কাজী আয়েশা ফারজানা : রামায়ণে আছে, ত্রেতাযুগে শরত্কালে রামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন। তবে তারও অনেক আগে সত্যযুগেই দুর্গাপূজার সূচনা হয়। ধার্মিক রাজা সুরথ শত্রুদের চক্রান্তে রাজ্য হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হন মেধস মুনির আশ্রমে।
মেধস মুনি তার দুর্দশা দেখে তাকে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য দুর্গাপূজা করার উপদেশ দেন। মুনির উপদেশ মেনে সুরথ রাজা দুর্গাপূজা করেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে তিনি শত্রুদের পরাস্ত করে আপন রাজ্য উদ্ধারে সক্ষম হন। সেই থেকে প্রচলিত হয় দুর্গাপূজা।
কিন্তু দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল সেই মেধস মুনির আশ্রম কোথায়? আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে বেদানন্দ স্বামী দৈব ক্ষমতা দিয়ে জেনেছিলেন সেই মেধস মুনির আশ্রম আর কোথাও নয়, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর করলডেঙ্গার পাহাড়ে। তখন তার উদ্যোগে গড়ে ওঠে এই আশ্রম।
আশ্রমে চণ্ডী মন্দির, শিব মন্দির, সীতা মন্দির, তারা কালী মন্দিরসহ ১০টি মন্দির রয়েছে। রয়েছে সীতার পুকুরও। বছরজুড়ে মনসকামনা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে দেশ–বিদেশের পুণ্যার্থীরা ছুটে আসেন এই আশ্রমে। পৌরাণিক কাহিনির স্মৃতি-অণুস্মৃতি নিয়ে করলডেঙ্গা পাহাড়ের এই আশ্রম এখন পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম তীর্থকেন্দ্রে।
সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিব মন্দিরের মতো পাহাড় বেষ্টিত নিসর্গের মাঝে এই আশ্রমের অবস্থান। শানবাঁধানো পুকুর, হরেক রকম গাছগাছালি আর পাহাড়ের শোভা দেখতেও এই আশ্রমে ছুটে আসেন পর্যটকেরা।
বোয়ালখালী উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে মধ্যম করলডেঙ্গা গ্রামের করলডেঙ্গা পাহাড়ের চূড়ায় এই আশ্রমের অবস্থান। আশ্রমের প্রধান ফটক দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার গেলে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রায় ১৪০টি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে মেধস মুনির মন্দির চোখে পড়বে। এই মন্দিরের পরই দেবী চণ্ডীর মূল মন্দির। এর একপাশে সীতার পুকুর, পেছনে রয়েছে ঝরনা। মন্দিরের পেছনে সাধু সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে দোতলা ভবন।
প্রায় ৬৮ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত এই মন্দিরে প্রতিবছর মহালয়ার মাধ্যমে দেবী পক্ষের সূচনা হয়। দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানাতে প্রতিবারের মতো এবারেও চলছে প্রস্তুতি। সেদিন শত শত পুণ্যার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে এ আশ্রম।
আশ্রমের পুরোহিত বুলবুলানন্দ মহারাজ জানান, প্রতিবছর মহালয়ার মধ্যে দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। ভোর থেকে চণ্ডীর আরাধনার মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করা হয়।
তিনি আরও বলেন, পুরাকালের এই আশ্রমের কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ থাকলেও সাধারণ্যে তার প্রকাশ বা প্রচার ছিল না। ১১৩ বছর আগে দৈববলে পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ বেদানন্দ স্বামী এই তীর্থভূমি আবিষ্কার করেন। একসময় জঙ্গল পার হয়ে আশ্রমে আসতে হতো। তবে বর্তমান আশ্রমটির বিভিন্ন স্থাপনা ভক্ত–অনুরাগীদের অনুদানে গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ হারাধন বিশ্বাস ও বাবুল বড়ুয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এ মন্দিরের ওপর চলেছিল ধ্বংসযজ্ঞ। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এর দেশীয় দোসরেরা ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল গানপাউডার দিয়ে আশ্রমটি জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় হানাদার বাহিনী কামানের গোলা বর্ষণ করে আশ্রমের অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংসাবশেষ থেকে লুটে নেয় মূল্যবান প্রতিমা। সবকিছু নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণে প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকে এ মন্দিরে আরাধনা। ১৯৮৯ সালে পাথরের মূর্তি দিয়ে পুনঃস্থাপন করা হয় মন্দিরটি।
বোয়ালখালী পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অজিত বিশ্বাস বলেন, আশ্রমটিকে জাতীয় তীর্থ ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু বরাবরই বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে আসছে। প্রথম আলো
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি