প্রবাস ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশি ইমামসহ দু'জনকে হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে আবারও বিক্ষোভ করেছে দেশটিতে অবস্থানরত হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
স্থানীয় সময় সোমবার দুপুরে নিউইয়র্ক সিটির ওজোনপার্ক এলাকায় দুদিন আগে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত ইমাম মাওলানা আলাউদ্দিন আকঞ্জি (৫৫) এবং তার সহকারী থেরাউদ্দিনের (৬৪) জানাযার প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত এক শোক সমাবেশ শেষে তারা এ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
এর আগে, শোক-সমাবেশে নিউইয়র্ক সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাসিয়োও বক্তব্য রাখেন। নিহতদের স্বজনদের উপস্থিতে মেয়র মুসলিম সম্প্রদায়কে নিউইয়র্ক সিটি তথা যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতির অংশ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘ইসলাম ধর্মে একজন মানুষের মৃত্যু হবার ঘটনাকে শুধুমাত্র সেই পরিবারের ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, পুরো একটি কমিউনিটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা বহু জাতি ও বহু ধর্মের সম্মিলনে বিশ্বাসী, এরই মধ্যে ইমামসহ এই দু'জনকে হারিয়ে গভীরভাবে ব্যথিত। এই হারানোর যন্ত্রণা সকলকেই পীড়া দিচ্ছে।’
জানাযার প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত শোক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাসিয়ো। মেয়র বলেন, ‘আমাদের এই সিটিতে মুসলিম কমিউনিটি রয়েছেন, তাদের পাশে রয়েছে এনওয়াইপিডি। আজ যা দেখছেন, কাল থেকে আরও বেশি পুলিশ থাকবে মসজিদভিত্তিক কমিউনিটির নিরাপত্তায়।’
এর আগে, গত শনিবার যোহরের নামাজ পরে ওজনপার্ক এলাকার আল ফোরকান মসজিদ থেকে সহকারী থেরাউদ্দিনকে সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় ৩৫ বছর বয়েসী এক হিসপ্যানিক ইমাম আকঞ্জি এবং সহকারী গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই হত্যার বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ পদর্শন করেন। পরে আশপাশের ভিডিও থেকে ঘাতকের ছবি দেখার পর রবিবার দিবাগত রাত ১২টার পর অস্কার মোরেল নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছে। রবিবার সমাবেশ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার না দেখানো হলেও পরদিন সোমবার ওই হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
ইমামসহ এই দু’জনকে গুলি করে দ্রুত পলায়নের সময় এক সাইকেল আরোহীকে ধাক্কা দেয় দুর্বৃত্তের গাড়ি। এরপর সে দ্রুত পালিয়ে যাবার সময় ওই সাইকেল চালক তার গাড়ির নম্বর প্লেট লিখে পুলিশকে ফোন করেন। একই নম্বরের গাড়ি আরও তিন মাইল দূরে কর্তব্যরত পুুলিশের গাড়িতেও ধাক্কা দেয় এবং দ্রুত পলায়ন করে। এরপর পুলিশ তল্লাশী চালিয়ে ওই গাড়ি জব্দ করার সময় চালকেও আটক করতে সক্ষম হয়। সে সময় পুলিশের নজর কাড়ে ইমামসহ দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার জন্য প্রকাশিত দুর্বৃত্তের স্কেচ। পুলিশ ওই চালকের ঘরে গিয়ে বন্দুক উদ্ধার করে এবং গুলিবর্ষণকারীর পরণে যে টি শার্ট ছিল, সেটিও পাওয়া যায়। আর এভাবেই ইমাম আকঞ্জি এবং তার সহকারীর ঘাতককে গ্রেফতারের খুব কাছাকাছি পৌঁছা সম্ভব হয়েছে বলে সিটি মেয়র তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। মেয়র বলেন, ‘শিগগিরই সবকিছু খোলাসা হবে।’
এদিকে, জানাযার প্রাক্কালে ইমাম ও তার সহকারীর কফিন সামনে রেখে অনুষ্ঠিত ওই শোক সমাবেশের কয়েকজন বক্তা উল্লেখ করেন যে, ঘাতক গ্রেফতার হয়েছে এবং সে দোষ স্বীকার করেছে বলে পুলিশ তাদের জানিয়েছেন। এ সময় সিটি মেয়রসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে ছিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই সিটি মেয়র তার বক্তব্যে ঘাতক গ্রেফতারের স্পষ্ট কোন তথ্য দেননি। শুধু বলেছেন, ‘আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি যে, শিগগিরই ঘাতক গ্রেফতার হবে এবং তাকে বিচারে সোপর্দ করা হবে।’
গুলিতে নিহত দুই বাংলাদেশি বামে ইমাম আলাউদ্দিন আকঞ্জি ও ডানে তারা মিয়া। মেয়র বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য-বিবৃতি সারা আমেরিকায় ঘৃণার বিস্তার ঘটিয়েছে, আমাদের মধ্যে বিভক্তির চেষ্টা করা হচ্ছে, একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি এখানে দেখছি আমার সকল ভাই ও বোনেরা জড়ো হয়েছেন। আমি দেখছি গর্বিত আমেরিকানদের। এবং আমি কখনোই আমাদের মধ্যে বিভক্তির ষড়যন্ত্রকে সফল হতে দেব না। আমাদেরকে বিভক্ত করে, এমন কোন কথা আমি শুনতে চাই না। এবং আমরা এমন কিছুকে অব্যাহত রাখতে চাই না, যা ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়।'
তিনি বলেন, আমরা সম্প্রীতির বন্ধনকে সুসংহত করার জন্য সব সময় সোচ্চার রয়েছি। যে যা যারাই এমন হিংসাত্মক অপকর্ম করুক না কেন, তাকে বিচারে সোপর্দ করবোই। এ ব্যাপারে আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি।’
‘এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই নিউইয়র্কের পুলিশ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে দুর্বৃত্ত শনাক্ত ও পাকড়াওয়ের জন্য। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। আমি আপনাদের জানাতে চাই যে, শুধুমাত্র ঘাতককে সন্ধানই নয়, কেন সে এমন হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছে, তার কারণও উদঘাটন করব এবং সর্বসাধারণের সামনে তা উপস্থাপন করবো’-বলেন মেয়র।
দুই বাংলাদেশি হত্যায় গ্রেফতার ব্রুকলিনের বাসিন্দা অস্কার মোরেল। অর্থাৎ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিই ইমামসহ দুই বাংলাদেশির ঘাতক কিনা-সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ না করায় জানাযা শেষ হবার সাথে সাথে কমিউনিটি কর্মী আকতার হোসেন বাদলের নেতৃত্বে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে ফেটে পড়েন সকলে। হঠাৎ করেই বদলে যায় সবকিছু। সমলেই সমস্বরে একই স্লোগান ধরেন। আওয়াজ উঠে ‘উই আর মুসলিম-নট টেররিস্ট’, ‘উই ওয়ান্ট পিচ’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘মসলিম লাইভস ম্যাটার’ ইত্যাদি। সকলের মধ্যেই প্রচণ্ড ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়। ঘাতকের গ্রেফতার নিয়ে লোকোচুরি খেলার কঠোর সমালোচনা করেন অনেকে। এক পর্যায়ে পুরো ওজনপার্ক মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। তবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
শোক-সমাবেশে সিটি মেয়রের বক্তব্যের পর সিটি কম্পট্রোলাল স্কট স্ট্রিঙ্গার, সিটি পাবলিক এডভোকেট লেটিসা জেমস প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। তারাও ইমামসহ দু’জনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। জানাযা শেষে তারা মিয়ার লাশ নেয়া হয় লং আইল্যান্ডে ওয়াশিংটন মেমরিয়্যাল গোরস্থানে। ইমাম আকঞ্জির লাশ নেয়া হয় জেএফকে এয়ার এয়ারপোর্টে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য।
জানাযায় সর্বস্তরের প্রবাসী অংশ নেন। রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, সম্পাদক, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী তথা মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে কর্মরত প্রায় প্রতিটি সংগঠনের প্রতিনিধি ছিলেন।-বিডি-প্রতিদিন
১৬ আগস্ট,২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/আ শি/এএস