চট্টগ্রাম থেকে : মুখভরা দাড়ি, গায়ে আধ-ময়লা লুঙ্গি-শার্ট। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছিলেন মানুষটা। দিনের একেবারে শেষ সময়ে বিক্রির শেষ ডাবটা নিতে বেশ অনুনয় করছিলেন। তাই খুব দয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই ডাব খেয়েই আমার সব শেষ। জ্ঞান ফিরেছিল একদিন পর।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে পুলিশের উপ-কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে প্রতারিত হওয়ার গল্প বলছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রকি।
প্রায় ৮৫ বছর বয়সী রতন মিয়ার অসহায়ত্ব দেখে ডাবটি কিনে খান শিক্ষার্থী মেহেদী। এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। বৃদ্ধ রতন মিয়া আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা সেই ডাবে আগে থেকেই মিশিয়ে রেখেছিল ক্লোনাজিপাম নামের ঘুমের ওষুধ, যা খেয়ে মেহেদীর মৃত্যুও হতে পারত। গত শনিবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় নগরের নিউমার্কেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগীর বন্ধু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মামুনুর রশিদ বলেন, মেহেদীকে আগে থেকেই টার্গেট করেছিল অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য বাসে ওঠার পর একজন এসে তার পাশে বসে। একই সময় বাইরের জানালার ধারে থাকা ওই ডাব বিক্রেতা মেহেদীকে ডাব কিনতে বারবার অনুরোধ করেন। ডাব খাওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে ওই চক্রের বাকি সদস্যরা তার মোবাইল ফোন সেট, নগদ ১ হাজার ৭০০ টাকা ও নতুন কেনা কাপড় নিয়ে যায়। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর মেডিকেলে তার জ্ঞান ফেরে।
কথা হয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার মলম পার্টির দলনেতা শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, তিন-চার বছর ধরে ঢাকা-কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়ার কাজ করছেন তারা। চট্টগ্রামে তিন মাস হলো তারা এ কাছ শুরু করে। গত এক সপ্তাহে নগরের কোতোয়ালি ও বাকলিয়া এলাকায় এ ধরনের তিনটি কাণ্ড ঘটিয়েছে তারা।
শহিদুলের বলেন, ‘আগে রাজধানী ঢাকার শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী এলাকায় ডাবের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়ার কাজ করতাম। কিন্তু এখন ঢাকার মানুষ অনেক সচেতন। তাই দল নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসি।’
তিনি বলেন, ‘একসময় চট্টগ্রামে নকশিকাঁথা বিক্রি করতাম। তাই চট্টগ্রামের পথঘাট চেনা। গত এক সপ্তাহে তিনটা অপারেশন করেছি। বৃদ্ধ রতন মিয়া আমার খালু হয়। কিছুদিন আগে বাড়ি থেকে আসছেন। তাকে দিয়েই নানাভাবে মানুষকে ডাব কিনতে বাধ্য করতাম। বয়স্ক মানুষ বলে মানুষ সহজেই পটে যেত।’
এর আগে দুপুর ১টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান জানান, নগরের বাকলিয়া ও কোতোয়ালি থানার যৌথ অভিযানে মলম পার্টির চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা বাসযাত্রী ও পথচারীদের কাছে কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য মেশানো ডাব বিক্রি করত। পরে ডাব খেয়ে অসুস্থ ব্যক্তির টাকা-পয়সা ও মোবাইলের মতো দামি জিনিসপত্র হাতিয়ে নিত।
শনিবার এ চক্রের শিকার হন এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। সর্বশেষ গতকাল সোমবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে নগরের নতুন ব্রিজ এলাকার ফল ব্যবসায়ী আমির হোসেনের (৩০) কাছ থেকে একই উপায়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোতোয়ালি ও বাকলিয়া থানা পুলিশ গতকাল এক যৌথ অভিযানে মলম পার্টির চার সদস্যকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ক্লোনাজিপাম সিরিজের ‘এপিট্রা-২ ও লোনাজেপ-২’ নামের ৪২০ পিস চেতনানাশক ঘুমের ওষুধ ও ১৫টি সিরিঞ্জ জব্দ করা হয়।
মেহেদী হাসান বলেন, ‘একটি ডাবে তারা ২০টির মতো চেতনানাশক ঘুমের ওষুধ মেশায়। এ ওষুধ মেশানো ডাব খাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভিকটিম অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ওষুধের পরিমাণ বেশি হলে মানুষটা মারাও যেতে পারে।’
গ্রেফতার এ চক্রের চার সদস্য হলেন- খুলনা জেলার নৈহাটি ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল চমেদ হাওলাদারের ছেলে শহিদুল ইসলাম, একই জেলার সোনাডাঙ্গা থানার জয়নাল সর্দারের ছেলে মো. বাবুল (৩৬), পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ি থানার বাসিন্দা রতন মিয়া (৮৫) এবং বরগুনা জেলার মধ্য আমতলীর বাসিন্দা আব্দুর রহিমের ছেলে মো. হারুন (৩১)। এর মধ্যে বাবুল ও শহিদুল সম্পর্কে শালা-দুলাভাই। রতন মিয়া বাবুলের ফুফা শ্বশুর এবং হারুন শহিদুলের বন্ধু।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘মলম পার্টির এ দলটি ভ্রাম্যমাণ। দলের সদস্যরা সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজন। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ১০০টির বেশি ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। কোনো এলাকায় গেলে তারা স্থানীয় হোটেলে উঠত। ওদের দলনেতা শহিদুল একবার কুমিল্লায় পকেট কাটতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া পুরো কৌশলে মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন বৃদ্ধ রতন মিয়া। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটার অনুনয়-বিনয় দেখে পথচারীদের দয়া হতো। তারা বৃদ্ধের কাছ থেকে ডাব কিনে খেত। কিন্তু বিক্রি করা ডাবে সিরিঞ্জের মাধ্যমে আগ থেকেই নেশাজাতীয় দ্রব্য প্রবেশ করানো থাকত। তাই ওই ডাব খাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে ভিকটিম জ্ঞান হারায় এবং তার সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও মালামাল হাতিয়ে নিত এ চক্রের বাকি সদস্যরা।’
বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন বলেন, এ চক্রের চার সদস্যের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে। বৃদ্ধ ব্যক্তি কৌশলে ডাব বিক্রি করতেন। মানুষকে দেখাতে একটি ডাব কিনে খেত (যেটিতে নেশাজাতীয় দ্রব্য মেশান থাকে না) অপরজন। বাকি দুজন অজ্ঞান ব্যক্তিকে নিজেদের স্বজন পরিচয় দিয়ে মালামাল ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিত।