মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:২৪:২৫

ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের মৃত্যু নিয়ে রহস্য

ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের মৃত্যু নিয়ে রহস্য

মহিউদ্দীন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে : ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে হত্যা করে বাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। অন্যদিকে পুলিশ এখন পর্যন্ত ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ মনে করলেও এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য।

গত রোববার রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে নিজ কক্ষের দরজা খোলার জন্য অনেক ডাকাডাকি করেন তার মা। একপর্যায়ে কোনো সাড়া না পেয়ে পরে প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় জানালা দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ দেখতে পাওয়া যায়। এরপর স্থানীয় হাটহাজারী থানা পুলিশ গিয়ে রাত ১০টায় তার মরদেহ উদ্ধার করে।

ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেন দিয়াজ ইরফানের অনুসারী নেতাকর্মীরা। সকালে তার লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আনা হলে সেখানে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী। তারা এ সময় প্রবর্তক মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে পরিবারের অনুরোধে ব্যারিকেড তুলে নেয়া হয়।

একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে ছেড়ে আসা শহর থেকে কোনো শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেনি। বাধার মুখে হাটহাজারীর নন্দীরহাট স্টেশনে এসে আটকা পড়ে শাটল ট্রেন। একই ঘটনার প্রতিবাদে সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সড়কে অন্তত ৫০০-৬০০ বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে ১০ কিলোমিটারে সৃষ্টি হয় যানজট। এই সময় দিয়াজের অনুসারীরা ঘটনার বিচার চেয়ে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ৪০ মিনিট যান চলাচল বন্ধ করে রাখে। অন্যদিকে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা।

পরিবারের দাবি ‘হত্যা’: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে বাসায় পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার বাবা সরওয়ার আলম, মামা রাশেদ আমিন চৌধুরী, মা জাহেদা আমিন চৌধুরী, বোন সাঈদা ছরওয়ার নিশাসহ পরিবারের সদস্যরা।

তারা জানান, কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ কর্মীরা শত্রুতার জের ধরে দিয়াজের বাসায় হামলা চালায়। এ সময় বাসায় তার মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাদের ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে ঘটনার বিচার চেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানায় দিয়াজের মা। তিনিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা।

হামলার ঘটনার পর থেকে দিয়াজ কিছুদিন বাসার বাইরে অবস্থান করছিলেন। সর্বশেষ মারা যাওয়ার আগের দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তাকে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায়। এরপর গত রোববার রাতে তার মৃত্যু হয়।

তবে ঠিক কারা তাকে হত্যা করতে পারে সে বিষয়ে পরিবার থেকে নাম উল্লেখ করা না হলে তারা দাবি করছেন, ছাত্রলীগের একটি পক্ষে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা ঢুকে পড়েছে। দিয়াজ মৌলবাদমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার আন্দোলন করে আসছিলেন। পাশাপাশি দলের ভেতরও তার একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। সে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজম নাছিরের অনুসারী ছিল। এ কারণে তার উত্থানে অনেকে ঈর্ষান্বিত ছিল।

দিয়াজের বোন সাঈদা ছরওয়ার নিশা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ওরা আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। পরে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মুখে ও হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমার ভাই আত্মহত্যা করার মতো মানুষ না। ও খুব মেধাবী ছিল। ২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষায় পেয়েছিল ৪ দশমিক ৭০। এমবিএ করে সে এমফিল করছিল। তারও আগে বিসিএস পরীক্ষায় মৌখিক দিয়ে এসেছিলেন।’

এক প্রতিবেশী ঘটনাস্থলে বলেন, ছেলেটি আত্মহত্যা করবে একথা বিশ্বাস করা যায় না। সে খুব হাসিখুশি ছিল। পারিবারিক কলহ থাকলে তো জানতাম। অনেককে বলতে শুনেছি তার হাতে নাকি অন্য কোনো মানুষের ছাপ আছে। তদন্ত করলে সত্যিটা বেরিয়ে আসবে।

পুত্রকে হারিয়ে নির্বাক মা জাহেদা আমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘দিয়াজ খুব মেধাবী ছিল। তাকে বন্ধুরাও খুব ভালোবাসতো। পড়ালেখায় সে যেমন ভালো, তেমনি রাজনীতিতেও তার আলাদা অবস্থান ছিল। অনেক ডাকাডাকির পরও যখন দরজা খুলছিল না তখন ভেঙে ঢুকে দেখি লাশ ঝুলছে।

দিয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাস: ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট গ্রুপের সঙ্গে মারামারির পর দিয়াজ ইরফান গত ১১ই নভেম্বর তার নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি একজন সাবেক শিক্ষার্থী। চবির সাথে আমার সম্পর্ক এটাই। চবির রাজনৈতিক কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ না করার অনুরোধ রইলো। করলে ব্ল্যাকলিস্টে ঢুকবেন। আমাকে আমার মতো করে ভালো থাকতে দেন, সবাই ভালো থাকুন।’

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানান, দিয়াজরা তিন বোন ও দুই ভাই। ভাইদের মধ্যে সে সবার বড়। আর সবার মধ্যে দ্বিতীয়। তার বড় বোন জুবাইদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা। তিনি আইন পেশার সঙ্গে জড়িত। ছোট দুই বোনের মধ্যে সাঈদা ছরওয়ার নিশা চবি থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। আরেক বোন নাহিদা ছরওয়ার নিভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ছোট ভাই মিরাজ ইরফান এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন।

তবে গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে লাশ নেয়ার পর সেখানে মেয়র আজম নাছির উদ্দিন হাজির হতে না পারায় পরিবারের সদস্য ও দলের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা যায়। দিয়াজের মামা রাশেদ আমিন চৌধুরী বলেন, কোনো আওয়ামী লীগ নেতা আসার দরকার নেই। তাকে কাউকেই ধরতে দেবো না।

দিয়াজের বন্ধু ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা মামুন বলেন, সে চবি কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় দিয়াজ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু দলের অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আলমগীর টিপু প্রেসিডেন্ট হলে এই নিয়ে দুজনের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) এইচএম মশিউদ্দৌলা রেজা বলেন, বাসার ভেতর লাশ ঝুলছে এমন খবর পেয়ে আমাদের টিম গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পরিবার দাবি করেছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে কেন সে আত্মহত্যা করবে তাও রহস্যজনক।

হাটহাজারী থানার ওসি বেলাল উদ্দিন জাহাঙ্গীর বলেন, এখনই কোনো মন্তব্য করবো না। তবে প্রাথমিকভাবে আলামত দেখে ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। এমজমিন
২২ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে