বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬, ১০:২৮:৫৪

পাপড়ি

পাপড়ি


শেষ বিকেলের রোদে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে,দেখে মনে হচ্ছে যেন মেয়েটা রোদের জোছনায় ভিজে যাচ্ছে।খুব সেজেছে বললে ভুল হবে।নিজেকে পরিপাটি করে হাঁটছে,পায়ের ছন্দে একে যাচ্ছে রোদের আল্পনা।আর কতটা মোহময় হলে কাউকে অপ্সরী বলা যায়,নীলের কাছে কেন যেন তাকেততোটাইএমনই লাগছে।
নৌকাটা দুলছে বেশ।ঠিকভাবে বসে থাকা যাচ্ছেনা।ছাউনিটার পাশ ধরে দাঁড়িয়ে অনেকটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে সে মেয়েটার দিকে।আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো মেয়েটা।এখন মনে হচ্ছে এই গ্রামটাকেই ভালো লাগছে।নৌকা থেকে এখানেই নামা যাক।বাসা থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে বের হওয়ার পর কোন জায়গাতেই এমন থাকতে ইচ্ছে হয়নি।কেমন যেন একটা অদ্ভুত মোহমায়া কাজ করছে নিজের ভেতর।ভেজা মাটিতে নেমে মাঝির হিসেব মিটিয়ে হাঁটতে থাকে সে।এতটা আপন লাগছে কেন এই মাটি,এই বাতাস।
বটগাছটার নীচে বসে হাল্কা লাগছে অনেকটা।খুব দ্রুত একটা থাকার জায়গা বের করতে হবে।তেমন মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।সমস্যাটা কি গ্রামটার।খুব ক্লান্ত লাগছে,ঘোর ঘোর লাগছে।আজব ব্যাপার তো।নীল ঘুমিয়ে গেলো।ঘুম ভাঙল একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে।ভয় ভয় লাগছে,নীল কোনভাবেই স্বপ্নটা মনে করতে পারছেনা।সন্ধ্যা হয়ে আসছে,ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল সে।অনেকটা দূরে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে দৌড়ে যাচ্ছে কোথাও।বিকেলটা এখনো হলদাভো।আরেকটু কাছে যেতেই দেখা গেলো সেই নদীর পাঁড়ের মেয়েটা।এতো দ্রুত যাচ্ছে কোথায়।হঠাৎ আবার মিলিয়ে গেলো।কি অদ্ভুত।
কুঁড়ে ঘর,ভাঙ্গা বললে ভুল হবে।ধ্বংসাবশেষ বলা যায়।বিশাল একটা আম গাছ ঢেকে রেখেছে পুরো ঘরটা।বেশ বয়স্ক একজন লোক বের হয়ে আসলো।অনেক কথার পর ২০০ টাকা চুক্তিতে একটি ঘর পাওয়া গেলে।খাবারের ব্যাপারটা আজ রাতে এখানেই কিন্তু পরদিন থেকে নিজের।
কার যেন হাসির শব্দে খুব ভোরে ঘুম ভাঙল নীলের।ছোট্ট জানালাটা দিয়ে তাকিয়েই অবাক,সেই মেয়েটি কথা বলছে বৃদ্ধ লোকটার সাথে।হুড়মুড় করে উঠে বের হয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালো।কোন কথাই বলতে পারছে না সে।এতো সুন্দর হয় কিভাবে মানুষ।এতো নিখুঁত সৃষ্টি বিধাতার।অসম্ভব বোঁচা একটা নাক এইভাবে কোন মেয়েকে অপ্সরী বানিয়ে দিতে পারে এই মেয়েটাকে না দেখলে জানা হতো না হয়তো।কথা শেষ করেই মেয়েটা চলে গেলো।কি যেন রেখে গেলো নীলের আস্তিনে,চোখের কোনায়,কানের কাছে থাকা স্নিগ্ধ বাতাসে।
বৃদ্ধের কাছ থেকে জানা গেলো মেয়েটার নাম মিষ্টি।এই গ্রামের মাতবর সাহেবের বড়ো মেয়ে।শহর থেকে পড়ালেখা শেষ করে গ্রামে এসে একটা স্কুল দিয়েছে।পাশের একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে নাস্তা সাড়তে হল তাকে।মাথায় শুধু একটাই চিন্তা।মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে গেলো স্কুলের সামনে।তারপর প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে।কিন্তু এখানে তো কেউ নেই।জানা গেলো দুপুরের পর আসে ও।অপেক্ষা করতেও কেন যেন ভালো লাগছে নীলের।


আপনি কি এই গ্রামে নতুন?কারো অতিথি?বেড়াতে এসছেন?একটানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে মেয়েটা।একটা প্রশ্নও কানে ঢোকেনি তার।সেই একই কণ্ঠ শুনে চমকে উঠে যেন বধির হয়ে গেছে সে।
-কি ব্যাপার?কথা বলছেন না কেন?
- হুম
-কি হুম?
-না মানে
-কি?
-এমনি,না মানে এমনি ,ও হ্যাঁ।বাসা থেকে বের হয়েছিলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদীটা গেছে আমি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখি অনিন্দ্য সুন্দরী একজন নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটছে।কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। কি যেন মনে হল জানিনা,আমি নৌকা থেকে নেমে গেলাম।ঠিক করলাম এই গ্রামটাতে কিছুদিন থাকব।আজ সকালে দেখেছি তাকে।এখন বুঝতে পারলাম আপনিই সেই।কথাগুলো বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করল নীল।আর পেছন ফিরে তাকালও না।সে ঠিকই বুঝতে পারছে মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।মাঝে মাঝে কাউকে অবাক করে দিতে বেশ ভালোই লাগে।
প্রবল জ্যোৎস্না।যেন চারদিক ভেসে যাচ্ছে।এমন নিশুতি রাত,যুবতী চাঁদ থেকে টুপটাপ শব্দে রুপালী আলো নামছে।আচ্ছা মেয়েটা এখন কোথায়?মেয়েটা কি এই সুন্দরকে অবহেলা করছে,নাকি প্রকৃতি বঞ্চিত করছে তার চেয়েও সুন্দর কাউকে।
পরদিন আবারো ঘুম ভাঙল সেই একই শব্দে।কিন্তু এবার ঘরের দরোজা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে কেউ।
কানের কাছে শো শো শব্দে বাতাস বইছে।সামনে মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে।
-আপনি?
-হুম,হাত মুখ ধুয়ে বের হন।অপেক্ষা করছি।যান তাড়াতাড়ি করুন।
-জ্বী



দশম শ্রেনির বাংলার ক্লাস নিয়ে বের হয়ে নিজেকে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী লাগছে নীলের।কতো অবলিলায় মেয়েটি ওকে বলল একটা ক্লাস নিয়ে নিতে।ও কিছুই বলতে পারলো না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর এবারই প্রথম নিজেকে দ্বায়িত্বপূর্ণ কিছু মনে হল তার।নিজেকে অসামাজিক ভাবা নীলের কাছে আজ অনেকটা সামাজিকই মনে হচ্ছে নিজেকে।মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছে।আচ্ছা,মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর কেন।আচ্ছা ও কি প্রেমে পড়ে যাচ্ছে?ঘামতে শুরু করেছে আবার সে।কানের কাছে সেই শব্দ।
বেশ কিছুদিন পেরিয়েছে।কতদিন নীলের মনে নেই।শুধু অপেক্ষায় দিন কাটে।কখন ভোঁর হবে,ঘুম ভাংবে সেই কণ্ঠে।আবার স্কুল,আবার দেখা সেই হাসি।হিসেব মিলানো বিধাতার ধাঁধাঁর।

আজ যেভাবেই হোক মিষ্টিকে বলতে হবে ভালোবাসি।বলতেই হবে।ও আজ আসেনি।একটা ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে স্কুলে চলে যেতে।আচ্ছা কিভাবে বলা যেতে পারে ওকে?
মনে মনে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগলো সে।
-আগামিকাল চলে যাব ভাবছি।
-বলেন কি?আরও কিছুদিন থেকে যান না।
-উহু
-কেন?
-আমার পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, সবকিছুরই সংজ্ঞা বদলে গেছে।
-কেমন?
-জানিনা কিংবা জানি,বলবনা হয়তো।আমার বেশ সমস্যা হচ্ছে।আগে জ্যোৎস্না দেখলে চোখ দিয়ে পানি পড়ত,এই চোখ তীব্র সুন্দর সহ্য করতে পারে না।আগে আকাশ দেখলে ভেসে যেতে ইচ্ছে করত।গুনগুন করে গান গাইত মন।আগে ফুটন্ত গোলাপ দেখলে স্পর্শ করতে চাইত হাত,আঙ্গুল ছুটে যেত ফুলের নরম পাপড়িতে।চোখ বন্ধ হয়ে যেত তীব্র সুন্দরের আবেশে।এখন আর এমন হয়না।কেন হয়না জানেন মিষ্টি?
আপনাকে দেখার পর মনে হয়েছে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারেনা।প্রকৃতি কিছু কিছু জায়গায় তার ক্ষমতা দেখিয়েছে,সুন্দরের ক্ষমতা।ভালবাসার ক্ষমতা।মনে আছে আপনার,হঠাৎ আপনার হাত আমার হাতে লাগায় কিভাবে চমকে উঠেছিলাম আমি।সেদিন বুঝেছি সব বদলে গেছে আমার।

শোরগোলে ধ্যান ভাঙল নীলের।দূর থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।স্কুলে আগুন লেগেছে।
উদ্ভ্রান্তের মতো সেদিকে ছুটতে থাকে সে।
স্বপ্নটা মনে পড়েছে।একটা লাল গোলাপ বাগান।অনেক দুরে একটা বিশাল আম গাছ।একটা ডানাকাটা পরীকে কে যেন তাতে বেঁধে রেখেছে।কোত্থেকে যেন আগুন ছুটে আসছে।সে ছুটে যাচ্ছে পরীকে বাঁচাতে।কিন্তু আগুন আম গাছ পেরিয়ে চলে এসেছে তার শরীরে।
নীল যখন স্কুলের সামনে পৌঁছল ততক্ষনে তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এসছে।কালো ধোঁয়ায় জ্ঞান হারাল সে।

আট মাস পরঃ

প্রতিদিন সকালে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় নীলকে।মানসিক এই হাসপাতালের সবার ঘুম ভাঙ্গে তীব্র শব্দের এক চীৎকারে।যা নীল বলতে পারেনি মিষ্টিকে।তাই হয়তো বলে যায় অবুঝ মনে,অপেক্ষায়,ভালবাসায়।প্রকৃতি হয়তো এতো ভালোবাসা সহ্য করতে পারেনা।হয়তো তাই আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকে একটি কান্না মিশ্রিত চিৎকার।
লেখক: শিহাব মাসুম
২১ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে