সাদির হোসেন রাহিম, ভোলা থেকে: সময়ের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিকায়নের ধারায় প্রতিনিয়ত মানুষের গতির পরিবর্তন হচ্ছে। কম সময়ে বেশি কাজ করার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধান ভানার কাঠের ঢেঁকিও।
“ও বউ ধান ভাঙ্গেরে ঢেঁকিতে পা দিয়া ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া, বউ ধান ভানোরে ’’ রংপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া এ গানটি এখনও মঞ্চে, মাঠে-ময়দানে মাঝে মধ্যে শোনা যায়। শুধু শোনা যায় না ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ। গ্রাম বাংলার চিরায়িত সেই ঢেঁকি আর ঢেঁকির তালে সেই গান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যেই নবান্নে ধান কাটার উৎসবের সাথে সাথে শীতের পিঠা বানানোর ধুম পড়তো প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, ঢেঁকির তালের শব্দে চালের গুড়া করত মাঝরাত থেকে শুরু করে পরদিন ভোর পর্যন্ত সেই ঢেঁকি আজ আধুনিকতার উৎকর্ষতার দাপটে গ্রামের নব বধুদের কাছে এখন শুধুই স্বপ্ন। ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞান আর সেই সাথে গড়ে উঠেছে শিল্প কল-কারখানা। পরিবর্তন হচ্ছে রুচির, যান্ত্রিক সভ্যতার গ্যাড়াকলে পড়ে বাঙ্গাঁলী সভ্যতার এ শিল্পটি নীরবে নিভৃতে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যদিও এক সময় দ্বীপজেলা ভোলার প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কম বেশি কাঠের ঢেঁকি দেখা যেতো। গ্রামগুলোতে নিয়মিত শোনা যেতো ঢেঁকির ঢাঁক ঢুক ও ক্যু ক্যুা শব্দ। কাঠের ঢেঁকি ব্যাবহারে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলো জেলার মনপুরা এলাকার বাসিন্দারা। এসব এলাকার ঘরে ঘরে এখন আর কাঠের ঢেঁকি চোখে পড়ে না। শোনা যায় না ঢাঁক ঢুক ও ক্যু ক্যুা জাতীয় ছন্দময় শব্দ। চোখে পড়ে না বিয়ে শাদি ও আনন্দ উৎসবে ঢেঁকিতে ছাটা চালের তৈরী ক্ষীর, পায়েস ও পিঠা তৈরীর দৃশ্য।
একসময় ঢেঁকির ধান ভানার শব্দে ঘুম ভাঙতো গ্রামের মানুষের, কাক ডাকা ভোরে শুরু হত ধান ভানার কাজ। ঢেঁকিতে শুধুমাত্র যে ধান ও চাল ভাঙ্গা হত তা নয়। ধান ভানার কাজে গ্রামীণ নারীরা পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করতেন, তারা তাদের সুখ, দুঃখগুলো গ্রামীণ লোকজ গীতের মাধ্যমে সহভাগিতা করতেন। ঢেঁকির উপর পা রেখে গায়ের বধূরা গাইতো গীত, কাটতো শ্লোক, মেতে উঠতো ফিস ফিস মুখরোচক কথায়, তারপর হাসি আর ঢেঁকির শব্দে তৈরী হত এক নতুন ব্যাঞ্জনার সুর। একসাথে ২/৩ জন কোমরে শাড়ীর আচল বেধে ভাঙতো ধান, পরিশ্রম তাদের ক্লান্ত করতে পারতো না। অনেক বিধবা, তালাক প্রাপ্তা ও অসহায় মহিলা ঢেঁকিতে ধান ছেটে জীবিকা নির্বাহ করতো। ঢেঁকি নিয়ে বহু কবি সাহিত্যিক লিখেছেন গল্প, কবিতা, বাউলরা গেয়েছেন গান। কালের বিবর্তনে বাঙ্গালী সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ন উপাদান আমাদের সংস্কৃতি থেকে যেনো মুছে যাচ্ছে।
তজুমদ্দিন উপজেলার মাহারকান্দি গ্রামের ছলেহা বেগম (৫০) বলেন, “ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গনের কাজে আমগো লগে ৩/৪জন মিইল্লা বেগার দেওন লাগতো। ধান ভাঙ্গনের কাজের সময় যদিও একটু বেশিই কষ্ট করোন লাগতো তারপরেও আমাদের গ্রামের মাইয়াগো কাছে পরিশ্রমের বলে মনে অইতো না বরং আমগো কাছে অনেক ভালা লাগতো।
মনপুরা উপজেলার সাকুচিয়া গ্রামের সাফিয়া খাতুন (৩২) বলেন, “ঢেঁকি চাটা চাল খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। এখন
ডাক্তাররা আমাদের এ চালের ভাত খাওয়ার পরামর্শ দেন। আমি বাচ্চাদের জন্য ঘরের খাবার তৈরি, মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য পিঠা তৈরি করতে ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করি। ঢেঁকি চাটা চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি পিঠা অনেক সুস্বাদু হয়। যদিও এখন আর আগের মতো প্রতি বাড়িতে কাঠের ঢেঁকি পাওয়া যায় না, যার কারনে একটু কষ্ট করে হলেও কয়েক বাড়ি পেরিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মত প্রয়োজনের সময় আমাদের ঢেঁকিতে চাল ও পিঠার গুঁড়ো ভানতে হয়”।
স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, গ্রামীণ সংস্কৃতি
চর্চা, গ্রামীণ মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন, আন্তঃনির্ভরশীলতা, সুখ-দুঃখের কথা সহভাগিতায় ঢেঁকির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই আমাদের গ্রামীণ সমাজে ধান ও পিঠার গুঁড়ি ভানায় প্রয়োজন মেশিন নির্ভরশীলতা হ্রাস করে গ্রামীণ প্রযুক্তি ঢেঁকির প্রচলন করা এবং বিলুপ্তির হাত থেকে ঢেঁকিকে রক্ষা করা।
০৮ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস