তসলিমা নাসরিন : জঙ্গিরা যা চেয়েছিল, তাই পেয়েছে। বিশ্ব কাঁপাতে চেয়েছিল, কাঁপিয়েছে । অমুসলমানদের খুন করে পুণ্যি কামাতে চেয়েছিল, সম্ভবত তাও কামিয়েছে। এতগুলো মানুষকে অল্প বয়সী ছেলেগুলো কী করে পারলো জবাই করতে! ওরা তো আগে কখনও জবাই করেনি। তাহলে কী করে একজন দু’জন কে নয়, কুড়ি জন কে পারলো জবাই করতে! সত্যি কথা কী, বিশ্বাস মানুষকে দিয়ে অসম্ভব অসম্ভব কাজ করিয়ে নিতে পারে। জঙ্গিগুলোর মগজধোলাই কে বা কারা করেছে আমার জানা নেই, তবে যে তথ্যই তাদের মস্তিস্কে ঢোকানো হয়েছে, তারা তা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করেছে।
অনেকটা চেচনিয়ার দুই বোস্টন বোমারু ভাইএর মতো। দেখতে স্মার্ট, কিন্তু যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা নেই। ধর্ম সত্য, ধর্মগ্রন্থ সত্য, ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা লিখেছেন, তাই যা কিছুই ওতে লেখা আছে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে হবে, কোনো প্রশ্ন নয়, শুধু মেনে নেওয়া। সুতরাং ধর্মগ্রন্থের শুরু থেকে শেষ অব্দি সবকিছুকে ওরা নাক্মুখচোখ বুজে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছে। অ বলতে আসলে অ বোঝানো হয়নি, ভ বোঝানো হয়েছে --- এই চালাকি করে প্রাচীনকে যুগোপযুগি করার চেষ্টা করেনি। অবিশ্বাসীদের মারো বললে অবিশ্বাসীদের মারো-ই বুঝেছে, অন্য কিছু বোঝেনি।
ধর্মান্ধ সমাজে মানুষের মগজধোলাই শুরু হয় জন্মের পর থেকেই। তখন থেকে তারা ধর্মের গুণ গান শুনে আসছে ঘরে বাইরে, ইস্কুলে কলেজে, মাঠে ঘাটে, ট্রেনে বাসে, টেলিভিশনে রেডিয়োয়, সিনেমায় নাটকে। শুনে আসছে ধর্ম মেনে চললে বেহেস্ত মেলে, না মানলে সইতে হয় দোযখের বিভৎস আজাব, ধর্মগ্রন্থে আছে দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান, ধর্মই জ্ঞান, ধর্মই বিজ্ঞান, ধর্মই শান্তি। সবসময় কিছু শুনতে থাকলে তা অবচেতনেই মগজে ঢুকে যায়। মাটিটা তৈরি থাকেই, তার ওপর তাই বিশ্বাসের প্রাসাদ খুব সহজেই বানিয়ে নেওয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানের নিরন্তর গবেষণা, আর এর জটিল অঙ্কের চেয়ে ধর্মের সরল সহজ সমাধান চিরকালই মানুষের প্রিয়। চাষাভুষো থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার-- সকলকেই তাই আকৃষ্ট করে ধর্ম। কারণ ধর্ম বুঝতে যত সহজ ,বিজ্ঞান বুঝতে তত সহজ নয়।
সন্ত্রাসীরা বেশ অনেক কাল হলো নাস্তিক, সেকুলার, যুক্তিবাদি লেখক ব্লগার, সমকামী, প্রগতিশীল ছাত্র শিক্ষক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কে কুপিয়ে মারছে, কোনো মৃত্যুতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেননি। খুনীদের দেশ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে দিয়েছেন। কোনো খুনেরই বিচার করেননি। কাউকে গ্রেফতার করেন নি। কাউকে শাস্তি দেন নি। উল্টে শাস্তি দিয়েছেন নাস্তিক ব্লগারদের। ধরে ধরে ওদের জেলে পুরেছেন। কথা বলেছেন মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে। আইন বানিয়েছেন মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে। মুক্তচিন্তকদের হত্যার জন্য মুক্তচিন্তকদেরই দায়ি করেছেন। আজ ঢাকা ক্যাফের মৃতদের জন্য হঠাৎ তার শোক প্রকাশের সাধ কেন হলো? নিশ্চয়ই বড় কোনো রাজনীতি আছে এর পেছনে। ঢাকা ক্যাফেয় সেদিন যাদের কুপিয়ে মারা হয়েছে, তারা ধনী এবং প্রভাবশালী লোকের সন্তান—এ কারণে? অথবা শহরে সন্ত্রাসী হামলার পর হাসিনা এখন কী করছেন না করছেন দুনিয়া দেখছে বলে!
রাজনীতিকরাই হিপক্রেট, ধর্মের যেটুকু মানলে সুবিধে হয় শুধু সেটুকু মানবো, বাকিটুকু মানবো না –এই মানসিকতার মুসলামগুলোই হিপোক্রেট। বরং ওই জঙ্গিগুলোই হিপোক্রেট ছিল না। তাদের মাথায় যা ঢোকানো হয়েছে, তাই তারা কলের পুতুলের মতো আওড়েছে। নিজের জীবনের মায়াটুকু করেনি, মরবে জেনেই এসেছিলো সেরাতে, বেহেস্তে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করেছে। কেউ তাদের বুঝিয়েছে, বলেছে, শিখিয়েছে, যে, অমুসলিমদের খুন করলে জিহাদের সওয়াব পাওয়া যায়, সর্বোচ্চ বেহেস্তে জায়গা হয়। বিদেশিদের কুপিয়ে মেরে, বর্বরতার চূড়ান্ত করে, সকাল হলে দিশি মুসলমানদের বলেছে -- ‘আমরা এখানে শুধু অমুসলিমদের মারতে এসেছি। তোমাদের মারবো না। তোমরা সবাই চলে যেতে পারো। আমরা তো বেহেস্তে যাচ্ছি’।
সন্ত্রাসীদের মেরে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায় না। সন্ত্রাসের উৎসকে নির্মূল করলেই সন্ত্রাস নির্মূল হয়।
৫ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস