রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে : সারা বিশ্বের মানুষ করোনা থেকে রেহাই পেতে সব কিছু করছে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার জন্য। এখন আমরা যতক্ষণ বেঁচে আছি সে সময়টুকুর দিকেও তো একটু নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে যার সমাধান নেই তার পিছে সব সময় দিতে গিয়ে যা আছে তাকে ভুলে গেলে তো চলবে না। জীবন মানে শুধু অন্ধকার না। রাতের পর দিন ঠিকই আসছে।
সেক্ষেত্রে আসুন একটু ভিন্ন কিছু নিয়ে ভাবি। ভাবি নতুন প্রজন্মদের নিয়ে, ভাবি তাদের সাধ আহ্বলাদের কিছু সময় নিয়ে। হারিয়ে যাই তাদের সামান্য চাওয়া পাওয়ার মাঝে কিছুক্ষণ। আমার ঢাকা রেসিডেন্সিয়াস মডেল কলেজের বন্ধু নাজমুল হুদার একমাত্র মেয়ের নাম 'আয়ানা'। সে লন্ডন প্রবাসী ব্রিটিশ বাংলাদেশী। বয়স ছয় বছর।
এ বছর আয়ানার জন্মদিন উপলক্ষে নাজমুল এবং তার সহধর্মীনি রুবি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ বাংলাদেশী তারা সবাই ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে প্লান করেছে মেয়ে আয়ানার জন্মদিন পালন করবে স্টকহোমে। এবারের জন্মদিনে আয়ানা স্টকহোমে আসবে পুলকা করতে। পুলকা কি? পুলকা হলো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিশুদের তুষারে খেলার এক বাহন।
সুইডেনে বাচ্চারা শীতে বরফের মধ্যে প্লাস্টিকের তৈরি লম্বা স্লীপারি এই পিঁড়ি নিয়ে ঢালু বরফের পাহাড়ের উপর যায়। তারপর এই পিঁড়ির ওপর শিশুরা বসে আর মুহূর্তের মধ্যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচেই নেমে আসে। পুলকায় করে ওপর থেকে নিচে দ্রুত গতিতে নামার সময় তারা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে। তাই প্লান করেছি আয়ানা তার জন্মদিনে সুইডিশ শিশুদের সঙ্গে তুষারে পুলকার আনন্দটি উপভোগ করবে।
তারপর বাল্টিক সাগরের ওপর দিয়ে তাকে পুলকায় করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাব। এসব প্লান করা হয়েছে তার জন্মদিনের এক্টিভিটিস হিসাবে। কিন্তু গত হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজলেও পাওয়া যাবে না কোন ফেব্রুয়ারি মাস তুষার ছাড়া স্টকহোম! জানুয়ারি মাস পার হয়ে গেল তুষার ছাড়া! তারপর যথারীতি ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হলো কিন্তু স্টকহোমে তুষারের দেখা নেই। কি ব্যাপার?
আয়ানা বেশ এক্সাইটেড। মাঝে মধ্যে কথা হয় টেলিফোনে, সে জিজ্ঞেস করে পুলকা কোথায়, কিভাবে এবং কোথায় পুলকায় চড়বে, তার জন্মদিনের কেক কিভাবে তৈরি হবে ইত্যাদি। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চললো কিন্তু তুষার পাতের কোন বালাই নেই। আমি বেশ চি'ন্তিত। কি করি; কি বলব আয়ানাকে? ২৩ ফেব্রুয়ারি নাজমুলের পরিবার এসে হাজির অথচ তুষার নেই।
লাঞ্চ সেরে স্টকহোম থেকে জাহাজে করে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিনকির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। জার্নি শুরু হোল বিকেল সাড়ে চারটায় আর সেখানে পৌছব পরের দিন ফিনিশ সময় সকাল দশটায়। আমাদের জাহাজটি জাহাজ তো নয় যেন পুরো একটি শহর। যেখানে এমন কিছু নেই যা পাওয়া যাবে না। জাহাজে আমাদের ডিনার সঙ্গে নানা ধরনের এক্টিভিটিস ছিল।
জাহাজ কর্তৃপক্ষকে বললাম আয়ানার জন্মদিন তারা জন্য এক্সট্রা কিছু করতে। যেমন ডিনারে সুইডিশ প্যানকেক যেন মেন্যুতে থাকে। তারা বললো যে প্যানকেক থাকবে না তবে অন্য খাবার থাকবে। আমার মেজাজ একটু খারাপ হয়ে গেল। বললাম আয়ানা তো খায়ই প্যানকেক অথচ তা নেই এটা তো হতে পারে না। জাহাজ কর্তৃপক্ষ বেশ সমস্যার মধ্যে পড়ল।
পরে তাড়াহুড়ো করে আয়ানার জন্য পানকেকের ব্যবস্থা করল। প্যানকেক দেখতে রুটির মত তবে বেশ নরম। এটা খেতে হয় ক্রিম এবং স্ট্রব্যারি জেলির সঙ্গে যা খেতে খুবই সুস্বাদু। ডিনার শেষে সবাই ঘুমাতে গেলাম। সকালে উঠতে হবে। পুরোদিন ঘুরব হেলসিনকি শহর। পরের দিন সকাল দশটায় জাহাজ থেমে গেল হেলসিনকিতে। আমাদের আগমনে সারোয়ার ভাই পোর্টে এসেছেন।
তিনি আমাদের ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। থাকেন সেখানেই। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিজেদের মত করে হেলসিনকি শহর মনের মত করে ঘুরলাম। একটা নয় দুই দুটি ভালবাসার সেতুর ওপর দিয়ে ভালোবাসাকে মনে মনে ভ্যালিডেট করলাম আমরা সবাই। সাগরপাড়ে রয়েছে ফিনিশ স্যালুহল, ঢুকে গেলাম সেখানে। হঠাৎ দেখা হলো আমেরিকান এক দম্পতির সঙ্গে।
বেশ মজা করলাম তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ নানা বিষয়ের ওপর। পরে জানতে পারলাম তারা যাবে নর্দান লাইট দেখতে যা শুধু স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তরে শীতের সময় দেখা যায়। নর্দান লাইট দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক আসে এখানে। অপূর্ব সুন্দর, বিভিন্ন রংয়ের সমন্বয়ে এ সুমেরু প্রভা যা নর্থ অব সুইডেনের আকাশ জুড়ে নাচতে দেখা যায়।
গল্প করতে করতে চোখে পড়ল ফিনল্যান্ডের নানা ধরনের মজাদার খাবার যা না খেলেই নয়, তাও সবাই খেলাম। আয়ানার সঙ্গ ফিনিশ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তার জন্মদিনে ফিনিশ ফিকা সেরে সবাই রওনা দিলাম জাহাজের উদ্দেশ্যে। বিকাল চারটার আগেই জাহাজে এসে হাজির হলাম। জাহাজ ছেড়ে দিল সাড়ে চারটায়। সারা বিকাল এবং রাত জাহাজে কাটিয়ে পরের দিন সকালে স্টকহোমে ফিরলাম।
ট্যাক্সি করে বাসায় এসে চলে গেলাম বাড়ির পাশের ওয়েস্টফিল্ড মলে। সেখানে লাঞ্চ সেরে বাসায় এলাম। আজ আয়ানার জন্মদিন পালন করতে হবে সুইডিশ স্টাইলে। আমার স্ত্রী মারিয়া এবং আয়ানা দুজনে মিলে লেগে গেল জন্মদিনের স্পেশাল কেক তৈরির কাজে। আয়ানা টেবিল সাজাতে লেগে গেল পরে সবাই মিলে কিছুক্ষণ জন্মদিনের আড্ডা শেষে সুইডিশে জন্মদিনের গান— jag må hon leva hundrade år গেয়ে দিনটি পালন করলাম।
পরের দিন নাজমুলরা লন্ডন চলে যাবে। কিছুক্ষণ সবাই বাল্টিক সাগরের পাড়ে হাঁটাহাঁটি এবং পরে শপিং শেষে তাদেরকে এয়ারপোর্টের বাসে তুলে দিলাম। বাসায় আসতে না আসতেই হঠাৎ মুশল ধারে তুষারপাত শুরু হলো। আশ্চর্য না হয়ে কি কোন উপায় আছে? বেচারা আয়ানা এসেছিল পুলকা করতে অথচ তুষারের বালাই চোখে পড়ল না। আর যেদিন সে চলে গেল ঠিক সেই মুহূর্তে স্টকহোম তুষারে ঢাকা পড়ে গেল। লেখক : রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন