ পাই। আজও দিন গুনি আবার কবে আসবে রোজা, কবে আসবে ঈদ, খুশির ঈদ! তবে সেদিনের সাথে আজকের একটা পার্থক্য আছে। আজকের প্রত্যাশার সাথে একটা জিনিস নিশ্চিত জানি, জীবনে যত ঈদই আসুক, ছোটবেলার সেই ঈদ আর আসবে না। সেই অনন্দও আর ফিরে পাব না। শৈশবের সাথে চির দিনের মত হারিয়েছি তার আনন্দ উচ্ছ্বাস। ফিরে পাব না সেই সময়, ফিরে পাব না সেই ঈদ, ফিরে পাব না সেই হাসি-খুশি আর কোলাহল! বলতে পারেন, কেন এমন অনুভূতি হয়? আমার
ধারণা, মানুষ নতুন ট্রেজার যতই ‘ওউন’ করুক না কেন, পুরনোগুলোকে ‘ডিজওউন’ করে না, করতে চায় না, আর চাইলে কি পারে?
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হয় যে দিন ছেলেবেলার মধুর মধুর স্মৃতির কথা বিসর্জন দিতে হবে, সেদিন বুঝি আর বেশি দূরে নয়! কেন বলছি শুনুন। আমার এক পাঠক বন্ধু এ লেখার আগের ভার্সন পড়ে আমাকে যা
লিখেছেন তার সারসংক্ষেপ হল এ রকম, ‘জনাব, আপনি যে বাংলাদেশে বড় হয়েছেন, সে বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। এখন বাংলদেশের মানুষ আর গরিব নয়। এখানে এখন অনেক অনেক লোক আছে যারা প্রতিদিনই ঈদ করে থাকে’। আপনাদের মত আমিও জানি এখন দেশে অনেক মানুষ আছে যারা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে ঈদ করতে চায় না। তারা ঈদ এলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যান কক্সবাজার, কূয়াকাটা, আর যারা আরো ধনী তারা যান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালা লামপুর, এমন কী ইউরোপ-আমেরিকাতেও গিয়ে তারা ঈদ করে থাকেন। সবশেষে আপনাদের কাছে আমার একটি প্রশড়ব, যেদিন
বাংলাদেশের সব মানুষ সব দিনই ঈদ করবে, সেদিন কি আমার ছেলেবেলার সেই ঈদ, সেই স্মৃতি, সেই আনন্দ থাকবে, নাকি উনড়বয়নের হাওয়ায় হারিয়ে যাবে? কথাগুলো লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি আবেগে আঁখি দু’টো ভিজে আসছে!
লেখক: অর্থনীতির অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ;
৫ জুলাই ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস