আবু এন এম ওয়াহিদ: আমি একথা-সেকথার পশরা নিয়ে যখন-তখন আপনাদের সামনে হাজির হয়ে যাই। কোনো নোটিশ ছাড়াই আমার এলোমেলো অগোছাল লেখালেখি ফিসপ্তাহ আপনাদের মনিটার¯িঙঊনে ভেসে ওঠে। কেউ পড়েন, কেউ পড়েন না। যাঁরা
পড়েন, তাঁদের কাছেও সব লেখা এক রকম লাগে না। কোনোটা হয়ত ভাল লাগে, কোনোটা আবার বিরক্তিরও জন্ম দেয়। সে যাই হোক, এতে আমার খুব একটা পেরেশানি হয় না, কারণ লেখা মনমতো না হলেও ভদ্রতার খাতিরে আপনারা কেউ আমাকে কখনো বাজেকথা শোনান না। এ আমার সৌভাগ্য ছাড়া আর কী! তাই বলে আপনারা নিশ্চয়ই ভাবেননি যে, আমি কখনো এই ফোরামে
চুল কাটার গল্প পাড়ব। সত্যি বলতে কি, আমিও ভাবিনি। হঠাৎ কেন এ বিষয়ের অবতারণা, সে কথায় আসব পরে, তার আগে বলে নেই আমার আজকের চুল কাটার বয়ান।
এখনকার কথা জানি না, তবে আগেকার দিনে বাংলাদেশে, এমন কি উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও চুল কাটা শিখতে কারো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের দরকার হত না। যাঁদের এ কাজে আগ্রহ ছিল তাঁরা নিজ বাড়িতে ছোটদের চুল কাটতে কাটতে নিজে নিজেই ভালো চুল কাটা শিখে ফেলতেন।
এভাবে যাঁরা চুল কাটা শিখতেন এবং কাটতেন তাঁদেরকে কেউ নাপিত বলত না, কিন্তু গ্রামজুড়ে তাঁদের আলাদা একটা কদর ছিল, কারণ অবসর সময়ে বিনে পয়সায় তাঁরা প্রতিবেশীদের চুল কেটে দিতেন। সে যুগে গ্রামীণ মানুষের অবসর ছিল দু’ধরনের। প্রমত, জমি তৈরি করে ফসল ফলানো এবং ফসল কাটার সময়গুলো বাদ দিলে বাকি থাকে যে অফুরন্ত সময় তার সবই ছিল অবসর-বিশ্রামের আধার। এ সময়ে মাছধরা, জালবুনা,
২
ঘরদরজার মেরামতি ইত্যাদির সাথে সখের কাজ চুল কাটাও চলত গ্রামে গ্রামে। দ্বিতীয়ত, ভর ব্যস্ততার মৌসুমেও মাঝে মাঝে মানুষজন আলস্যে আনমনা হয়ে ওঠতেন যখন ঘন কালো মেঘ দিনের পর দিন আকাশ ঢেকে রাখত, আর ঝড়ো বাতাস ও বিজলি চমকের সাথে অবিরাম ঝরাত বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। ওই রকম দিনে মেয়েরা কাঁথা সেলাই ও রানড়বাবানড়বায় ব্যস্ত থাকলেও পুরুষরা সময় কাটাতেন পুঁথি পড়ে, কেচ্ছা শুনে, আষাঢ়ে গল্প করে ও মঙ্গল কাটাকাটি খেলে।
এর ফাঁকে ফাঁকে এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে ডাক আসত চুল কাটার লোকদের। এমন সময়ে প্রতিবেশীদের অপেশাদারি সেবা দিয়ে কিছু কৃতীপুরুষ কুড়াতেন এক জাতের আত্মতৃপ্তি ও মনের আনন্দ। যাঁরা এ কাজ করতেন তাঁরা সবাই গরিব কৃষক, কিন্তু গরিবি হালত হলেও তাঁদের মনের প্রশস্ততা ছিল অতুলনীয়! অন্যের চুল কেটে দু’পয়সা কামাই করার কথা তাঁরা কখনো ভাবতেন না। উনিশ শ’
পঞ্চাশ/ষাট-এর দশকে দেখেছি বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ এমনই ছিল। এখন গ্রামে যেমন প্রাচুর্য এসেছে তেমনি জীবন হয়েছে কৃত্রিম, বাজারনির্ভর ও যান্ত্রিক।
তবে তার মানে এই নয় যে, সেকালে গ্রামগঞ্জে কোনো পেশাদার নাপিত ছিলেন না। তাঁরাও ছিলেন বটে, কিন্তু প্রায় সবাই নি¤ড়ববর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। তাঁরা কৃষিকাজের সাথে চুল কাটাকে দ্বিতীয় পেশা হিসেবে ধারণ ও লালন করতেন এবং তাঁদের এ পেশাদারিত্ব চলত বংশপরম্পরায়। তাঁরা ঘরে বাপ- দাদার কাছেই চুল কাটা শিখতেন এবং কেউ কেউ নিয়ম করে গ্রামের জমিদারমহাজনদে র বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল কাটতেন। হাটের দিন বিকেলবেলা বাজারে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ধারে মাটিতে পিড়ি পেতে চুল কাটার দোকান বসাতেন। এক মাথা কাটলে মজুরি জুটত বড়জোর একটি সিকি। সে সময়ে গ্রামদেশে বকশিশ বা টিপস্-এর কোনো বালাই ছিল না। বাজারে অথবা গঞ্জে যেসব নাপিতের স্থায়ী দোকানঘর ছিল তাঁরা চুল কাটার জন্য কারো বাড়িতে যেতেন না। তাঁদের ব্যবসা দোকানেই চলত, সকাল-সন্ধ্যা সপ্তাহের সাতদিন। এ সব দোকানে যতটা না চুল কাটা হত, তার চেয়ে বেশি জমতো
৩
রাজাউজিরমারা মুখরোচক গল্প ও আড্ডা। নাপিতের দোকানে গেলেই আশপাশে ঘটে যাওয়া সব ঘটন অঘটনের তাজা খবর পাওয়া যেত। শুধু তাই নয়, নাপিতরা আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতি এবং দেশবিদেশের খবরও রাখতেন এবং ভালই রাখতেন। এ কথা কেবল বাংলাদেশে নয়, পাশ্চাত্য দেশেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ইলিনয়ের চার্লস্টনে এক নাপিতের দোকানের নামই ছিল 'Talk of the Town', যেখানে আমি একদিন চুলও কাটিওয়েছি।
এত কিছুর পরও চুল কাটাকাটি নিয়ে পূব-পশ্চিমে কিছুটা পার্থক্যও আছে। এখানে চুল কাটা কেবল পেশাই নয়, এটি একটি শিল্পও বটে। কাজটি শিখতে স্কুলে যেতে হয় - দশ মাস থেকে এক বছরের কোর্স নিতে হয়। পড়ালেখা আছে, লিখিত পরীক্ষা আছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল হাতেকলমে চুল কাটার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। লিখিত এবং প্রয়োগিক পরীক্ষায় পাশ করলে
সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। সার্টিফিকেট ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকায় চুল কাটাকে কেউ পেশা হিসেবে নিতে পারেন না। যাঁরা এ পেশায় নিয়োজিত হন তাঁরা পয়সার বিনিময়ে চুল কাটেন। কেউ নিজের দোকানে এ সেবা বিক্রি করেন, কেউ বেতনভুক কর্মচারিরূপে অন্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। চুল কাটার পেশাদার লোকদের এদেশে বলে ইধৎনবৎ, বাংলা ভাষায় যাকে বলা
হয় নাপিত। নাপিতরা হচ্ছেন এ পেশার আদি করিৎকর্মা পুরুষ। দুনিয়াজোড়া তাঁদের রয়য়েে ৫ হাজার বছরেরও দীর্ঘ একটি গৌরোবজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এখানে একটি মজার ব্যাপার লক্ষ করার মত - নাপিতদের কর্মপরিধি সময়ের সাথে এক দিকে সঙ্কুচিত হয়েছে, আবার অন্যদিকে সম্প্রসারিতও হয়েছে। কিভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে সেটা আগে দেখা যাক। আজকাল নাপিতরা
প্রধানত চুল কাটেন, তার সাথে আরো দু’একটি কাজ করেন - যেমন দাড়িমোচ কামানো, ঠোঁটের মোচ, চোখের ভুরু এবং কানের লোম ছাঁটা, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
৪
যদি পঞ্চাশ বছর আগের নাপিতদের কাজের দিকে তাকান তবে দেখতে পাবেন তাঁদের কর্মপরিধি ছিল আরো বড়। যেমন তাঁরা চুল কাটার সাথে সাথে নোখ কাটতেন, কানের খইল পরিষ্কার করতেন, মাথা এবং ঘাড় মালিশ করে দিতেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ তো গেল আধুনিক সময়ের কথা। প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উনড়বতির আগে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি থেকে ষোড়শ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত ইউরোপ- আমেরিকায় নাপিতরা কেবল নাপিতই ছিলেন না, তাঁরা রীতিমত ডেন্টিস্ট এবং সার্জনের কাজও করতেন। দাঁত তোলা, দাঁতের যাবতীয় চিকিৎসা, শিরা কেটে মানুষের শরীর থেকে রক্ত ঝরানো (Bloodletting), ভাঙা ও নড়ে যাওয়া হাড্ডিকে পুনঃস্থাপন করা (Setting bones), ও অন্যান্য জখমের চিকিৎসা
(Treating wounds), ফোঁড়া কাটাসহ মানবদেহে ছোটখাট অস্ত্রোপচারের মত কাজও তাঁরা অনায়াসে করে যেতেন। রক্ত ঝরানোর কারণটি নিশ্চয়ই জানেন। তখন মনে করা হত শরীর থেকে রক্ত বের করে ফেলে দিলে, গলা ব্যথা (Soar throat), প্লেগ (Plague) ও আরো অনেক জটিল রোগ এমনিতেই সেরে যায়। এগারো ষাটের দশকে হঠাৎ করে নাপিতরা কিভাবে ডাক্তার হয়ে ওঠলেন তারও একটা সুন্দর ইতিহাস আছে, তবে সেদিকে এখন আর যাচ্ছি না। চুল-কাটা লোকদের ডাক্তারি তত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ‘নাপিত-দ-’ কিংবা 'Barber's pole'-এর ইতিহাস ও তাৎপর্য। বাংলাদেশে কখনো দেখিনি, তবে ইউরোপ-আমেরিকায় নাপিতের দোকানের সামনে অথবা তাঁর দোকানঘরের দরজার ওপর শোভা পায় একটি রঙিন নাপিত-দ- যাতে লোকজন দূর থেকে নিশ্চিত হতে পারেন নাপিতের অবস্থান সম্পর্কে। দ-টি হতে পারে কাঠের অথবা গ্লাসের তৈরি, কোনো ধাতব বস্তুজাত, অথবা প্লাস্টিক দিয়ে
বানানো। আধুনিক নাপিত-দ- প্রায় সবই বৈদ্যুতিক, এবং দিনরাত বর্ণিল আলোয় ঝলমল করতে থাকে।
৫
ইউরোপ এবং আমেরিকার নাপিত-দ-ের মধ্যে সামান্য একটু তফাৎও রয়েছে। ইউরোপীয় নাপিত-দ- দ্বিবর্ণবিশিষ্ট। এখানে লাল এবং সাদা রঙ যথাক্রমে, Bloodletting এবং Bandage--এর প্রতীক। আমেরিকান নাপিত-দণ্ডে নীল রঙটা অতিরিক্ত। এর অর্থ মানবদেহের শিরা - যার ভেতর দিয়ে লাল রক্ত বয়ে যায়, কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে নীল লাগে। পাশ্চাত্য জগতে নাপিতদের ডাক্তারি চর্চা শেষ হয়ে যায় ১৫০০ সালের দিকে, কিন্তু নাপিত-দণ্ডে এখনো বহাল তবিয়তে খাড়া আছে নাপিতদের দোকানে দোকানে। এ ছাড়াও জানা যায়, পুরো ইউরোপ মহাদেশে ১৭৪৫ সাল পর্যন্ত নাপিত এবং সার্জনরা একই গিল্ডের সদস্য ছিলেন। তাই ঐতিহাসিকভাবে নাপিতদের বলা যায় ডেন্টিস্ট এবং সার্জনদের ফার্স্ট কাজিন। এ জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য শুধু পশ্চিমাদেশেই নয়, ভারতবর্ষেও আছে, কিন্তু তার বিবর্তন কাহিনি আমার জানা নেই। নাপিতদের ডাক্তারি নিয়ে একটি মজার গল্প শুনেছি বন্ধু মাহবুবের কাছে। পড়ে দেখুন আপনাদের কাছে কেমন লাগে। একবার তিন বন্ধু লেখাপড়া করে ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে এক ছোট্ট শহরে এসে ব্যবসা শুরু করলেন। প্রথম দিকে কিছু প্রচার-প্রচারণাও চালালেন। কিছুদিন যাওয়ার পর হতাশার সাথে লক্ষ করলেন, তাঁদের ক্লিনিকে কোনো রোগী আসে না। শহরের সব রোগী চলে যান নাপিতের দোকানে, যে নাপিত অনেক দিন ধরে চুল কাটার সাথে শহরবাসীকে
৬
ডাক্তারি সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সময়ের সাথেও অবস্থার যখন কোনো পরিবর্তন হল না, তখন তিন বন্ধু নাপিতের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমরা সনদপ্রাপ্ত ডাক্তার। তুমি যদি রাজি হও তাহলে আমরা তোমাকে কিছু ডাক্তারি বিদ্যা শিখিয়ে দিতে পারি। এতে তুমি তোমার রোগীদের আরো উনড়বত মানের সেবা দিতে পারবে’। নাপিত খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন। তিন বন্ধু নাপিতের সাথে
কয়েকটি ক্লাস নিলেন। তাঁকে ছবি দেখিয়ে শিখিয়ে দিলেন মানবদেহে কোন হাড়ের অবস্থান কোথায়, কোনটা বসাতে গেলে কোনটা নড়ে যেতে পারে, কোন শিরা উপশিরা কোনদিকে গেছে, কোনটা কাটতে গেলে কোনটা কেটে যাওয়ার ঝুঁকি আছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। নাপিত ডাক্তারি শিখে নতুন উদ্যমে চিকিৎসা শুরু করলেন, এবং বুঝতে পারলেন আগে তিনি যে কাজ, আস্থা ও সাহসের সাথে সহজে ও নির্দ্বিধায় করতে পারতেন, এখন সেই কাজ করতে তাঁর হাত কাঁপে, সময় লাগে বেশি, কাজও ভাল হয় না। কারণ, আগে তিনি অ্যানাটমি-ফিজিওলজি কিছুই জানতেন না, ইচ্ছেমত ক্ষুর চালাতেন, ইচ্ছেমত গায়ের জোরে হাড্ডি বসাতেন। এখন
ফোঁড়া কাটতে গেলে তাঁর হাত কাঁপে, যদি অন্য শিরা-উপশিরা কেটে যায়, হাড্ডি বসাতেও ভয় হয়, একটা টানলে যদি আরেকটা ভেঙ্গে যায়। রোগীরাও যখন বুঝতে পারলেন, নাপিত আগের মত চিকিৎসা দিতে পারছেন না, তখন তাঁরা, তিন ডাক্তারের ক্লিনিকে গিয়ে ভীড় জমাতে শুরু করলেন। বর্তমানকালে নাপিতদের পেশা সীমিত হতে হতে কেবল চুল কাটায় এসে থিতু হয়েছে। অন্যদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, আজকাল সার্বিকভাবে চুল কাটার পেশাটা সম্প্রসারিতও হয়েছে। আগে নাপিতের দোকানে পুরুষ মানুষই কেবল চুলদাড়ি কাটাতেন। জগতের সর্বত্রই নাপিতের দোকানের পরিবেশটাও ছিল ষোল আনা পুরুষতান্ত্রিক। শুধু তাই নয়, পুরুষদেরও চুল কাটার একটা নিদৃর্ষ্ট ধরন ছিল। নাপিতরা পুরুষদের চুল অত্যন্ত সহজ সরলভাবে ছোট করে
৭
কেটেছেঁটে দিতেন। এ কাজে তাঁরা ফ্যাশন-ভূষণ করতেন না, তার ধারও ধারতেন না। এখন সব পুরুষ ছোট করে চুল কাটেন না। কেউ লম্বা চুল লম্বা রেখেই স্টাইল করেন, নিত্যনতুন ফ্যাশন-এর সাথে করেন ডাইয়িং, ট্রিমিং, μাফ্টিং, সহাইলাইটিং, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এগুলো কিন্তু নাপিত বা 'Barber' এর কাজ নয়। আধুনিক জমানায় যাঁরা এসব কাজ করেন তাঁদেরকে বলে 'Hairdresser'। অধিকাংশ ‘HairdresserÕ, Chain Hairdressing Salon'-এ বসে চুলের সেবা বিμি করেন। নাপিতদের সাথে
'Hairdresser'দের পার্থক্য আছে। নাপিতরা শুধুই পুরুষদের চুল কাটেন, তাও অত্যন্ত সহজ সরলভাবে ছোট করে কাটেন। Hairdressing Salon-এ পুরুষের চুল কাটেন তবে তাঁদের কাটায় নানান রঙ ও ঢঙ মেশানো থাকে, থাকে অনেক কারুকার্য করা স্টাইল। ঐধরৎফৎবংংরহম ঝধষড়হ-এ শুধু পুরুষ মানুষের জন্য কমপক্ষে ২৫/৩০ কিসিমের চুলকাটা হয়ে থাকে যেমন - আর্চকাট, বোল্ডকাট, ব্যাঙ্গস্কাট, ব্লকড্কাট, নেপকাট, বোলকাট, বাজ্কাট, সিজারকাট, ক্ল্যাসিক টেপার কাট, μুকাট, ফেডকাট, ফ্ল্যাটটপকাট,
গ্র্যাজুয়েশনকাট, হাই অ্যান্ড টাইট কাট, আইভি লীগ কাট, মুলেটকাট, লেয়ারকাট, পম্পেডোরকাট, সাইডবার্নস্কাট, নেপকাট, শ্যাগকাট, টেক্সারকাট, টেপার্ডনেপকাট, ট্র্যামলাইন্সকাট (চ্যানেলিংকাট), আন্ডারকাট, হোয়াইটওয়ালকাট, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাই যেসব পুরুষ লম্বা চুলে ফ্যাশন করতে চান তাঁরা নাপিতের দোকানে না গিয়ে Hairdressing Salon-এ যান। Hairdresser-রা এর চেয়ে বড় যে কাজটি করেন তা হল মহিলাদের বিভিনড়ব রকমের চুলের সেবা প্রদান। চুল ছাঁটা, চুল কাটা, কার্ল করা, পার্ম করা, ডাই করা, শ্যাম্পু করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই দেখা যায় ঐধরৎফৎবংংরহম-এর মাধ্যমে ইদানীং চুল কাটা পেশা ও ব্যবসা
৮
বিশালভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু সে কাজগুলোর অকিাংশই নাপিত বা ‘ইধৎনবৎ'-দের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। নাপিতদের দোকানে যেমন নাপিত-দ- থাকে, আধুনিক Hairdressing এ কিন্তু এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
এবার আসি আমার ব্যক্তিগত কথায়। আমি ১৯৭৯ সালে যখন প্রম কানাডা আসি তখন মাত্র একজন ছাত্র। আয়উপার্জন একেবারেই সামান্য। দোকানে গিয়ে ১০ ডলার দিয়ে চুল কাটার সামর্থ্য ছিল না। প্র ম প্রম কোনো কিছু কিনতে গেলে স্টিকারে দাম দেখে সাথে সাথে ২০ দিয়ে পূরণ করতাম (তখন এক ডলারে ২০ টাকা পাওয়া যেত)। মনে করতাম ২০০ টাকা দিয়ে চুল
কাটাব, থাক লাগবে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার সামনের দিকটা আনাড়ি হাতে নিজে নিজে কাঁচি দিয়ে কাটতাম। পেছনের দিকটা জংলিই থেকে যেত। তারপর কিছুদিন আমার চুল কেটে দিতেন সহৃদয় বন্ধু হায়দার আলী ভুঁইয়া। যখন আমেরিকা চলে এলাম তখন প্র ম দিকে আমার এবং আমার ছেলের চুল কাটা হত ঘরেই, আমার স্ত্রীর বদান্যতায়। এক সময় এ কাজে যখন বেগমসা’ব অব্যাহতি নিলেন তখন শুরু করলাম এক নাপিতের দোকানে যাওয়া। সেখানে যাঁরা চুল কাটতেন তাঁরা ছিলেন বৃদ্ধবয়সী
দুই ভাই। আমি ও আমার ছেলে চুল কাটাতাম ৫ ডলার মজুরি দিয়ে, তার ওপর টিপস্ দিতাম ৫০ সেন্ট। কয়েকবছর পর দুই ভাইয়ের দোকানও বন্ধ হয়ে গেল। এরপর আর সুবিধামত নাপিতের দোকান খুঁজে পেলাম না। তখন যাওয়া শুরু করলাম Chain Hairdressing Salon-এ। ফ্র্যাঞ্চাইজের নাম Great Clips। এখনো এ Salon-এ-ই যাই। আমি প্রমে নিতাম ফেডকাট। এখন নেই নাম্বার ফাইভ বাজ্কাট। পুরুষদের চুল কাটার মধ্যে এটা একটা অন্যতম সহজ সরল স্টাইল। মজুরি একই তবে সময় অনেক কম লাগে।এতে কাঁচি ব্যবহার করতে হয় না। শুধু ক্লিপার দিয়েই কাজ চলে যায়।
৯
বাজ্কাটে সমস্ত মাথার চুল একদম এক মাপে সমান করে কাটা হয়। আপনি ইচ্ছে করলে ১”, ১/২”, ১/৪” করে চুল কাটাতে পারেন। এমন কি একদম গোড়ায় কেটে মাথা নেড়াও করতে পারেন। বাজ্কাটের ক্লিপারের নাম্বার আছে। ১ নাম্বার ক্লিপার ব্যবহার করলে মাথা মোড়ানো হবে। ৫ নম্বর ক্লিপার আপনার চুলকে ১/৪” রেখে সমানভাবে কেটে দেবে। সবচেয়ে কম সময়ে যদি চুল কাটাতে চান তা হলে বাজ্কাট নিন। ২০১৬ সালের রোজার ঈদের দু’তিন দিন আগে আমি বাড়ির কাছে হাইওয়ে ১০০-এর এৎবধঃ ঈষরঢ়ং-এ গিয়েছি চুল কাটাতে। কাজ সেরে ফিরে এসেছি রেকর্ড সময়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাত্র সাড়ে ৪ মিনিটে চুল কাটিয়ে সেলন
থেকে বেরিয়ে এলাম। আধামিনিট ওয়েটিং এরিয়ায় বসেছি, সাড়ে তিন মিনিটে কাজ সারা, আধামিনিটে দাম পরিশোধ। এটা আমার জীবনে সবচেয়ে কম সময়ে চুলকাটানো। আপনাদের কারো এমন সুখের অভিজ্ঞতা আছে কি? এ ঘটনা থেকেই আমার আজকের এ লেখার সূত্রপাত। সবশেষে আরেকটি প্রাসঙ্গিক ও বাস্তব মজার ঘটনা বলেই আজকের মত বিদায় নেব। ১৯৬০ দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বড়ভাই পড়তেন। তাঁর এক বন্ধু ছিলেন। ধরুন, তাঁর নাম, আকরাম। আকরাম ভাই নতুন প্রেমে পড়েছেন। তাঁর গার্লফ্রেন্ড থাকতেন শামসুনড়বাহার অথবা রোকেয়া হলে। তাই তিনি প্রায় প্রতিদিন বিকেলবেলা মেয়েদের হল-গেটের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতেন। মাঝে মধ্যে বড়ভাইকেও সঙ্গে নিতেন। তেমনি একদিন দুই বন্ধু মিলে সন্ধ্যার সময় গিয়েছেন হলগেটে। যথারীতি বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে দু’জনের। ফিরে আসার সময় অকরাম ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড তাঁকে বললেন, ‘আজ আপনাকে ‘নরসুন্দরের’ মত লাগছে’। বুঝতেই পারছেন, প্রেমিক-প্রেমিকার নতুন সম্পর্ক, ‘আপনি’ থেকে তখনো ‘তুমিতে’ গড়ায়নি। বড়ভাই দেখলেন বান্ধবীর মন্তব্যে আকরাম ভাই মনে মনে বেশ খুশি। রিক্সায় উঠেই তিনি বললেন, ‘তুই জানিস, ‘নরসুন্দর’ মানে কী?’,
১০
‘হ্যাঁ, ‘নরসুন্দর’ মানে সুন্দর পুরুষ’, উত্তর দিলেন আকরাম ভাই। বড়ভাই, বন্ধুকে বললেন, ‘ওরে বেকুব, ‘নরসুন্দর’ মানে সুন্দর পুরুষ নয়, এর অর্থ নাপিত - নাপিত’। আকরাম ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন কিনা সেটা বড়ভাইকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি, তবে প্রেমটা যে পরিণতি পায়নি সে কথা আমি জানি।
লেখক: অর্থনীতির অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি
১৫ জুলাই. ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস