শামছুজ্জামান নাঈম: ছোট বেলায় সামাজিক কোন প্রোগ্রামে গেলে একজন সাংবাদিককে দেখতাম যিনি তৎকালীন সময়ে ইয়াসাকা ক্যামেরায় ছবি তুলতেন। ২/৩ দিন পর প্রকাশিত নিউজের একটা প্রিন্ট এনে দেখাতেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিসহ আয়োজকরা সবাই তাঁর সঙ্গে খুব তোয়াজ করে কথা বলতেন। বয়সে অনেক ছোট হওয়া স্বত্বেও 'সাংবাদিক সাহেব' বলে মুরুব্বীরা তাকে খুব সন্মানের সঙ্গে ডাকতেন।
এক সময় একজন মুরুব্বীর কাছে জানতে চাইলাম তাকে সবাই এত সন্মান করে কেন? জবাবে তিনি জানান- সাংবাদিকরা হলেন জাতির বিবেক, তাদের বজ্রকঠিন লেখনির মাধ্যমে সমাজে অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন মাথা উঁচু করতে পারে না। তাই তাদেরকে সবাই সন্মান করে। লোকটার সন্মান দেখে ভবিষ্যতে সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতাম।
অবাক করা ব্যাপার হল সেই আমিই এক সময় গণমাধ্যমকর্মীর খাতায় নাম লেখাই। যুক্ত হই গণমাধ্যমের মুলধারার সঙ্গে। বন্ধুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠি। কিছু ভালো লেখনির জন্য অনেকের কাছ থেকে বাহবা পেতে থাকি। গর্ববোধ করি নিজের সাংবাদিক পরিচয়ে।
কিন্তু কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবরে মনটা হু-হু করে কেঁদে উঠছে। জানতে পারি- দেশের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন কিছু বিপদগামী গণমাধ্যমকর্মী। অন্যদিকে কিছু লোক আবার অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ধরা পড়ার পর নিজেদের বাঁচাতে ভূয়া সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। গণমাধ্যমের একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে এমন খবরে বিব্রত হই।
দেশ কিংবা জাতি তো আমাদের কাছে এমনটি প্রত্যাশা করে না। তাহলে কেন গণমাধ্যমের কোন কর্মী এমন সব অন্যায় কাজে জড়াবে। আসুন কিছু নষ্ট মানুষের আমলনামা দেখে আসি-
ঘটনা- ১ প্রতারণার অভিযোগে সাংবাদিক পরিচয়ধারী ১২ জনকে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারা নিজেদের সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রা, বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি, দৈনিক আজকের বিনোদন, অন্যায়ের প্রতিবাদসহ আরো বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। ওই ১২ জনকে চ্যালেঞ্জ করলে তারা তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। তৎক্ষণাৎ প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদেরকে আটক করে।
ঘটনা- ২ চট্টগ্রামের কোতয়ালি থানার ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় একটি নোহা মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ সেলিম ও তার স্ত্রী মুন্নি আক্তারকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
ঘটনা- ৩ কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় এক হাজার ৩৫০ পিস ইয়াবাসহ মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী নামে এক ভুয়া সাংবাদিককে আটক করেছে পুলিশ।
ঘটনা- ৪ নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজারে চার মাদক কারবারিকে র্যাসব সদস্যরা আটক করলে তাদের মধ্যে জুয়েল নামের একজন নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন।
ঘটনা- ৫ সাংবাদিক পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদা আদায় করার অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মোরসালিন হক ও ফয়সাল আজম নামে দুই 'ভুয়া সাংবাদিক'।
ঘটনা- ৬ সাংবাদিক পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে মো. মাহমুদ (২৭) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে র্যাাব।
ঘটনা- ৭ ফেনসিডিল ও প্রেস লেখা মোটরসাইকেলসহ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আকন্দবাড়িয়া থেকে সিরাজুল ইসলাম নামে এক ভুয়া সাংবাদিককে আটক করেছে পুলিশ।
ঘটনা- ৮ টাকা নিয়ে তাজা খবর-২৪ নামে একটি নামসর্বস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টালে পক্ষে বিপক্ষে মনগড়া নিউজ করে তা লিফলেটের মত বিলি করার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় শাহ-আলম নামে এক ভুয়া সাংবাদিককে আটক করে গণপিটুনি দেয় জনতা।
মালয়েশিয়ায় আইন বিভাগে অধ্যয়নরত মো. রায়হান খাঁন। তাঁর খুব কাছের একজন বড় ভাই স্থানীয় একটি রাস্তা মেরামতের কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হলে প্রতিপক্ষের কারো যোগসাজশে কোন এক সময়ে এক নেতার পুত্রের সঙ্গে ধারণকৃত তাঁর একটি ছবি স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশ করে বলা হয় এ ছবি দিয়ে তিনি প্রভাব বিস্তার করছেন। খবরে আরও বলা হয় তিনি কোন ধরণের অন্যায় কাজে জড়িত নন, তাঁর নামে কোন মামলা নেই, নেই কোন অভিযোগ। কিন্তু এখন থেকে যদি তিনি কোন অন্যায় করে থাকেন তাহলে তাকে রুখবে কে।
একজন মানুষ কোন অন্যায় না করে যদি ভবিষ্যতে করতে পারেন কিংবা করলে তা রুখবে কে এমন নিউজ গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া তিনি (সাংবাদিক) কোন নিয়মের মাঝে ফেলে এমন একটি রিপোর্ট করেছেন তা আমার ক্ষুদ্র মাথায় ধারণ করতে পারছি না। তাছাড়া একজন মানুষকে সামাজিকভাবে হেও প্রতিপন্ন করার হেতু টাই বা কি। পাঠক, আপনারা কেউ পারলে আমাকে বুঝিয়ে বলবেন।
মফঃস্বলে কাজ করা সাংবাদিক ভাইয়েরা রোদবৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনেক কষ্ট করে খবর তুলে আনেন গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে ঘুরে ফিরে। তাদেরকে সকলে সন্মানের চোখে দেখেন। নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আপনজনের মতই শেয়ার করেন। অথচ তাদের এহেন কষ্টের ফল ভোগ করেন কিছু 'হলুদ সাংবাদিক' নামের নষ্ট মানুষ। যারা এক কলম লিখতে তো পারেন ই না বরং ভুয়ামি-ভাঁড়ামি করে বীরদর্পে হেটে বেড়ান। বদনাম হয় সকল সাংবাদিকদের। দক্ষ্য, সৎ, গুণী ও সিনিয়র সাংবাদিকরাও তাদের অত্যাচারে কোণঠাসা হয়ে পড়েন সিনিয়র সাংবাদিকরা।
এমন ভুয়া, দুর্নীতিগ্রস্থ হলুদ সাংবাদিকদের অত্যাচার দিন দিন বেরেই চলছে, আজ সমাজে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ থেকে এমন বিষফোঁড়া দ্রুত উপড়ে না ফেললে তা কান্সারের ন্যায় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।
যদি কোন ব্যক্তি এমন অন্যায়ের শিকার হন তাহলে ভেঙ্গে না পড়ে সংবাদে উল্লেখিত অপরাধটি করেননি তার সঠিক প্রমানাদিসহ সেই পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও রিপোর্টারের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠাতে পারেন। অন্যথায় তথ্য অধিকার আইন কিংবা ভিক্টিম 'প্যানাল কোর্ট এর সেকশন ৫০১ ধারায় ও কন্সপাইরেসি (ষড়যন্ত্র) এর ৪০৩ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
আসুন, সাংবাদিকদের সুনাম ও ঐতিহ্য রক্ষায় এমনসব 'হলুদ সাংবাদিক' নামের নষ্ট মানুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই।
লেখক- মালয়েশিয়া প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী
১১ জুন, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস