ভোলা থেকে : ভোলায় ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সংঘর্ষে চারজন নিহত হবার পর এখনো ওই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
পুলিশ বলছে, এর জের ধরে গত তিনদিন ধরে বোরহানউদ্দিন উপজেলায় বিক্ষোভ চলছিল। কিন্তু এ বিক্ষোভ কীভাবে পুলিশের ওপর সহিংস আক্রমণে পরিণত হলো – তার এক নাটকীয় বর্ণনা দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল।
আজম মুকুল বলেন, কয়েকদিন আগে থেকে ঢাকায় থাকলেও – ওই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বোরহানউদ্দিনে পরিস্থিতি যে উত্তপ্ত হচ্ছে তিনি তার সব খবরই ফোনে পাচ্ছিলেন, এবং প্রশাসনকে আলেম-ওলামাদের সাথে বৈঠক করারও নির্দেশ দেন।
কিন্তু তার পরদিন রোববার ঈদগাহ ময়দানে “তৌহিদী জনতা’ নামের একটি ব্যানারে কয়েক হাজার মানুষ ওই মন্তব্যকারীর বিচারের দাবিতে সমাবেশ করে এবং এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে। জনতার ক্ষোভের মুখে পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার খবর জেনেই দ্রুত হেলিকপ্টারে ভোলায় ফিরে আসেন এমপি আলী আজম মুকুল।
কিন্তু তার মধ্যেই পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে যায়, যাতে চারজন নিহত হয়, আহত হন পুলিশসহ অর্ধশত মানুষ। সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল জানান, তিনি ঢাকায় থাকলেও বোরহানউদ্দিনে সব পক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন।
তিনি বলছিলেন, রোববার পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে তিনি বুঝতে পারেন যে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে। জেলার পুলিশ সুপার – উনি ফোন রেখে দেবার আগে আমাকে শেষ কথাটা বলেন, ‘স্যার আমাদেরকে বাঁচান। আমরা মসজিদের দোতলায় ইমামের রুমে অবরুদ্ধ আছি, আমাদেরকে বাঁচান,’ তার উক্তি ছিল এটাই।
ভোলা-২ এর এমপি বলেন, তখনই আমার মনে হলো যে এ মুহুর্তেই আমার ভোলা যাওয়া দরকার। সাথে সাথেই আমি হেলিকপ্টারযোগে ভোলা চলে আসি। দ্রুত আসার জন্য এ ছাড়া আমার উপায় ছিল না।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির নামে করা একটি ফেসবুক আইডির পোস্ট থেকে ঘটনার সূত্রপাত – যাতে ইসলামের নবী মোহাম্মদের নামে কটুক্তি করা হয়।
সাংসদ আলী আজম বলেন, বিপ্লব চন্দ্র শুভ তাৎক্ষণিকভাবে থানায় এসে জানান যে তার ফেসবুক আইডি হ্যাকিং করা হয়েছে, এবং তিনি একটি জিডি এন্ট্রি করেন। জিডি করার পর তার মোবাইলে একটা ফোন আসে।
“ওপাশ থেকে একজন বলে যে ‘আমি গাজীপুর থানার ওসি বলছি, তোমার মোবাইল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা জিনিস ছড়িয়ে পড়েছে, এটা আমি মুছে দিতে পারি – তুমি আমাকে ২ হাজার টাকা দাও।”
“ব্যাপারটা আমার নজরে আনা হলে আমি ভোলার পুলিশ সুপারকে এবং আমার নির্বাচনী এলাকা বোরহানউদ্দিনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেই দ্রুত এ ঘটনার নিরসন করার জন্য।”
সাংসদ আলী আজম বলেন, কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেন এবং বিপ্লব চন্দ্র শুভকেও থানায় রাখা হয়। পাশাপাশি যে মোবাইল থেকে ওই কলটি এসেছিল – আমরা মোবাইল ট্র্যাকিং করে জানতে পারি সে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার একটি ছেলে। তাকেও সেখান থেকে আনা হয়। পটুয়াখালীর এ ব্যক্তি আবার মোবাইল সিমটি নিয়েছিলেন বোরহানউদ্দিনের একজনের কাছ থেকে। তাকেও আমরা থানা হেফাজতে এনেছি।
তিনি বলেন, রোববারের গুলিবর্ষণের আগের দিন – অর্থাৎ শনিবার রাতে – এখানে স্থানীয় আলেম-ওলামারা ‘তৌহিদি জনতা’-র ব্যানারে একটি সমাবেশ ডাকেন। এতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের সাথে জেলা প্রশাসক, পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে একটি মিটিং করা হয়।
“এতে সবাইকে অবহিত করা হয় যে বিপ্লব চন্দ্র শুভ এবং পটুয়াখালী থেকে এ্যারেস্ট করে আনা ব্যক্তি – যে আইডি হ্যাকিং করেছে বলে আমরা সন্দেহ করছি – তারা কর্তৃপক্ষের হেফাজতে আছে। এতে তারা সন্তুষ্ট হয়ে ডিসি সাহেবের কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। তারা থানায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে রোববারের সমাবেশটি আর হবে না।”
তাহলে পরদিন পরিস্থিতি এত সহিংস হয়ে উঠলো কীভাবে?
সংসদ সদস্য আলী আজম বলছিলেন, “আলেম-ওলামারা থানায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে রোববারের সমাবেশটি আর হবে না। কিন্তু সকাল দশটার সময় ঈদগাহ মাঠে লোকজন জড়ো হতে থাকে।”
“এতে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে যে ইমাম সাহেবরা ছিলেন তারা এবং এসপি, এডিশনাল ডিআইজি সাহেবরা বক্তব্য দেন, মোনাজাতও করেন। এর পর যখন তারা চলে যাবেন তখন ঈদগাহের উত্তর দিকে মাইনকার হাট এবং দক্ষিণ দিকে দেউলা শার্শা থেকে দুটি মিছিল আসে। ”
সাংসদ আলী আজম বলেন, “তারা বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফাঁসি দাবি করে এবং সাথে সাথেই প্রশাসনের ওপর চড়াও হয়। এক পর্যায়ে প্রশাসনের লোকেরা আত্মরক্ষার জন্য দৌড়িয়ে ইমাম সাহেবের রুমে ঢোকে। তার পরের ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে আমি দেখেছি যে আলেম সমাজের নেতৃবৃন্দ মানুষকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন।”
“কিন্তু এখানে মুসলিম উম্মাহ ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে তাই আলেম সমাজের পাশাপাশি আমজনতাও জড়িয়ে গেছেন। তবে আলেমরা তাদের থামানোর চেষ্টা করেছেন।”
পুলিশের ওপর আক্রমণ হলো কেন?
এ প্রশ্নের জবাবে সাংসদ আলী আজম বলেন, “এটা আমি এ মুহূর্তে ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। ভিডিও ফুটেজ আছে, তার বিচার বিশ্লেষণ করে পরে আমরা এ ব্যাখ্যা দিতে পারবো যে কে বা কারা এ ঘটনার সাথে জড়িত। পিছন থেকে কেউ উস্কানি দিয়ে থাকলে সেটাও বেরিয়ে আসবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।” সূত্র : বিবিসি